সম্পাদক
প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১১:৫৫ এএম
আমরা জানি, দিবস পালনের গুরুত্ব রয়েছে। বিশ্ব নদী দিবস পালনের প্রেক্ষাপটও
সৃষ্টি হয় সেই গুরুত্ব থেকেই। ২৪ সেপ্টেম্বর বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও
দিনটি পালিত হয়েছে। ১৯৮০ সাল থেকে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রবিবার বিশ্ব নদী
দিবস পালন শুরু করে ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি। এরপর থেকে পর্যায়ক্রমে
তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বে। বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষে ২৪ সেপ্টেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশসহ
সহযোগী অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলোতে যে চিত্র উঠে এসেছে,
তা আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না।
দেশের নদ-নদীর বিপন্ন চিত্র প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে। তবে এ ব্যাপারে
সংশ্লিষ্ট মহলের প্রতিশ্রুতি-অঙ্গীকার ভিন্ন কাজের কাজ কী হয়েছেÑ তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ
নিষ্প্রয়োজন। নদ-নদী দখল-দূষণসহ অস্তিত্ব বিপন্ন হয়Ñ এমন সবকিছুর বিরুদ্ধে আমাদের উচ্চারণ
সুস্পষ্ট। নদীর প্রতি ভালোবাসার প্রমাণ মেলে প্রতিদিনের বাংলাদেশের সপ্তাহজুড়ে ফিচার
পাতার নামকরণে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, নদীমাতৃক দেশের ইতিহাস ম্লান হয়ে যাচ্ছে
নদ-নদীর শোচনীয় দশার প্রেক্ষাপটে। দখল-দূষণ কিংবা মনুষ্যসৃষ্ট নানা কর্মকাণ্ডে দেশের
সিংহভাগ নদ-নদী যে শুধু অস্তিত্ব সংকটেই পড়েছে তা-ই নয়, এর বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব
ক্রমেই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। নদ-নদী শুধু আমাদের কাছেই নয়, সমগ্র পৃথিবীর ধমনির মতো।
নদ-নদীর অবাধ প্রবহমানতায় জীবনরক্ষার পথ মসৃণ হয়। কিন্তু যেভাবে পরিবেশ-প্রতিবেশ হুমকির
মুখে ঠেলে দেওয়ার উন্মত্ততা পরিলক্ষিত হচ্ছে; তাতে প্রশ্ন জাগেÑ মানুষের জীবন-জীবিকার
সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কযুক্ত পরিবেশের ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করে হা-হুতাশ করাই কি
নিয়তি?
বিশ্বের উন্নত দেশে তো বটেই, অনেক উন্নয়নশীল দেশেও নদ-নদীকে জীবন-জীবিকার
ক্ষেত্রে রক্ত সঞ্চালন লাইন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উন্নত-উন্নয়নশীল অনেক দেশেই নদ-নদীর
সুরক্ষাসহ অবাধ প্রবহমানতা বজায় রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। ২০১৯ সালে আমাদের উচ্চ আদালত
দেশের সব নদীকে ‘লিভিং এনটিটি’ বা ‘জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে ঘোষণা করেন। কিন্তু এরপরও
আমরা বাস্তবে কী দেখছি? উত্তর প্রীতিকর নয়। নদীভাঙন দেশে প্রকট রূপ নিয়েছে এবং এর ফলে
একদিকে বাড়ছে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা, অন্যদিকে ঘটছে ব্যাপক সম্পদহানি। বিশেষজ্ঞদের
অভিমতÑ নদী শাসনে ভুল পরিকল্পনা, অদূরদর্শিতা এবং একই সঙ্গে উদাসীনতা সমান্তরালে দায়ী।
২৪ সেপ্টেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশসহ সহযোগী দৈনিকগুলোতে নদ-নদী থেকে ইজারার শর্ত লঙ্ঘন
করে বালু উত্তোলনের যে চিত্র উঠে এসেছে; তাতে মহল বিশেষের পকেট ভারী করার মধ্য দিয়ে
দেশ-জাতির সংকট কীভাবে প্রকট হচ্ছে তাও জানা গেল। পাশাপাশি ড্রেজিং ও দখল-উচ্ছেদের
নামে সাপলুডু খেলা এবং সরকারের অর্থনাশের অপপ্রক্রিয়াও উঠে এসেছে।
আমরা মনে করি, নদ-নদী রক্ষার জন্য নিয়মিত নজরদারি এবং দখল-দূষণের
থাবা থেকে মুক্তির স্থায়ী ব্যবস্থা না থাকার কারণে দুরবস্থা ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে।
এমনটি কোনোভাবেই চলতে পারে না। আমরা আরও মনে করি, দেশের পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলন মূলত
নদ-নদীকেন্দ্রিক আন্দোলন হওয়া উচিত। নদ-নদী রক্ষায় সংশ্লিষ্ট সব মহল তো বটেই, সাধারণ
মানুষের দায়িত্বও কম নয়। দখল-দূষণ ও নীতিমালা লঙ্ঘনের জন্য যারা দায়ী, তারা অচিহ্নিত
না হওয়া সত্ত্বেও কেন দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকারের নজির বিরলÑ এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্য
দিয়ে নদী রক্ষায় আমাদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে হবে। নদ-নদীর স্বাভাবিকতা বিনষ্টে অর্থাৎ
দখল-দূষণে যারাই দায়ী, তাদের প্রতি কোনো অনুকম্পা নয়; বরং যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নিশ্চিত
এবং নদ-নদীর অস্তিত্ব রক্ষার অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সরকারকে দৃঢ়তার পরিচয়
দিতে হতে হবে।
কেন নদ-নদী রক্ষা করা যাচ্ছে নাÑ এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায়ও সংশ্লিষ্ট
পক্ষগুলো এড়াতে পারে না। নদী রক্ষা কমিশন, বিআইডব্লিউটিএ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ প্রশাসনের
যূথবদ্ধ প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। নদ-নদী রক্ষায় যে নীতি ও আইন রয়েছে এর বাস্তবায়নের
জন্য জরুরি যথাযথ তদারকি। যেসব জটিলতায় আমাদের নদ-নদী হাঁসফাঁস করছে, অত্যাচার-অনাচারে
এগুলোর প্রাণপ্রবাহ বিপন্ন থেকে বিপন্নতর হচ্ছেÑ এমন প্রেক্ষাপটে আর কথা নয়, কাজের
কাজ করতে হবে সময়ক্ষেপণ না করে। বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য রক্ষায়ও নদ-নদীর গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা রয়েছে, তাও আমলে রাখা প্রয়োজন। নৌপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার পথ মসৃণ করা শুধু পরিবেশ-প্রতিবেশের
ভারসাম্য সুরক্ষার প্রয়োজনেই নয়, অর্থনীতির স্বার্থেও জরুরি। নদী ও মানুষের আত্মীয়তার
কথা অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে আমলে রাখতে হবে সামগ্রিক স্বার্থ ও প্রয়োজনেই।