রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তা
মোহাম্মদ আলী শিকদার
প্রকাশ : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০:২৯ এএম
মোহাম্মদ আলী শিকদার
২০ সেপ্টেম্বর
প্রতিদিনের বাংলাদেশে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কক্সবাজার-উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের
ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে অভিযান চালিয়ে শতাধিক রোহিঙ্গাকে আটক করেছে পুলিশ। পুলিশের তরফে বলা
হয়েছে, ক্যাম্প এলাকা থেকে রোহিঙ্গারা যেন ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সেজন্য কড়া নজরদারি
রয়েছে। ২১ সেপ্টেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশে প্রকাশিত ভিন্ন একটি সচিত্র প্রতিবেদনে
দেখা গেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কাঁটাতারের বেড়া কেটে বের হচ্ছে অনেক রোহিঙ্গা। ওই প্রতিবেদনে
বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন জায়গায় কাঁটাতার কেটে চলাচলের
পথ করা হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের গমনাগমন নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় জননিরাপত্তা
বিঘ্নিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেক রোহিঙ্গা পাসপোর্ট, এনআইডির মতো স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ
দলিল সংগ্রহ করে বিদেশে আমাদের শ্রমবাজারেও যুক্ত হচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কড়া নজরদারির
অভাবে এবং রোহিঙ্গাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় জননিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প
থেকে বের হয়ে কারা কোথায় কী করছে তা অনুমান করা যেতে পারে। ক্যাম্প থেকে কাঁটাতারের
বেড়া ভেদ করে অনেকে স্থানীয় এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। কেউ কর্মসংস্থান খুঁজে বেড়াচ্ছে
আবার অনেকে অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্ন তবে সক্রিয় জঙ্গি সংগঠন দ্বারা নানাভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে
বলে অভিযোগ রয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তরুণ কিংবা যুব্করা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়
ভুগছে। এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সুযোগ নিয়ে অপশক্তি তাদের নানাভাবে বিদেশে শ্রমবাজারে পাঠানোর
চেষ্টা করছে। এদেরই কেউ কেউ এনআইডি ও পাসপোর্ট সংগ্রহ করে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। আমাদের
জাতীয় নিরাপত্তায় এমনটির নেতিবাচক প্রভাব কম নয়। আশ্রিত রোহিঙ্গারা যদি এনআইডি অথবা
পাসপোর্ট সংগ্রহ করে তাহলে তারা দেশের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকারী হয়ে যায়।
তাদের পরিচয় আর রোহিঙ্গা থাকে না। বাংলাদেশি পরিচয়ে দেশে-বিদেশে তারা যেকোনো সুযোগ-সুবিধা
পাওয়ার ন্যায্য অধিকারী হয়। বিষয়টি আমাদের জাতীয় পরিচয়গত নিরাপত্তার জন্য হুমকি অবশ্যই।
রোহিঙ্গাদের অনেকে যখন বাংলাদেশি পরিচয় পাবে তখন তারা স্থানীয়দের মধ্যে নানা সম্পর্ক
গড়ে তুলতে পারবে সহজেই। নিজেদের রোহিঙ্গা পরিচয়টি অবলুপ্তির মাধ্যমে মিশে যাওয়ার বিষয়টি
নেতিবাচক এই অর্থেÑ রোহিঙ্গারা ন্যায়সঙ্গতভাবে মিয়ানমারের নাগরিক। বৈশ্বিক সংকটের নানা
নেতিবাচক প্রভাব আমাদের ওপর পড়ছে। এমন সময়ে অন্য দেশের নাগরিক যদি আমাদের এনআইডি ও
পাসপোর্ট পায় তাহলে জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে যেমন পড়ার আশঙ্কা বাড়ে তেমনি দেশের
নাগরিকদেরও সুবিধাবঞ্চিত হওয়ার শঙ্কা থাকে। কাজেই রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে নানা পথ
দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে, সংকট শুধু এখানেই থেমে নেই। বিদেশে আমাদের শ্রমবাজারেও তারা অযাচিতভাবে
যুক্ত হচ্ছে এবং দেশেরই স্বার্থান্বেষী কুচক্রী মহল তাদের মদদ দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের
বিভিন্ন গ্রুপ নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছে, প্রাণহানি ঘটছে। জননিরাপত্তা
নিশ্চিতকরণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইতোমধ্যে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করলেও তাদের
পরিশ্রম ব্যর্থ হচ্ছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নজরদারি রাখার অভাবে।
এনআইডি কিংবা
পাসপোর্ট যেন অবৈধ পন্থায় কারও হাতে না পৌঁছায় তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা
রক্ষাকারী বাহিনীর। এ বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশন ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
এনআইডি কিংবা পাসপোর্ট হস্তান্তরের আগে ব্যক্তিকে শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে গাফিলতির বিষয়টি
নতুন না হলেও বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এ বিষয়ে এর অবকাশ নেই। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতর
বেশ কয়েকটি স্থানে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। নিরাপত্তা রক্ষার কর্মকান্ড শুধু চেকপোস্টনির্ভর
হলে ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের গমনাগমন নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। বরং তারা ক্যাম্প
থেকে বের হয়ে শ্রমভিত্তিক নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাবে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয়
দিয়ে আমরা মানবিক দায়িত্ব পালন করছি। ক্যাম্পে তাদের কষ্টে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে এ
কথা সত্য। তবে তাদের নিজ দেশ মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে পর্যাপ্ত তৎপরতা
না নেওয়ায় তাদের দুর্ভোগ বেড়ে চলেছে। মানবিক দায়িত্ব পালনের বিষয়টিকে বিবেচনায় রেখেই
আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংহতি বিনষ্ট হতে দেওয়া যায়
না। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে
হবে। ব্যক্তিপর্যায়ে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনই সমাধান দেবে না। ক্যাম্পে শিগগিরই
নতুন নিরাপত্তাকৌশল বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পনা গড়তে হবে। যদি তা করা না যায়, তাহলে
জননিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরেও বাড়তি
চাপ সৃষ্টি হবে। কারণ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিচ্ছিন্ন জঙ্গিবাদী সংগঠনের
নেটওয়ার্ক অবারিত। তারা অসহায় রোহিঙ্গাদের নিজ হীনস্বার্থ বাস্তবায়নে ব্যবহার করতে
পারে। ক্যাম্প থেকে কর্মসংস্থান খুঁজতে বের হওয়া রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করা সহজ। তাদের
শনাক্ত করার প্রাথমিক পদ্ধতি না থাকায় আড়ালে তারা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে
সম্পৃক্ত হয়ে যেতে পারে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন
কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়ন করা জরুরি। প্রত্যাবাসন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা গেলে অভ্যন্তরীণ
নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিদ্যমান সংকট দূর হবে। বাংলাদেশের কূটনৈতিক মহল এ বিষয়ে যথেষ্ট
তৎপর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সম্মেলন এবং জাতিসংঘে
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়টি জোরালোভাবে উপস্থাপন করে প্রশংসিত হয়েছেন। তবে বিশ্ব
সম্প্রদায়কে এখনও বিষয়টি নিয়ে জোরালো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে। অতীতে এই কলামেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের
কারো কারোর দ্বৈত চরিত্র বিশ্লেষণ করেছিলাম। তখন নানা উদাহরণ ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকে
উপস্থাপন করে দেখিয়েছি কেন রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখনও তৎপর
হচ্ছে না। তবে আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা চলমান রয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, অভ্যন্তরীণ
নিরাপত্তাজনিত সংকট সৃষ্টি হওয়ার পরও বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভাজন রয়েছে। বিভাজন
এই অর্থে, রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি অংশ রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের বিষয়ে জোরালো ভূমিকা পালন
করছে এবং আরেকটি বড় অংশ এ বিষয়ে নীরবতা অবলম্বন করছে। দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সেই
অর্থে কখনও ছিল না। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি উপমহাদেশীয় চরিত্র অনুসারে বিভাজনের দাগে
বিচ্ছিন্ন। কিন্তু এই বিভাজনের মধ্যেও রয়েছে একে অপরকে দোষারোপ করার প্রবণতা।
সম্প্রতি গণতন্ত্র
ও মানবাধিকার প্রসঙ্গে বিরোধী দল ও তাদের সমমনা দলগুলো বিদেশিদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা
করছে। কিন্তু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে সমাধানের বিষয়ে তারা কোনো তদবির করছে না।
রোহিঙ্গা সংকট আমাদের জাতীয় সমস্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রত্যেকটি দলেরই
উচিত এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলে চাপ তৈরি করা। রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যাক এমনটি যেমন
দেশের মানুষ চায়, তেমনি চায় আশ্রিত রোহিঙ্গারাও। অন্য একটি দেশে নাগরিক সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত
হয়ে তারাও থাকতে চায় না। যখন রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে তৎপর হবে, তখন তা-ও কিন্তু জনসমর্থন
আদায়ে তাদের সহযোগিতা করতে পারে। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যারা ক্ষমতায় থাকে্ন
তারা প্রতিটি বিষয়কে ম্যানিফেস্টো আকারে প্রচারের চেষ্টা করেনÑ তা যে দলই হোক না কেন।
আর বিরোধী দল সমালোচনার পথে না গিয়ে সব সময় দোষারোপে ব্যস্ত থাকে। ক্ষমতাসীন দল কী
করতে পারেনি তার সুলুকসন্ধান তাদের জানা থাকে, কিন্তু সংকট সমাধানে তাদের কোনো প্রস্তাবনা
নেই। দলীয় স্বার্থই তখন প্রাধান্য পায়। নিকট অতীতে, নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে জঙ্গি
সংগঠনকে ব্যবহার করছেন কিছু রাজনীতিক, এমন অভিযোগও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তখনও
এই স্তম্ভে বিষয়টি বিশ্লেষণ করেছি।
২০১৭ সালে যখন রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে চলে আসছিল তখন যদি বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় না দিত তাহলে দেশের অভ্যন্তরে অনেকেই ধর্মীয় অনুভূতির পরিপ্রেক্ষিতে দায়িত্বশীলদের প্রশ্নবিদ্ধ করতেন। দেশের অভ্যন্তরে যখন কোনো বিষয়ে দাবি ওঠে তার আন্তর্জাতিক প্রভাবও থাকে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে অবশ্য উপরোক্ত অভিযোগকারীরা নীরব। অথচ দেশের অভ্যন্তরে এ বিষয়ে দাবি উঠলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাতে নজর দিতে বাধ্য। বাংলাদেশের ভৌগোলিক গুরুত্ব বাড়ছে এবং বিদেশিরা এখানে বিনিয়োগ বাড়াতে শুরু করেছেন। তাই দেশের অভ্যন্তরে যদি এমন অস্থিতিশীল পরিবেশ থাকে তাহলে তা তাদের জন্য ক্ষতিকর। কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার পাশাপাশি বাড়ানো প্রয়োজন প্রত্যাবাসন বিষয়ে জনমতামত গঠনের প্রক্রিয়া। অর্থাৎ, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কর্মসূচি দ্রুত বাস্তবায়ন করা গেলেই আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে জিইয়ে থাকা প্রশ্নগুলোর নিরসন হবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তার ব্যাপারে আরও সতর্ক হতে হবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নজরদারি প্রক্রিয়ায় গাফিলতি রয়েছে। বিষয়টি সমাধানের জন্য চেকপোস্টনির্ভর ও সনাতন পদ্ধতির ওপর নির্ভর না করে নতুন কর্মপরিকল্পনা নেওয়া জরুরি।