রম্য
জাঁ-নেসার ওসমান
প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১২:৫৮ পিএম
জাঁ-নেসার ওসমান
হাঁপাতে হাঁপাতে মিজানের. প্রবেশ;
‘কী ব্যাপার. আপনে বলে আজকাল ছদ্মনামে লেখালিখি করতাছেন? কার্টুনও নাকি ছদ্মনামে ছাপতাছেন?
হইল কী? ইনকাম ট্যাক্সে ডাক দিছেনি?
‘বাংলাদেশে লেখকদের. কবিদের.
কার্টুনিস্টদের যা ইনকাম তার আবার. ইনকাম ট্যাক্স!
তোর কথা শুনলে ঘোড়াভি হাঁসব।’
‘ইনকাম ট্যাক্সের. যদি ডাক না
পান, তয় ছদ্মনামে লেখেন ক্যান?’
‘ওই ব্যাডা মিজাইননা, তুমি বোজো
না, এটা সংস্কৃতি জগতের একটা স্টাইল, বাবা-মার দেওয়া নামে না লিইখ্যা, অন্য নামে, মানে
ছদ্মনামে লেখা।’
‘ভাইডি, এই সব চাপা না মাইরা
আসল কতা কবা, তুমি ছাগলমারা আঁকিকার নাম থুইয়্যা, ছদ্মনামে লেখালিখি করতাছো ক্যান?’
‘আরে ভাই এই যে, বিদ্রোহী কবি
নজরুল ইসলামও তো ছদ্মনামে লিখতেন।
আর তার ছদ্মনাম ছিল “ব্যাঙাচি”।’
‘ওমা! এইডা কী কন, কাজী নজরুল
ইসলামের ছদ্মনাম ব্যাঙাচি! ব্যাঙের পোনা!’
‘ওই গরু, ওই যে পৃথিবীবিখ্যাত
উপন্যাস টমসয়্যার-এর মার্কিন লেখক মার্ক টোয়েনের আসল নাম “স্যামুয়েল ল্যাংহর্ন ক্লেমনস্”।
আর তোদের. ‘ক্রীতদাসের হাসি’র লেখক শওকত ওসমান...’
‘জানি জানি শওকত ওসমানের আসল
নাম শেখ আজিজুর রহমান। উনার ছদ্মনাম হলো শওতক ওসমান।’
‘সবই যখন বোজো তখন আমি ‘পেননেমে’
লিখলে মানে ছদ্মনামে লিখলে তোর জ্বলে ক্যা? আর এই সব ছদ্মনাম শিল্পে সাহিত্যে অহরহ
চলে।’
‘আমার জ্বলে ক্যা তুমি বোজো
না?’
‘ও, বাব্বা, আমার ছদ্মনামে তোর
অসুবিধা হয়! আশ্চর্য!’
‘ভাইরে. ভাই, আমি আপনার পাবলিকছার,
আপনার নিজের নামে যখন যেখানে যা কিছু ছাপে, তখন সেটা একটা বিজ্ঞাপনের কাজ করে। পরে.
যখন আমি ওই সব লেখা নিয়ে বই বের করি তখন বইয়ের কাটতি বাড়ে।
তখন প্রফিটও বাড়ে বোজলেন!’
‘ওই একই কথা। মনু তুমি ওগোরে,
কয়া দিবা, হেইডা লেখকের ছদ্মনাম, আসলে এই লেখা আপনাদের প্রিয় লেখকেরই লেখা।’
‘মনু তুমি মোরে. ফকির বানাইতে
চাও! সব বাড়ি বাড়ি যায়া যদি মোরে. কইতে হইব এইডা তুমার পেননেম মানে ছদ্মনাম, তয় আমার
কয় লাখ টাকা রিকশা ভাড়া লাগব, হেইয়া তুমি বোজো?’
‘আরে, বাবা ছদ্মনাম ব্যবহার
করা এটা বহু পুরানো রীতি।’
‘আরে. ভাই গুল্লি মারেন আপনার
পুরানা রীতির. গতবার যখন আপনের উপন্যাস ‘ধর হালারে’ হিট হইল, তখন কয়টা এডিশন হইছিল
জানেন?’
‘কয়টা?’
‘ষুল্লটা এডিশনে। কত বই বিক্রি
হইছিল জানেন, মোট এক লক্ষ বিশ হাজার কপি, ব্যবসা বোজেন ব্যবসা?
অহন হঠাৎ নাম পাল্টাইলে, ওই
নতুন নামে তিনশ কপি বই বেচতে আমার প্রকৃতিকে উত্তর দেওয়ার যন্ত্রপাতি ফাইট্টা যাইব।
তবু তিনশ কপি বই বিক্রি হইব না। তাই বলি ওই সব ছদ্মনাম-টদ্মনাম ছাড়েন, আসল নামে বই
লেখেন, কবিতা ছাপেন কার্টুন আঁকেন ব্যস।’
‘কিন্তু ভাইডি আসল নামে ছাপলে
আজকাল ঝামেলা হয়, ওই যে মনু দেখলা না, এক ব্যাডা কার্টুন আঁইক্কা কান চাপাতিতে চড় খাইয়া
জান হারাইল। ফলে পদক পাওয়া ‘টোকাই’য়ের র’নবী কার্টুন আঁকাই ছাইড়া দিল।’
‘আরে. মনু তুমি বোঝ না কেন?
তুমি স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। লক্ষ লক্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধার. জীবন দিয়ে গড়া বাংলাদেশের
সন্তান, তুমি কারে. ভয় পাও। তুমি কেন নিজের নামে লেখা ছাপতে ভয় পাবা?’
‘আরে ভাই তখন বর্বর পাকিস্তানিদের
সময়, তা ছাড়া যুদ্ধ শেষ হয়েছে ৫২ বছর আগে, ওইসব নিয়ম এখন চলে না। এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ,
আগের নিয়ম সব ফেল্।’
‘আগের নিয়ম, পরের নিয়ম ওসব আমি
বুঝি না, তুমি মনু নিজের নামে লেখা কবিতা, কার্টুন সব ছাপাবা।’
‘মনু তোমারে একটা সত্যি কথা
কই?’
‘কন গুরু কন।’
‘মনু তোমারে. কী কব দুঃখের.
কতা, তুই আইছো বিদেশ থেইক্কা, তুই মনু রাজনীতির কী বুঝবা। যদি আমি আমার আসল নামে
গল্প লিখি, কবিতা ছাপি, কার্টুন আঁকি, তাইলে একদিন আমার কান চাপাতিতে এমন চড় মারব যে,
আমি মইরা ভূত। নইলে এমন জায়গায় নিয়ে মারব যে তোরা আমার লাশও খুঁইজ্জা পাবি না। হয়তো
কোনো একদিন তুর পেরেস জ্বালাই দিব। হেইলাই মনু বিশ্বাস হর, তোগো. লাইগাই মুই ছদ্মনামে
লিখি যাতে তোগো ওপর কোনো বিপদ না নাইম্মা আসে। তুইই ক, পিরথীবিতে কে না চায় তার
নিজের নামে লেখা, তার নিজের নামে কার্টুন ছাপুক। হক্কলেই. চায় হ্য্যার ভালো কাজের প্রশংসা
হোক।
সমাজে বেবাগতে হ্যার লেখার হ্যার
কার্টুনের যথার্থ মূল্যায়ন হরুক।
কিন্তু মিজান তরে. কী কব, বড্ড
ভয় হয়, মুই যদি নিজের সত্যি নামে লিখি তাইলে কোনো দিন আর মোরে. খুঁইজা পাবা না, দ্যাখবা
মুই একদিন হারায়া গেছিগা।’
‘না না, ভাইসাব, আপনি হারায়া
গেলে মুই কার লগে সুখদুঃখের কতা কমু? মোরে কেডা শুদ্ধ সাহিত্য বটতলার সাহিত্যের ফারাক
বুজাইব? হ্যামলেটের. সলিলকির মানে কে বুজাইব? টু বি অর নট টু বি, দ্যাট ইজ দ্য কোয়েশ্চন।
নো ট্রাভেলার হ্যাজ রিটার্ন ফরম, দেয়ার...।’
‘না না গুরু আপনেরে. আমি হারাতে
চাই না, গুরু। আপনে ছদ্মনামেই গল্প লেখেন, কবিতা লেখেন, ছদ্মনামেই কার্টুন আঁকেন, গুরু।
মন চাইলে গল্প লেখা, কবিতা লেখা, কার্টুন আঁকা সব ছাইড়া দ্যান।
দরকার হইলে বাংলাদেশের সব গানবাজনা,
নাটক, গল্প, সাহিত্য সব বন্ধ কইরা. দ্যান।
আমরা ইউটিউবে ভারতীয় নাটক দেখমু,
ভারতীয় কবিতা পড়মু, ভারতীয় কার্টুন দেখমু, ভারতীয় সিনেমা দেখমু, কনসার্ট দেখতে যামু।
তবু গুরু আপনেরে হারাইতে চাই না গুরু... আপনেরে হারাতে চাই না... আপনেরে হারাতে চাই
না...’।
মিজানের. কথা শুনে আর নিজেরে ধরে রাখতে পারলেন না, আবেগের তাড়নায় মিজানকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন, গুরু ভট্টাচ্যারিয়া।