সম্পাদক
প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০:২৫ এএম
দেশের ৮৭ শতাংশ
কিশোরী হেনস্থা, মৌখিক হয়রানি এবং ইভটিজিংয়ের শিকার। তাদের ৭৩ শতাংশ পারিবারিক ও বাল্যবিবাহজনিত উদ্বেগ,
৬৬ শতাংশ মানসিক আঘাত (ডিসরাপশন), ২২ শতাংশ শারীরিক আঘাত, ৬০ শতাংশ ট্রমা, ৫৫ শতাংশ
ভয়ের অনুভূতির মধ্যে দিন কাটায়। জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার কারণে ৬৯ শতাংশ কিশোরী আত্মবিশ্বাস
হারিয়ে ফেলছে, ২৬ শতাংশ আত্মহত্যার চেষ্টা করছে।
ওপরের তথ্যগুলো
একটি গবেষণা প্রতিবেদনের; যা ১৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশ হয়েছে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ। গবেষণা
প্রতিবেদনের সূত্র ধরে যে বার্তা প্রকাশ পেয়েছে তা কোনোভাবেই সমাজের জন্য স্বস্তিদায়ক
নয়। এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনাও নয়। আজকের শিশু-কিশোর; যারা দেশের ভবিষ্যৎ চালিকাশক্তিÑতাদের
ঠিকভাবে বেড়ে ওঠার পথে যে মানসিক নির্যাতনের তথ্য উঠে এসেছে, তা পুরো সমাজেরই মাথাব্যথার
কারণ হতে বাধ্য।
এই গবেষণা যাদের
ওপর পরিচালিত হয়েছে, তাদের গড় বয়স পনেরো। অর্থাৎ তারা সবাই টিনএজার। মানবজীবনে ‘টিনএজ’
খুবই স্পর্শকাতর একটা পর্যায়। এই সময়ে একই সঙ্গে তাদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন আসে।
ফলে এ সময়ে কিশোর-কিশোরীরা নিজেকে নিয়ে সচেতন হয়। অন্যরা তাকে নিয়ে কী ভাবছে, কী বলছেÑ
তা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু তাদের এই ভাবনার জগতে যদি আঘাত আসে, তবে
তা যেমন তাদের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরায়; তেমনি তাদের বিপথেও পরিচালিত করতে পারে। এ ছাড়া
নিজেকে আঘাত করার একটা প্রবণতাও তৈরি হয় এই বয়সে। যা উঠে এসেছে এই গবেষণা প্রতিবেদনের
তথ্যেও। ২৬ শতাংশ কিশোর-কিশোরীর এ সময়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করার যে তথ্য গবেষণা প্রতিবেদনে
উঠে এসেছে, তা সেদিকেই ইঙ্গিত করে। গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে রাজধানীর মোহাম্মদপুর,
ধানমন্ডি, ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল এবং ময়মনসিংহের ভালুকায় ৭৬৮ কিশোর-কিশোরীর ওপর।
এর অর্থÑরাজধানীর আলো ঝলমলে এলাকায় যেমন, তেমনি প্রান্তিক আধো আলো-আধো ছায়ার এলাকাতেও
পারিবারিক নির্যাতনের ধরন একই। সবখানেই অভিভাবকের দৃষ্টিভঙ্গি এক। তাদের চিন্তাচেতনায়
মোটা দাগে পার্থক্য নেই। ফলে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে আইন থাকলেও, কিশোর-কিশোরীর
সুরক্ষায় দৃশ্যত অগ্রগতি নেই।
সন্তানের শারীরিক
সমস্যা নিয়ে আমরা যতটা চিন্তিত, মানসিক সমস্যা নিয়ে ততটা নই। ফলে আমাদের সন্তানদের
মানসিক সমস্যা বাড়ছে এবং ব্যক্তির সংকট তৈরি হচ্ছে। এ সংকট আরও বাড়াচ্ছে নিরাপত্তার
অজুহাতে পারিবারিকভাবে কিশোর-কিশোরীকে হেনস্থার শিকার হওয়ায়। সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের
অবিশ্বাসের জায়গা তৈরি হচ্ছে; এতেও বাড়ছে মানসিক নির্যাতন। অথচ আমরা ভুলে যাই, প্রতিনিয়ত
কারও কাজের ওপর নজরদারি চালালে তাও বিপদ ডেকে আনতে পারে। সন্তানকে অহেতুক সন্দেহ ও
তার স্বাধীনতায় অন্যায় হস্তক্ষেপ করায় তাদের মনে যে চাপ তৈরি হয়, তা থেকে মনের ভেতরে
সংশয়ের জন্ম হতে পারে। যা কিশোর-কিশোরীর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার পথেও হতে পারে অন্তরায়।
আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, শাসনের নামে আমরা কিশোর-কিশোরীদের মানসিক নির্যাতন করছি না
তো? তাদের বেড়ে ওঠার পথে, মানসিকতা গড়ে তোলার জন্য যে শুশ্রূষা প্রয়োজন; সেখানে কোনো
ফাঁক থেকে যাচ্ছে না তো?
মানসিক সমস্যা
থেকে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আচরণগত পরিবর্তন ঘটে। তারা এক্ষেত্রে যেমন নিজেকে সবকিছু
থেকে গুটিয়ে নেয়, তেমনি তাদের মধ্যে অবসাদও ভর করে। তাদের ভেতরে নেতিবাচক প্রভাব কাজ
করতে থাকে। যার কুফল সমাজের ওপরও পড়ে। অনেকক্ষেত্রেই কিশোর-কিশোরীরা এ ধরনের প্রেক্ষাপটে
অসৎসঙ্গ, অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়াসহ মাদকের ভয়াবহ থাবার গ্রাসেও আক্রান্ত হয়। তাই কিশোর-কিশোরীদের
মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মা-বাবার সচেতনতা। বাবা-মা যদি
সন্তানের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলেন; তাহলে তাদের ছোটখাটো ভুল যেমন শুধরে দেওয়া যায়,
তেমনি পথচলাও মসৃণ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে সন্তানদের মতামত প্রকাশে গুরুত্ব দিতে হবে।
তাদের সমস্যাটা বুঝিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে ভুল থেকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করতে হবে।
সন্তানের আত্মবিশ্বাস
বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখে বাবা-মায়ের ইতিবাচক মানসিকতা। বাবা-মা যদি সন্তানকে প্রয়োজনীয়
উৎসাহ দেন, তাহলে সন্তানের পক্ষে ভুল করার সুযোগ কম। নির্যাতনের মাধ্যমে নয়, মানসিক
পরিচর্যার মাধ্যমেই সন্তানকে সুপথে পরিচালিত করা সম্ভব। আমরা এই জরিপের তথ্যের ভিত্তিতে
কিশোর-কিশোরী নির্যাতন বন্ধে সচেতনতামূলক প্রচারের কথা বলি। এক্ষেত্রে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে
গণমাধ্যমগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। সমস্যাটা আমাদেরই, আমরা সচেতন হলেই সন্তানকে মানসিক
নির্যাতন থেকে মুক্ত রাখতে পারব। সন্তান সব সময় বাবা-মায়ের কাছে ভরসা চায়, আশ্রয় চায়,
তারা যেন সেই আশ্বাসটুকু থেকে বঞ্চিত না হয়Ñ তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদেরই।