× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ভূমিকম্প

সহনশীল ভবনের সঙ্গে অন্যান্য প্রস্তুতিও জরুরি

সৈয়দ হুমায়ুন আখতার

প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০:২২ এএম

আপডেট : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৫:২৯ পিএম

সৈয়দ হুমায়ুন আখতার

সৈয়দ হুমায়ুন আখতার

১৮ সেপ্টেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে গত সাড়ে পাঁচ মাসে দেশের অভ্যন্তরে মাঝারি আকারের পাঁচটি ভূকম্পনের ঘটনাকে উল্লেখ করে দেশে বড় আকারের ভূমিকম্পের আশঙ্কা করা হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরের ভূগর্ভে থাকা চ্যুতিরেখা বা ফল্টলাইনে জমে থাকা শক্তি নির্গত হওয়াতেই ভূমিকম্প হচ্ছে। কথাটি ভুল নয়। বাংলাদেশ তিনটি প্লেটের ওপর অবস্থিত। এর মধ্যে বার্মিজ ও ইন্ডিয়ান প্লেট দেশের অভ্যন্তরে থাকায় আমরা ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ বলে বহু আগে থেকেই পরিচিত। এখন পর্যন্ত বার্মিজ প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের মুখোমুখি গতির কারণেই সব ভূমিকম্প হয়েছে। এই দুটো প্লেটের সংযোগস্থলে প্রচুর পরিমাণে শক্তি জমে আছে। এই জমে থাকা শক্তি ভূগর্ভ থেকে বের হয়ে আসার পথ খুঁজছে। ফলে ঘন ঘন মাঝারি আকারের ভূমিকম্প অনুভূত হচ্ছে। অবশ্য এই প্লেটগুলোর সীমান্তবর্তী অঞ্চলে যে পরিমাণ ভূমিকম্প হয়, বাংলাদেশে সে পরিমাণ ভূমিকম্প অনুভূত হয় না। সে হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশ অতটাও ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা নয়। তবে এখানে মাঝারি আকারের ভূমিকম্প হওয়ার শঙ্কা সব সময়ই রয়েছে।

আমাদের এই অঞ্চলে সম্প্রতি মাঝারি আকারের ভূমিকম্প বাড়ছে। যেমনটা বলেছি, ভৌগোলিক অবস্থানের ভিত্তিতে এই অঞ্চলে ভূমিকম্প হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে যতটা ভূমিকম্প হওয়ার কথা, তা হয় না। পর্যাপ্ত ভূমিকম্প না হওয়াও কিন্তু বিপদের। কারণ বার্মিজ প্লেটটি এখন পুরোপুরি স্থির হয়ে আছে। এই স্থির অবস্থাকে আমরা সাবডাকশন জোন নামে চিহ্নিত করি। সাবডাকশন জোনের ওপরে যে অঞ্চলগুলো থাকে, ওই অঞ্চলে ভূমিকম্পের কারণে ভয়াবহ ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে আট মাত্রার ভূমিকম্প হয়, সেসব অঞ্চলে সাবডাকশন জোন রয়েছে। চিলি, সান ফ্রান্সিসকো, জাপান ইত্যাদি অঞ্চল সাবডাকশন জোনের অধীনে। একই ধরনের ভূতাত্ত্বিক গঠন বাংলাদেশেও দেখা যায়। ইন্ডিয়ান প্লেট ও বার্মিজ প্লেট আস্তে আস্তে তলিয়ে যাচ্ছে। বার্মিজ প্লেটটি সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, হাওড়াঞ্চল থেকে মেঘনা নদী পেরিয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চল পর্যন্ত অবস্থিত। একটি প্লেটের নিচে আরেকটি প্লেট যেখানে তলিয়ে যায় সে জায়গাটিকেই বলা হয় সাবডাকশন জোন। অর্থাৎ ভূমিকম্প হওয়ার সব উপাদানই এ অঞ্চলে বিদ্যমান। তবে স্বস্তির কথা, প্রাকৃতিকভাবে এ অঞ্চলে যত ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছেÑ তা এখনও হয়নি।

দুটো প্লেটের মধ্যে সংঘর্ষ না হয়ে যদি একটি প্লেটের ওপর আরেকটি প্লেট আটকে থাকে, তাহলে ভূগর্ভে ঘর্ষণশক্তি জমা হতে শুরু করে। প্রচুর ঘর্ষণশক্তি জমা হলেও এসব ক্ষেত্রে ভূমিকম্প হয় না। কারণ সাবডাকশন জোনে দুই প্লেটের মধ্যকার ঘর্ষণবল অনেক বেশি থাকে। সাবডাকশন জোন থেকে বড় আকারের শক্তি ভূপৃষ্ঠে বের হওয়ার লক্ষণ সাম্প্রতিক সময়ে মাঝারি আকারে ঘন ঘন কয়েকটি ভূমিকম্পের মাধ্যমে আমরা দেখতে পাচ্ছি। তবে আজ হোক কাল হোক, এই শক্তি নির্গত হবেই। প্রাকৃতিকভাবে এর কোনো বিকল্প নেই। সাবডাকশন জোন থেকে ঢাকা ১২০ কিলোমিটার দূরবর্তী হওয়ার পরও বড় মাত্রার ভূমিকম্পে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি। এলাকাভেদে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাইশ হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার মানুষ বসবাস করে। শুধু জনসংখ্যার ঘনত্বই নয়, এখানে জনসংখ্যার পাশাপাশি ভবনের ঘনত্বও বেশি। ঔপনিবেশিক আমল, পাকিস্তান আমল থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিভিন্ন কায়দায় বা স্থাপত্যকৌশল অবলম্বন করে ভবন নির্মিত হয়েছে। সম্প্রতি যদিও বিল্ডিং কোড অনুসারে নতুন ভবন তৈরি হচ্ছে; তবে ঢাকার অধিকাংশ ভবনই পুরোনো। এ কথাও সত্য, নতুন ও পুরোনো দুই ধরনের ভবনের ক্ষেত্রেই গঠনগত ত্রুটি রয়েছে। অনেক ভবন সফট স্টোরিড। এ ধরনের ভবনে নিজের জায়গাটুকু উন্মুক্ত রাখা হয়, যেন গাড়ি রাখা যায়। ভূমিকম্প হওয়ার সময় ভবন যখন দুলবে তখন ওই জায়গার পিলারগুলোর ওপর বেশি চাপ পড়বে। ফলে ভবন ধসে পড়ার শঙ্কাও অনেক বেশি থাকে এ ধরনের ভবনে।

নগরবাসীর মধ্যে ভূমিকম্প সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব রয়েছে। ফলে এরকম দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে মানবিক ক্ষয়ক্ষতি বেশি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। ভূমিকম্পের প্রস্তুতি কীভাবে নিতে হয়Ñ এ ব্যাপারে আমাদের সঠিক ধারণা একেবারেই নেই। অবশ্য ধারণা থাকলেও ক্ষয়ক্ষতি একেবারে কমে যাবে তা নয়। কারণ রাজধানী ঢাকায় ভূমিকম্পের সময় আশ্রয় নেওয়ার মতো খোলা জায়গার অভাব রয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের প্রস্তুতি রয়েছেÑ এ কথাও জোর দিয়ে বলা যাবে না। সরকার যদিও ভূমিকম্প নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কথা বলে। কিন্তু বাস্তবে সরকারের প্রস্তুতি রয়েছে ভূমিকম্প পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে। কিন্তু পূর্বপ্রস্তুতি সে অর্থে নেই। ভূমিকম্পের পর উদ্ধারকার্যের জন্য আমাদের আংশিক সক্ষমতা রয়েছে। অর্থাৎ ভূমিকম্প হলে ‘অপরিকল্পিত নগরায়ণের’ কারণে মানবিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হবে বেশি। সমস্যা হলো, অপরিকল্পিত নগরায়ণের বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনা হয় এবং সমাধান নিয়েও নানা পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু বিষয়টি রাতারাতি সমাধান সম্ভব নয়। আজকে আমরা যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছি, তাতে আগামী একশ বছরেও অপরিকল্পিত নগরায়ণের বিষয়টির সমাধান সম্ভব হবে না। এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই আমাদের নগরে বসবাস করতে হবে।

প্রশ্ন হচ্ছেÑ নগরাঞ্চলে অপরিকল্পনা ও নির্মাণত্রুটিই যদি বাস্তবতা হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের করণীয় কী রয়েছে? অবস্থা যতই মন্দ হোক, সব সময়ই কিছু না কিছু করণীয় থাকে। যেমনটি বলেছি, অপরিকল্পিত নগরায়ণের মাঝেই আমাদের বসবাস করতে হবে। আর নগরে বসবাসের সময় আমাদের কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হবে; যাতে মানবিক ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা হলেও কমিয়ে আনা সম্ভব হয়। অর্থাৎ এই সংকটের মধ্যেও কৌশলগত প্রস্তুতি আমাদের কিছুটা হলেও আশার আলো দেখায়। এক্ষেত্রে প্রথমত, ভূমিকম্পের সময় নিরাপদ আশ্রয় কোথায় রয়েছে সে বিষয়ে আগে থেকেই সচেতন হতে হবে। আর ভূমিকম্পের সময় নিরাপদ আশ্রয় কোথায় রয়েছে তাও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার করতে হবে। ব্যক্তি ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। ব্যক্তি ও সামাজিক পর্যায়ে কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া যেতে পারেÑ সে বিষয়ে জনমত গঠন করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে বিষয়টি এখন আরও সহজ হয়ে গিয়েছে। জনমত গঠনের বিষয়টির জন্য শুধু নীতিনির্ধারকদের ওপর নির্ভর করলে হবে না। ভূমিকম্প হলে ভবনের কোন স্থানগুলো নিরাপদ জায়গা; সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নিয়ে ব্যক্তিপর্যায়ে আমাদের সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে হবে। সরকার এক্ষেত্রে বছরব্যাপী বিভিন্ন ড্রিলের ব্যবস্থা নিতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে প্রথমে ড্রিল পরিচালনা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্প-কারখানা হতে পারে ভালো জায়গা। কর্মক্ষেত্র থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রত্যেকেই তাহলে পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে পারবে। ওয়ার্ডভিত্তিক মহড়া অনুশীলন ধারাবাহিকভাবে চালু করা গেলে ভূমিকম্পের মানসিক প্রস্তুতি সবার মধ্যে গড়ে উঠবে। তখন ভূমিকম্প হলেও কেউ আতঙ্কগ্রস্ত হবে না।

সম্প্রতি তুরস্ক ও মরক্কোর ভূমিকম্পে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি সারা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। আমরাও বড় মাত্রার ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কায় রয়েছি। আমাদের বিল্ডিং কোডে বলা হয়েছে, ভবন নির্মাণের সময় যেন এমনভাবে করা হয় যাতে সাত মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল হয়। নতুন ভবনগুলো তাই বড় ভূমিকম্প সহনশীল, এমনটি ভেবে কিন্তু আত্মতুষ্টির কোনো অবকাশ নেই। কারণ ভবনের ভূমিকম্প সহনশীলতাই শেষ কথা নয়। ভূমিকম্পের মানসিক প্রস্তুতি গড়ে তোলা না গেলে মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়েই মারা যাবে। তা ছাড়া ভূমিকম্পের সময় দুলুনিতে ভবনের ভেতরের আসবাব স্থানবিচ্যুত হয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনার শঙ্কাও রয়েছে। আমাদের সামাজিক জীবনে বিভিন্ন আসবাব ব্যবহার করতে হয়। আসবাবপত্র যদি দেয়ালের সঙ্গে ভালোভাবে আটকানোর ব্যবস্থা নেওয়া না যায়, তাহলে ভূমিকম্পে দুলুনির সময় তা ছিটকে যেতে পারে বা মানুষের ওপর পড়ে যেতে পারে। লোহা ও কাঠের আসবাবের নিচে কেউ চাপা পড়লে মানবিক ক্ষতি বাড়বে বৈ কমবে না। তাই ভূমিকম্পে ভবনই প্রধান বিষয় নয়। ভূমিকম্পের মোকাবিলায় প্রস্তুতিই আসল।

  • ভূতত্ত্ববিদ ও উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি)
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা