সম্পাদকীয়
সম্পাদক
প্রকাশ : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৪:২৯ পিএম
‘আবারও সিন্ডিকেটের থাবায় মুরগির বাচ্চা’ শিরোনামে প্রতিদিনের বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, ‘এক দিন বয়সি মুরগির বাচ্চার দাম বাড়িয়েছে করপোরেট কোম্পানিগুলো’। মধ্য আগস্ট থেকে চলতি সেপ্টেম্বর মাসের বিভিন্ন সময়ে পর্যায়ক্রমে কোম্পানিগুলো ব্রয়লার, লেয়ার ও সোনালি মুরগির বাচ্চার দাম বাড়িয়েছে ১০ থেকে ২৪ টাকা। এই সামান্য সময়ের মধ্যে কী এমন ঘটলÑ যাতে বাচ্চাপ্রতি এত দাম বাড়াতে হলো? বাজারে মুরগি বা ডিমের সরবরাহ ঘাটতি রয়েছেÑ এমন খবর কিন্তু এই মুহূর্তে সংবাদমাধ্যমে নেই। তাহলে কেন এই দাম বাড়ানো? এর উত্তর খুঁজেছেন প্রতিদিনের বাংলাদেশের প্রতিবেদক। দাম বাড়ার কারণ সম্পর্কে মুরগির বাচ্চা উৎপাদক প্রতিষ্ঠান প্যারাগন গ্রুপের একজন সহকারী আঞ্চলিক কর্মকর্তা প্রতিবেদককে বলেছেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমাকে এসএমএস দিয়ে দাম জানান। আমি ব্যবসায়ীদের সেই দাম জানিয়ে দিই। দাম কেন বাড়ল, সে সম্পর্কে কিছু বলতে পারব না।’ একই কথা বলেছেন মুরগির বাচ্চা উৎপাদক প্রতিষ্ঠান সি পি বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেডের একজন সেকশন ম্যানেজারও। তিনিও দাম বাড়ার ‘প্রকৃত কারণ’ জানেন না। অথচ অভিযোগ উঠেছে ‘অজানা কারণে’ দাম বাড়ানোর মাধ্যমে প্রতিদিন বাজার থেকে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে ৬ কোটি ৫০ লাখ টাকারও বেশি।
প্রাণিজ আমিষের চাহিদা মেটাচ্ছে দেশের পোল্ট্রি শিল্প। কিন্তু করপোরেট
প্রতিষ্ঠান ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে একদিকে প্রান্তিক খামারিরা ব্যবসা গুটিয়ে
নিতে বাধ্য হচ্ছেন, অন্যদিকে প্রাণিজ আমিষে টান পড়ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের পাতে। করপোরেট
প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন; তেমনি মধ্যস্বত্বভোগীরাও আজ ইচ্ছামাফিক বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।
পণ্য যখন কৃষক বা খামারির কাছে থাকে, তখন তারা দাম কমিয়ে দেয়। আর পণ্য কৃষক ও খামারির
হাতছাড়া হলেই তারা নিজেদের খেয়ালখুশিমতো দাম বাড়ায়। সহযোগী সংবাদপত্রগুলোর প্রতিবেদন
বলছে, ভোক্তা অধিদপ্তরের সদস্যরা বাজার পরিদর্শনে গেলেই ব্যবসায়ীরা তড়িঘড়ি দোকান বন্ধ
করে সটকে পড়ছেন। বন্ধ করার সময় না পেলে কেউ কেউ ত্রিপল দিয়ে কোনোরকমে দোকান ঢেকে রেখে
পালাচ্ছেন। এর অর্থ অসৎ ব্যবসায়ীরা তাদের অপকর্ম ঢাকতে চাইছেন। তারা সহযোগিতার পরিবর্তে
লুকিয়ে থেকে সমস্যা জিইয়ে রাখতে চাইছেন। সরকারকে বিব্রত করতে চাইছেন। এই সিন্ডিকেট
ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে সাধারণের জেরবার অবস্থা। আক্ষরিক অর্থেই নাভিশ্বাস
উঠেছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের। সম্প্রতি আলুর বাজারেও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য
স্পষ্ট হয়েছে। সামান্য একটি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে একজন মধ্যস্বত্বভোগী একটি মৌসুমে
হাতিয়ে নিচ্ছে কয়েক কোটি টাকা। উৎপাদন মৌসুমে কৃষকের থেকে মধ্যস্বত্বভোগীরা আলু সংগ্রহ
করেছে ১২-১৫ টাকা কেজি দরে। সেই আলু কোল্ডস্টোরেজে রাখার খরচ এক মৌসুমে বস্তাপ্রতি
৫ টাকা। সব মিলিয়ে মাত্র চার-পাঁচ টাকা খরচের পর এই মধ্যস্বত্বভোগীরাই নির্ধারণ করছে
কত লাভে তারা পণ্যটি বিক্রি করবে। কোল্ডস্টোরেজ থেকে তারা আলু বিক্রি করছে প্রতি কেজি
৩৬ থেকে ৩৮ টাকা দরে। অর্থাৎ একজন মধ্যস্বত্বভোগী কোনো পরিশ্রম ছাড়াই শুধু একটি মোবাইল
ফোনের মাধ্যমে যেমন বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, তেমনি এক কেজি আলুতে লাভ করছে ১৮-২০ টাকা।
কৃষক আর ভোক্তার দুপক্ষের ক্ষতির মাঝে পোয়াবারো হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের। একই অবস্থা
আজ বাজারের সব পণ্যে। বড় কিছু প্রতিষ্ঠানের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে দেশের বাজারব্যবস্থা।
আমরা তাই ভোক্তাপর্যায়ে নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি বড় ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের
একচেটিয়া প্রাধান্যও ভাঙার জন্য বলি। বাজার ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্য আনতে বলি। সম্প্রতি
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে আলু, ডিমসহ কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে। উৎপাদন
খরচের সঙ্গে মিলিয়ে পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়ার উদ্যোগ ইতিবাচক। তবে এক্ষেত্রে শুধু দাম
নির্ধারণ করে দেওয়াই শেষ কথা নয়, সেই দাম যেন খুচরা বাজারে কার্যকর হয়Ñ সেই দিকটিও
নিশ্চিত করতে হবে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে চার কোটি ডিম আমদানির অনুমোদন দিয়েছে বাণিজ্য
মন্ত্রণালয়। উদ্যোগটিকে স্বাগত জানানো হলেও আমরা মনে করি প্রাণিজ আমিষ উৎপাদনে আমাদের
সক্ষমতা রয়েছে। তাই দেশীয় উৎপাদকদের অগ্রধিকার দেওয়ার জন্য যেমন বলি; তেমনি সেই সুযোগকে
কেউ যদি দুর্বলতা ভেবে অপব্যবহার করার পথ খোঁজে তাও ভেঙে দিতে বলি। আমরা একটি স্বাভাবিক
বাজার চাই। যেখানে যৌক্তিক মুনাফার মাধ্যমে ব্যবসায়ী ব্যবসা করবেন। ভোক্তাও পণ্য কিনবেন
ন্যায্যমূল্য দিয়ে।