রাজনৈতিক সংস্কৃতি
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৪:২৭ পিএম
আগামী জাতীয় সংসদ
নির্বাচন নিয়ে ও বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে দেশে-বিদেশে যে নানামুখী
অপতৎপরতা রয়েছে এর নিরসন খুব দূরে নয়। কারণ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার প্রতিফলন পুনর্বার ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন কয়েকদিন আগে
অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে। দেশ-বিদেশের সংবাদমাধ্যমে তার রাজনৈতিক-কূটনৈতিক দূরদর্শিতার
ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নানাভাবে হয়েছে। বিশ্লেষকরা সামগ্রিকভাবে এই বিষয়গুলোকে ইতিবাচক
দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করেছেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর
বাংলাদেশ সফর এরই বর্ধিত সংস্করণ বলা যায়। সামগ্রিক দিক পর্যালোচনায় এটি সুস্পষ্ট,
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি
সর্বত্রই সমাদৃত। স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ধারার ক্রমাগত পরিক্রমায় দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি-জনগণের
ভাগ্য পরিবর্তনে কর্মকৌশলের প্রাধান্যই প্রণিধানযোগ্য। বিরোধীদের নানা অপপ্রচার প্রতিহত
করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে ভোটারদের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ
থাকার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ নেই।
বৈশ্বিক যুদ্ধের
প্রেক্ষাপটে জ্বালানি-খাদ্য-আমদানি-রপ্তানি-ডলার-রেমিট্যান্স সংকট-দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি,
জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানামুখী জনদুর্ভোগের বিপরীতে অদম্য অগ্রগতিতে এগিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশকে
বিশ্ব সম্প্রদায় সম্মানজনকভাবে বিবেচনা করছে। সবকিছু মিলিয়ে আগামী দিনের সরকার প্রতিষ্ঠায়
দেশের মানুষ অতিশয় প্রাণিত ও সচেতন মনোভাবে পরিপুষ্ট।
খ্যাতিমান সমাজবিজ্ঞানী
লুসিয়ান-পাই রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যাখ্যায় বলেছেন, কোনো জাতিরাষ্ট্রে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি-বিশ্বাস-আদর্শিক
মনোভাবের সমষ্টিগত প্রক্রিয়ায় শৃঙ্খলাবদ্ধ আচরণের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা-বিধিবিধান ও নীতি-নৈতিকতার
সমাহার রাজনীতির মৌলিক ভিত্তি তৈরি করে। মূলত রাজনৈতিক সংস্কৃতির মূল উপাদান হচ্ছে
কোনো দেশে বিরাজিত রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রতি নাগরিকদের সনাতন মূল্যবোধ-অনুভূতি
এবং আস্থার সামগ্রিক প্রতিচ্ছবি।
মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী
গ্যাব্রিয়েল অ্যালমন্ড সর্বপ্রথম রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রত্যয়টি ব্যবহার করেন। তার মতে,
রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো রাজনৈতিক ব্যবস্থার সদস্যদের রাজনীতি সম্পর্কে মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির
রূপ ও প্রতিকৃতি। কোনো একটি দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার গতিপ্রকৃতির প্রবহমানতায় সে
দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি উদ্ভাসিত। রাজনীতি নিয়ে সমাজের চিন্তাচেতনা-ধ্যানধারণা, রাজনৈতিক
মূল্যবোধ-বিশ্বাস-মতাদর্শ, জ্ঞানগত কার্যকলাপ-আগ্রহের পরিমাপ-মূল্যায়নমূলক অভিযোজনে
নির্ধারিত হয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাবলীল উত্তরণ। যেকোনো জাতিরাষ্ট্রের উন্মেষ ও চলমান
প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান-সমাজের সার্বিক চিত্রপট মানবকল্যাণের জটিল মিথস্ক্রিয়ায়
নির্মিত হয় রাজনৈতিক রীতিনীতির পাঠ্যক্রম। আদর্শিক ভিন্নতায় বিরোধ-বিচ্ছেদ, অশুভ প্রতিযোগিতা
প্রতিহত করে সংগত-সংযত সমাজস্বীকৃত আচরণবিধির অনুশীলন-জনমনজয়ী চরিত্র গঠনের মাধ্যমে
দেশ ও দেশবাসীকে উপকৃত করার ইস্পাতকঠিন ব্রত গ্রহণের মধ্যেই নেতৃত্বের পরিশীলিত গ্রহণযোগ্য
বিকাশ। উল্লেখিত বিষয়গুলো বা ঐতিহ্য-শিক্ষা-অভিজ্ঞতা ও সৃজনশীলতার দৃশ্যমান অবগাহনে
রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৃঢ়তা নির্ভর করে। গণতন্ত্রের বিকাশমানতায় বহু দলের অস্তিত্ব থাকা
যেমন জরুরি, তেমনি দল-নেতাকর্মীদের আচার-আচরণে পারস্পরিক আস্থা-বিশ্বাস-যোগাযোগ প্রভৃতির
প্রচলন একান্ত বাঞ্ছনীয়। দলগুলোর মধ্যে নানান বিষয়ে ভিন্নমত থাকাটা স্বাভাবিক হলেও
এ মতভিন্নতা পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে দূর করা সম্ভব;
যেটি সর্বজনের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্যও হতে পারে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, কালক্রমে
গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির অধিকতর নিকৃষ্ট প্রচলন সমাজকে নিদারুণ কাতরতায় নিপতিত
করছে। প্রতিনিয়ত পারস্পরিক দোষারোপ এবং প্রতিটি দলে অনুপ্রবেশকারীদের অযাচিত আগ্রহের
অতিমাত্রিকতা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। ঘরের শত্রু বিভীষণ দুর্নীতিবাজ-লোভী-ক্ষমতাপ্রত্যাশীদের
একে অন্যের প্রতি বিভিন্ন কদাচার-কুৎসিত মন্তব্য ছুড়তে দেখা যাচ্ছে। এতে রাজনৈতিক অঙ্গনে
মৌলবাদীদের উত্থান ঘটার পথ প্রশস্ত হচ্ছে।
দ্বাদশ জাতীয়
সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিরোধীদের শক্তিমত্তা প্রদর্শনে আন্দোলনের
নতুন নতুন ইস্যু তৈরি ও জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর নানা অপকৌশল গ্রহণ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য
নয়। আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকারের নামে আন্দোলন করতে গিয়ে জ্বালাও-পোড়াওয়ের
পাশাপাশি নানা ধরনের মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে প্রশ্নবিদ্ধ
করে। আমরা কোনোভাবেই এর পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারায় ভিন্নমত
কিংবা বিরোধিতা স্বীকৃত কিন্তু কোনোভাবেই দেশ-জাতির স্বার্থে আঘাত হানে এমনটি গ্রহণীয়
হতে পারে না। সংবিধান অনুসারে নির্বাচনের নিয়ামক শক্তি নির্বাচন কমিশন প্রশ্নমুক্তভাবে
নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে এই প্রত্যাশা আমরা সঙ্গতই রাখি। সম্প্রতি প্রধান
নির্বাচন কমিশনার এক আলোচনা অনুষ্ঠানে এই প্রত্যয় আবার ব্যক্ত করেছেন। আমরা তার এই
প্রত্যয়কে সাধুবাদ জানাই এবং এ প্রত্যাশাও রাখি, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে
সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ আন্তরিকতার পরিচয় দিতেও সক্ষম হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরিলক্ষিত
হচ্ছে, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের নামে এমন কিছু প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করা হচ্ছে যার ফলে
গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অভিঘাত লাগছে এবং রাজনীতি শ্রী হারাচ্ছে।
সরকারের ধারাবাহিকতায়
বিশ্বপরিমণ্ডলে যখন উন্নয়ন-অগ্রগতিতে দেশ রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত, এগিয়ে নেওয়ার এই
পথ কণ্টকাকীর্ণ করার যে অপপ্রয়াস চলছে তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা দেখছি, বাংলাদেশের
অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশিরা কখনও কখনও অযাচিত হস্তক্ষেপ করতে চান। এমন যেকোনো কর্মকাণ্ড
নিশ্চয়ই কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এবং
বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করার লক্ষ্যে দেশ-বিদেশের নানা মহলের অব্যাহত
অপপ্রয়াসের দায় রাজনীতিকরা এড়াতে পারেন না। যেকোনো বিরোধী দলের সরকারের যেকোনো কাজের
সমালোচনা করার অধিকার গণতন্ত্রে স্বীকৃত। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের কাছে দ্বারস্থ
হওয়া দেশের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার শামিল। এ রকম নেতিবাচক কর্মকাণ্ড রাজনৈতিক
সংস্কৃতিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। আমাদের রাজনীতির অর্জন কম নয়। স্বাধীনতার পূর্বাপর তো
বটেই, মুক্তিযুদ্ধের মতো মহান অধ্যায়ের মাধ্যমে অর্জিত এই বাংলাদেশ নিশ্চয়ই রাজনৈতিক
অর্জন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব ও ডাকে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের
মাধ্যমে যে রক্তস্নাত বাংলাদেশ আমরা অর্জন করেছি একাত্তরে সেই বাংলাদেশ বায়ান্ন বছর
পর আজ অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। টানা তিন মেয়াদের ধারাবাহিক এই সরকারের এক্ষেত্রে অবদান
অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই।
দেশের একজন বিশিষ্ট
ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক উত্থাপিত একাধিক আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতির
মামলা-অভিযোগ দেশের প্রচলিত আইনে যথাযথভাবে চলমান থাকলেও বিচারিক কার্যক্রম তাৎক্ষণিকভাবে
স্থগিতের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর খোলা চিঠি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া
যায় না। কারণ আইনি ব্যাপারে যা কিছু সিদ্ধান্ত হওয়ার তা আইনানুগ পথেই হবে, এটাই স্বাভাবিক
প্রত্যাশা এবং সঙ্গত। ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩-এ এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন দেশের প্রথিতযশা
সম্মানিত ৫০ জন বিশিষ্ট সম্পাদক। এক যৌথ বিবৃতিতে তারা ওই চিঠিকে বাংলাদেশের স্বাধীন
বিচারব্যবস্থার ওপর হস্তক্ষেপ বলে অভিহিত করেন। ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ দেশের ১৭১ জন বিশিষ্ট
নাগরিক-বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবীও প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে দেওয়া খোলা চিঠিতে বিচারপ্রক্রিয়া
স্থগিতের দাবি বাংলাদেশের স্বাধীন বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপের শামিল। প্রধানমন্ত্রী
জননেত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত নির্ভীক-সাহসিকতায় কথিত বিশ্বনেতাদের বিচারিক কার্যক্রম
নিয়ে অস্বস্তি বা অবিশ্বাসের বেড়াজাল অতুচ্ছ করে কোনো অন্যায় বা অসামঞ্জস্য থাকলে বিশেষজ্ঞ
ও আইনজীবী পাঠিয়ে সব দলিল-দস্তাবেজ খতিয়ে দেখার জন্য বিবৃতিদাতাদের উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ
ছুড়ে দিয়েছেন।
স্বাধীনতা অর্জনের কিছুকাল যেতে না যেতেই দেশি-বিদেশি কুচক্রীরা বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং পঁচাত্তরের মর্মান্তিক অধ্যায় এ থেকেই সৃষ্ট এমনটি বললে ভুল হবে না। সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে এই ধারণাটুকু সুদৃঢ় যে অতীতের মতো বাংলাদেশকে নিয়ে দেশি-বিদেশি নানা চক্র ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আমরা বিস্ময়করভাবে লক্ষ করছি, কোনো কোনো দেশের সরকার ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা সেই পুরোনো কায়দায় আবারও আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে খুব বেশি অপতৎপর হয়ে উঠেছে। কিন্তু তাদের একটা কথা মনে রাখা উচিত, আজ থেকে তিন চার দশক আগের বাংলাদেশ এবং বর্তমান বাংলাদেশ এক নয়। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি উন্নয়ন-অগ্রগতির রোল মডেল বাংলাদেশ বা বর্তমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশ্বপরিমণ্ডলে বাংলাদেশ যথার্থ অর্থে প্রমাণ করেছে; বাংলাদেশ সব অন্ধকারের শক্তিকে পরাভূত করে নিজেই অনবদ্য দৃষ্টান্তরূপে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। সচেতন ব্যক্তিদের গণতন্ত্রের শত্রু-মিত্র চিনে নিতে ভুল করলে চলবে না। দেশের মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি যে সচেতন এ আর নতুন করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দাবি রাখে না। রাজনীতিতে বিরোধিতা থাকবে। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারকদের দলের কিংবা নিজেদের হীনস্বার্থ হাসিলের জন্য এমন কিছু করা উচিত হবে না যা দেশ-জাতির জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। আজকের বাংলাদেশের যে পরিচিতি বিশ্বপরিমণ্ডলে নতুনভাবে উপস্থাপিত হয়েছে এর কৃতিত্বের জন্য সরকারকে তার প্রাপ্যটুকু আমাদের দেওয়া উচিত।