সম্পাদক
প্রকাশ : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০:৩২ এএম
কক্সবাজারের রামু উপজেলার ঈদঘরের গহিন পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র
তৈরির কারখানার সন্ধান পেয়েছে র্যাব। ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র, গুলি ও বিভিন্ন সরঞ্জামসহ
সংঘবদ্ধ চক্রের একজনকে গ্রেপ্তার করেছেন র্যাবের সদস্যরা। ১৬ সেপ্টেম্বর প্রতিদিনের
বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অস্ত্রগুলো কক্সবাজার শহর এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ
আশপাশের এলাকায় অপরাধী চক্রের কাছে সরবরাহ করা হতো। আমাদের স্মরণে আছে, ইতঃপূর্বে কক্সবাজারের
উখিয়ার কুতুপালং এলাকায় অস্ত্র তৈরির কারখানার সন্ধান পেয়েছিল র্যাব। পার্বত্য চট্টগ্রামের
জেলাগুলোর বিভিন্ন পাহাড়ের গহিনে সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের আস্তানার সন্ধান এর আগেও কয়েকবার
মিলেছে। র্যাবসহ অন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারি সত্ত্বেও সন্ত্রাসীদের
অপতৎপরতা আমাদের উদ্বিগ্ন করে। মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার দুর্গম পাহাড়সহ দেশের বিভিন্ন
এলাকার পাহাড়ে সন্ত্রাসীরা আস্তানা গড়ে তোলার খবর এর আগেও সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে।
আমরা জানি, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে অবৈধ অস্ত্রের অনুপ্রবেশ
ঘটছে এবং আশ্রিত রোহিঙ্গাদের উগ্রবাদী গ্রুপগুলোর মধ্যে অস্ত্রের ব্যবহারে ইতোমধ্যে
হতাহতের ঘটনাও কম ঘটেনি। কঠোর নজরদারি এড়িয়ে, নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেদ করে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে
অস্ত্র ও মাদকের অনুপ্রবেশ নিঃসন্দেহে উৎকণ্ঠার কারণ। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে
‘আধিপত্য বিস্তার’ নিয়ে দ্বন্দ্ব সংঘাতে হরহামেশা আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ওই এলাকা
তো বটেই, সামগ্রিকভাবে দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের
জেলাগুলোর পাহাড় তো আছেই এর সঙ্গে সম্প্রতি কক্সবাজারের গহিন পাহাড়ে সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতার
উৎস সন্ধানে নজরদারি আরও কঠোর করার বিকল্প নেই। কক্সবাজারের গহিন পাহাড়ে অপহরণকারী
চক্রের আস্তানায় র্যাব ও পুলিশ সদস্যদের অভিযান চালিয়ে অর্ধগলিত তিনজনের মরদেহ উদ্ধারের
ঘটনা দূর অতীতের নয়। পাহাড়ের আঁধারে সন্ত্রাসীদের স্থান পরিবর্তন করার ফলে আইনশৃঙ্খলা
রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পক্ষে অনেকক্ষেত্রেই ত্বরিৎ ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
তারপরও র্যাবসহ অন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের গোয়েন্দা নজরদারির সূত্র
ধরে পরিচালিত অভিযানের সাফল্য সাধুবাদযোগ্য।
সমতল ও পাহাড়ের স্থানভেদে সন্ত্রাসীদের পাকড়াওয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী
বাহিনীর সদস্যদের অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে সংগত কারণেই কৌশলের নতুন নতুন ছক তৈরি
করতে হয়। কারণ সমতলে অভিযান পরিচালনা করা যতটা সহজ, পাহাড়ে তা ততটাই কঠিন। ভৌগোলিক
কারণে চট্টগ্রামের কক্সবাজার ও পার্বত্য জেলাগুলো এমনিতে স্পর্শকাতর। এই জেলাগুলোর
পাশে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত রয়েছে। একদিকে দুর্গম পাহাড়ের অন্ধকারাচ্ছন্ন
পথ, অন্যদিকে জলপথ। সুযোগ বুঝে সন্ত্রাসীরা অপরাধ সংঘটনে দুই পথই অবলম্বন করে থাকে।
কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোর পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা অপহরণ, ডাকাতি, খুনখারাবিসহ
অস্ত্র ও মাদক কারবারে জড়িতÑ এরকম তথ্য সংবাদমাধ্যমে ইতঃপূর্বে বহুবার উঠে এসেছে। অভিযোগ
আছে, ওই পাহাড়ি এলাকায় কিংবা আশপাশের সমতলের সন্ত্রাসীরা দিনে ছদ্মবেশে লোকালয়ে রেকি
করে এবং পরে অপহরণের ছক কষতে থাকে। পাহাড়কেন্দ্রিক অপহরণ ও মুক্তিপণ দাবির ঘটনায় মামলার
সংখ্যাও কম নয়।
জঙ্গি-উগ্রবাদীরাও পাহাড়ের আড়ালকেই বেছে নিতে এখন অধিকতর সক্রিয়।
বিগত কয়েক মাসের ঘটনা সাক্ষ্য দেয়, তারা এখন সমতল ছেড়ে বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় সংগঠিত
হচ্ছে এবং গড়ে তুলছে অস্ত্র কারখানা। বান্দরবানে সেনাসদস্যদের ওপর সন্ত্রাসীদের হামলায়
হতাহতের মর্মান্তিক ঘটনাও খুব দূর অতীতের নয়। কক্সবাজারসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোর
পাহাড়ে একের পর এক সংঘটিত ঘটনায় প্রতীয়মান হয়, পাহাড়ি এলাকা যেন সন্ত্রাসী কিংবা সমাজবিরোধীদের
চারণভূমি হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সক্রিয়তাও লক্ষ
করা যাচ্ছে এবং এও অভিযোগ আছে, তাদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়িয়ে সন্ত্রাসীরা
ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে সমাজবিরোধী নানারকম দুষ্কর্ম চালানোর পাশাপাশি মানুষ হত্যার
ঘটনাও অবাধে ঘটিয়ে চলেছে। কক্সবাজারের টেকনাফসহ আশপাশের এলাকায় রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রিত
রোহিঙ্গাদের অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড ও স্থানীয় সন্ত্রাসীদের কারণে জননিরাপত্তা প্রশ্নের
মুখে পড়েছে। পাহাড়ে অস্ত্র কারখানা এবং সন্ত্রাসী-জঙ্গি আস্তানা নির্মূলে বহুমাত্রিক
পদক্ষপ নেওয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। গোয়েন্দা নজরদারি আরও বাড়ানোর পাশাপাশি লাগাতার
সাঁড়াশি অভিযান চালানোর ব্যাপারে আমরা গুরুত্ব দিই। একই সঙ্গে জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে
প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচির পাশাপাশি অশুভ শক্তির মোকাবিলায় জনগণকে সম্পৃক্ত করাও
প্রয়োজন। জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাফল্য প্রশংসাসূচক
বটে, কিন্তু তাতে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো অবকাশ নেই। আমরা এও মনে করি, সন্ত্রাসীদের
মূলোৎপাটন করতে হলে সর্বাগ্রে তাদের অর্থের উৎসপ্রবাহ সূত্রের অনুসন্ধানের পাশাপাশি
তাদের পৃষ্ঠপোষকদের চিহ্নিত করা জরুরি। কঠোর দমন-অভিযান, গ্রেপ্তার-বিচার ও অপরাধীদের
শাস্তি প্রদান ইত্যাদি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে, কিন্তু এর পাশাপাশি সামাজিক প্রতিরোধ
শক্তিশালীকরণের ব্যাপারেও জোরদার পদক্ষেপ নিতে হবে।