মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য
আবু আহমেদ
প্রকাশ : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০:২৬ এএম
আবু আহমেদ
কাগজপত্রে নানা বিষয়ে আমাদের নিয়ম কিংবা নীতিমালার কোনো ঘাটতি
নেই, কিন্তু এসবের বাস্তবায়নে ঘাটতি কত ব্যাপক এর একটি মাত্র উদাহরণ বিদ্যমান বাজারচিত্র।
১১ সেপ্টেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশসহ অন্য সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, খাদ্য মূল্যস্ফীতি
সাড়ে ১১ বছরের মধ্যে গেল আগস্টে ছিল সর্বোচ্চ। খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ায় দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি
হঠাৎ অনেক বেড়ে গেছে। আগস্টে সার্বিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয় ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। গ্রাম
ও শহরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন ১২ শতাংশের বেশি। শহরের চেয়ে গ্রামে এর চাপ আরও বেশি।
শহরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হবে এমনটাই স্বাভাবিক। শহরের মানুষ ভোক্তা। প্রশ্ন হচ্ছে, গ্রামাঞ্চলে
খাদ্য মূল্যস্ফীতি কেন হবে? কারণ গ্রামীণ সমাজব্যবস্থা কৃষি বা উৎপাদননির্ভর। গ্রামের
মানুষ একই সঙ্গে ভোক্তা ও উৎপাদক। সেজন্য সেখানে মূল্যস্ফীতি ভয়াবহ আকার ধারণ করা অর্থনীতির
জন্য উদ্বেগজনক। চলতি অর্থবছরের বাজেট পেশকালে অর্থমন্ত্রী প্রত্যাশা করেছিলেন মূল্যস্ফীতি
কমবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, উল্টো তা বহুগুণে বেড়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের আর্থিক
ব্যবস্থাপনা আরও ভালো করা জরুরি।
মূল্যস্ফীতি একটি বাস্তবতা এবং তা সবখানেই হয়ে থাকে। তবে আমাদের
দেশে মূল্যস্ফীতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আমাদের অর্থনীতিতে বৈশ্বিক সংকটের প্রভাব
রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনাটার মূল দিক চারটি। প্রথমত সরকারি
আয়-ব্যয়, দ্বিতীয়ত বেসরকারি খাত, তৃতীয়ত বাজারব্যবস্থা, চতুর্থত সরকারি বিভিন্ন সেবা
ও উন্নয়নমূলক কাজ। প্রতিটি বিষয় আলাদা মনে হলেও বাস্তবে এদের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে।
বাজারব্যবস্থাকে স্বতন্ত্র ও একক স্থানে যাচাই করলে হবে না। তবে বাজারব্যবস্থার মধ্যে
বিদ্যমান ক্ষতিকর বিষয়গুলো চিহ্নিত করা জরুরি।
বাজারে খাদ্য মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতি ভয়াবহ। বিশ্ববাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয়
বিভিন্ন পণ্যের বর্তমান দামের সঙ্গে দেশের বাজারে একই পণ্যের দামে বড় রকমের পার্থক্য
দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের তুলনায় বিশ্ববাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় কয়েকটি পণ্য অনেক কম দামে
বিক্রি হচ্ছে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নথিতে দেখা গেছে। সামগ্রিকভাবে দামের পার্থক্য
অনেক। বিশেষ করে দেশের বাজারে ডিমের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি।
আমাদের ডিম আমদানি করতে হয় না। কিন্তু ডিমের দাম ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার এখন
পর্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। বহু দেশ সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে
সাফল্য দেখিয়েছে। কিন্তু আমাদের মুদ্রানীতিতে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। দীর্ঘদিন
সুদের হার স্থির রাখা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে অর্থনীতিবিদরা সুদের হার বাড়ানোর বিষয়ে মত
দিয়েছেন। পণ্যের দাম কমাতে আমদানিতে করছাড় দেওয়া হয়নি। বাজার ব্যবস্থাপনায় কোনো কোনো
ক্ষেত্রে রয়েছে নৈরাজ্য এবং তদারকির যথেষ্ট অভাব। অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছে বাজার জিম্মি।
তারা ইচ্ছামতো পণ্যর দাম বাড়ান, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেন। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি
বিষয়ক সংস্থার তথ্যানুযায়ী, গত আগস্টে সারা বিশ্বে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে সর্বনিম্ন
হয়েছে। এ সময়ে চাল ও চিনি ছাড়া বিশ্ববাজারে প্রায় সব খাদ্যপণ্যের দামই কমেছে। আমাদের
এখানে দাম না কমা মানে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সংস্থা যথাযথভাবে বাজার মনিটরিং করতে পারেনি।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে বেশকিছু পণ্যের দাম কমলেও আমাদের
দেশে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। অনেকে এ ক্ষেত্রে ডলার সংকট এবং ডলারের বিপরীতে টাকার
মূল্যমান কমাকে দায়ী করছেন। বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা অসাধুদের পুরনো
ব্যাধি। অনেকে বলেন, বিদেশ থেকে আমদানি বন্ধ করতে হবে। যদি পণ্যের চাহিদা থাকে তাহলে
পণ্য আমদানি করা যেতেই পারে কিংবা করতে হবে। কিন্তু বাজারের গতি বজায় রাখতে হবে। বাজারে
ব্যবসায়ীরা পণ্যের জোগান স্বাভাবিক রাখবে। এমনটি না হয়ে বাজারে কোনো কারণ ছাড়াই দাম
বাড়ানো হচ্ছে। বাজার লাগাম টানতে তিনটি পণ্যের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য বেঁধে দিয়েছে সরকার।
১৪ সেপ্টেম্বর দেশি পেঁয়াজ, ডিম ও আলু— এ তিন পণ্যের দাম ঠিক করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু এর পরদিন অর্থাৎ
১৫ সেপ্টেম্বর সকালে ঢাকার কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুরের টাউন হল ও রায়েরবাজার— এ তিন কাঁচাবাজারের কোনোটিতেই সরকার নির্ধারিত
দামে পণ্য তিনটি বিক্রি হতে দেখা যায়নি সংবাদমাধ্যমে এমন খবর জানা যায়। সাংবাদিকরা
এ তিন কাঁচাবাজার ঘুরে দেখেন, দাম বেঁধে দেওয়ার এক দিন পর ১৫ সেপ্টেম্বর দেশি পেঁয়াজ,
ডিম ও আলু আগের বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে। ১৬ সেপ্টেম্বরও সংবাদমাধ্যমের শীর্ষস্থানে
একই চিত্র দেখা গেছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা সাংবাদিকদের জানান, পাইকারি বাজারে দাম কমেনি।
ফলে তাদের পক্ষে এখনই সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। এর মধ্য দিয়ে
কী প্রমাণিত হয়?
সংশ্লিষ্ট মহলের তরফে দৃশ্যত বাজারে কখনও কখনও অভিযান পরিচালিত
হয় বটে কিন্তু এর সুফল স্থায়ী হয় না। কেন? এ কেনর উত্তর খোঁজার দায়িত্ব যাদের তারা
কী করছেন? বাজারে কীভাবে অন্যায্যভাবে দাম বাড়ানো হচ্ছে তা আমরা জানতে পারছি। আবারো
বলি, মাঝেমধ্যে দেখি সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা বাজারে অভিযান চালাচ্ছেন। এই অভিযান বেশিরভাগ
ক্ষেত্রেই শহরকেন্দ্রিক। বাজারে সিন্ডিকেট যদি থাকে তাহলে সারা দেশেই বিভিন্ন নেটওয়ার্ক
তাদের রয়েছে। সিন্ডিকেট অদৃশ্য কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে যে কঠোর অভিযান
পরিচালনা করা জরুরি তাতে ঘাটতি রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানিসহ অনেক নিত্যপণ্যের দাম নিম্নগামী।
কিন্তু আমাদের এখানে এর কোনো ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে না। নিকট অতীতে এই স্তম্ভেই
বলেছি, জ্বালানির সরবরাহ ও দাম নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে।
আলোচনার শুরুতেই বলেছি, অর্থনীতির প্রতিটি ভাগ একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। জ্বালানির
দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে নিত্যপণ্যের বাজারেও ভয়াবহ অবস্থা হবে।
বিভিন্ন
মহল থেকে প্রশ্ন করা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না? এর একাধিক কারণ
রয়েছে। প্রথমত চলতি বছর রেকর্ড পরিমাণ টাকা ছাপানো হয়েছে। যখন বেশি টাকা ছাপানো হয়
তখন স্বভাবতই মুদ্রার মান কমে যায়। বাজারে সেই টাকা সরবরাহ করা হলেই মূল্যস্ফীতি বাড়ে।
সেটাও সাময়িক সময়ের জন্য। সরকার গত বছরও বাজেট ঘাটতি মেটাতে প্রচুর ঋণ নিয়েছে। নতুন
বাজেটেও প্রায় ৫০ শতাংশ ঘাটতি রয়েছে, যা ঋণের মাধ্যমে পূরণ করা হবে। সরকার এ প্রবণতা
থেকে সরে আসতে পারছে না। মূল্যস্ফীতির এও এক বড় কারণ। দ্বিতীয়ত সুদের হার বাড়িয়ে মুদ্রা
সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা গেলে বাজারে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ত। বাংলাদেশ ব্যাংক এ ক্ষেত্রে
ব্যর্থ।
তবে মূল্যস্ফীতির
পেছনে মূলত বাজারের অব্যবস্থাপনাই দায়ী। উৎপাদক স্তর থেকে ভোক্তা এবং আমদানি স্তর থেকে
ভোক্তাÑ এ দুই পর্যায়ে যারা মধ্যস্বত্বভোগী রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে তাদের হাতে বাজার
একচেটিয়াভাবে চলে গেছে। তারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে এবং এর কারণে যে মূল্যটা সেটা বাজারের
প্রতিযোগিতার সক্ষমতার নিরিখে হচ্ছে না। মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণিই বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে
এবং তাদের কারণেই বাজারে অস্থিতিশীল পরিবেশ রয়ে গেছে। সম্প্রতি আলুর দাম অযৌক্তিকভাবে
বাড়তে দেখা গেছে। কীভাবে মধ্যস্বত্বভোগীরা অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়াচ্ছে, এ বিষয়ে কিছু
ধারণা সংবাদমাধ্যমে পাওয়া গেছে। অসাধুরা খোড়া যুক্তি দাঁড় করিয়ে পণ্যের দাম ইচ্ছামতো
বাড়িয়ে ভোক্তার পকেট কেটে নিজেদের পকেট ভরেন। বাজার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেসব
প্রতিষ্ঠান আছে যেমন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর বা প্রতিযোগিতা কমিশন–
এসব প্রতিষ্ঠান যথেষ্ট তৎপর নয়।
সিন্ডিকেট শব্দটি আমাদের বাজারে বহুলপ্রচারিত। সরকারের দায়িত্বশীলরাও সিন্ডিকেটের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করেছেন। কোনো কোনো মন্ত্রী এও বলেছেন, বাজারে সিন্ডিকেটের কারসাজি চলছে। সরকারের দায়িত্বশীলদের এমন অসহায়ত্ব অশুভ শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ বৈ কিছু নয়। বাজার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের কর্মসূচিতে ঘাটতি রয়েছে। বাজারে সুষ্ঠু নীতিমালা ও নিয়মকাঠামো নেই। অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের পকেট স্ফীত করার জন্যই নানারকম কারসাজি করেন। সুশাসন নিশ্চিত করা ছাড়া এ থেকে পরিত্রাণের পথ নেই। অসাধুদের পণ্যের মূল্য ইচ্ছামাফিক বাড়ানোর পথ রুদ্ধ করা নিশ্চয় দুরূহ নয় যদি সরকার কঠোর অবস্থান নেয়। ভোক্তার স্বার্থরক্ষার দায় সরকার এড়াতে পারে না। পণ্যের দাম, পাইকারি দাম, বিক্রয়মূল্য, সরবরাহব্যবস্থার খরচ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে ভোক্তাকে জানাতে হবে। সচেতনতা বাড়ালে এবং তথ্য সরবরাহ নিশ্চিত করলে মধ্যস্বত্বভোগীরা তাদের অপতৎপরতা চালাতে পারবে না।