ভূরাজনীতি
ক্রিস স্টিভেনসন
প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০:৫৮ এএম
ক্রিস স্টিভেনসন
ক্রেমলিন জানিয়েছে, ভ্লাদিমির পুতিন ও কিম জং উনের মধ্যে
রাশিয়ার অত্যন্ত সংরক্ষিত স্থান মহাকাশযান উৎক্ষেপণকেন্দ্র ভস্তোচনি কসমোড্রোমে
‘গুরুত্বপূর্ণ’ আলোচনা হয়েছে। তাদের এই আলোচনা কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী হয়। আলোচনায় উভয়
দেশের জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন এবং ভোজের আয়োজন করা হয়। এই দুই নেতার মধ্যে কী
এমন আলোচনা হয়েছে-এই প্রশ্নটি সংবাদমাধ্যমে ঘুরছে। একইসঙ্গে মানুষ এই বৈঠক নিয়ে
নানা জল্পনা-কল্পনা করলেও এই দুই রাষ্ট্রনেতার মধ্যে নানা সম্ভাবনার আলোচনা যে
হয়েছে তা অনুমান করা যায়। বিগত কয়েক দিন ধরে ইউক্রেন অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে
মস্কোকে নানা জটিলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। পিয়ংইয়ংয়ের কাছে প্রচুর গোলাবারুদ রয়েছে,
তাদের কাছে আছে অ্যান্টি-ট্যাংক মিসাইল এবং অন্যান্য অস্ত্র। সবগুলোই সোভিয়েতের
অনুকরণে বানানো। অস্ত্র-গোলাবারুদ সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে পুতিন কতটা বেপরোয়া হয়ে
উঠেছে, এই বৈঠকই তার প্রমাণ। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন আশানুরূপ না হওয়ায় রাশিয়াকে অন্য
পন্থা নিতে হচ্ছে।
কিম জং উন যেন আরও কিছু দিন তার এই সফরে রাশিয়া ভ্রমণ করেন,
সে প্রত্যাশাও পুতিনের রয়েছে। কিম যেন রাশিয়ার আরও পূর্বে ভ্লাদিভোস্তক ও
কোমসোমোলস্ক পর্যন্ত ভ্রমণ করেন, এমনটাই আপাতত সফরের পরিকল্পনা। কোমসোমোলস্ক-অন-আমুরের
রেলস্টেশনে শ্রমিকদের অস্থায়ী কাঠের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে দেখা গেছে। সেখানে
বিমান নামানোর পরিকল্পনাই করছেন পুতিন। পুতিন জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে
সঙ্গতি রেখেই তিনি নিজ দেশের সম্ভাবনাগুলো আবিষ্কারের প্রচেষ্টা করছেন। দুই দেশের
ওপরই নিষেধাজ্ঞা থাকায় সীমা ছাড়িয়ে যায় এমন কোনো কাজ দুই নেতা করবেন না, এমনটিই
স্বাভাবিক।
এই সফরে দুই দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মধ্যেও আলোচনা হয়েছে।
শুধু তাই নয়, সফরে ছিলেন উত্তর কোরিয়ার প্রতিরক্ষা বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদধারী
কর্মকর্তারাও। উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র গবেষণা এবং উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের অনেকেও ছিলেন।
উত্তর কোরিয়াকে রাশিয়ার কাছে অস্ত্র বিক্রি না করার অনুরোধ করেছে যুক্তরাজ্য।
যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য কড়া ভাষায় জানিয়েছে, এমন কিছু করলে পরিণাম ভালো হবে না। ক্রেমলিনের
সূত্র জানাচ্ছে, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরব আগামী মাসে পিয়ংইয়ং সফরে
যাবেন। সেখানে এ বিষয়ে আরও আলোচনা হবে।
পুতিন বলেছেন, তার সঙ্গে কিমের পারমাণবিক শঙ্কা নিয়ে কোনো
আলাপ হয়নি। দুই দেশের মধ্যে এ বিষয়ে কোনো সমঝোতাও হয়নি। কিম এই সফরে দেশটির একাধিক
সামরিক কর্মকর্তাকে নিয়ে এসেছেন। তার মধ্যে নেভি কমান্ডার অ্যাডমিরাল কিম মিউং
সিকও রয়েছেন। বোঝা যাচ্ছে, মিসাইল ও পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিনের বিষয়ে তার
আগ্রহ রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে স্থলপথে যতটুকু সংযোগ রয়েছে, তার ভিত্তিতে যে অস্ত্র
পাওয়া যাবে তার পরিমাণ খুব একটা বেশি না। তাই পুতিন এত উচ্চমানের প্রযুক্তিগত
সহায়তা উত্তর কোরিয়াকে দিতে রাজি হবেন কি-না, এ নিয়ে অনেকের সন্দেহ রয়েছে।
উত্তর কোরিয়ার পূর্বাংশে সামরিক শিপইয়ার্ডের এক আয়োজনে কিম
উপস্থিত ছিলেন। আয়োজনে তারা পারমাণবিক অস্ত্রধারী সাবমেরিনের কথা বলেছে। জানিয়েছে,
জলের নিচ থেকে তারা এখন আক্রমণ করতে পারবে। তবে দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক বাহিনী এ
বিষয়ে তাদের সংশয় প্রকাশ করেছে। এ রকম ক্ষমতার একটি জলযান প্রস্তুত করা কঠিন। পুতিন
ও কিম এই একটি জায়গায় একমত। ভস্তোচনি কসমোড্রোমে তাদের বৈঠক প্রতীকী। কিম আসলে কী
চায় তারই পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কিমকে রাশিয়ার উন্নত মহাকাশযান
উৎক্ষেপণকেন্দ্র দেখাতে পেরে পুতিন নিজেও খুশি। অবশ্য তারা দক্ষিণ কোরিয়ার কসমোনট
উৎক্ষেপণের সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা করেছেন। কিমকে রকেট বিষয়ে বিস্তারিত প্রশ্ন করা
হয়েছে।
উত্তর কোরিয়া কয়েক মাস ধরে মহাকাশে স্পাই স্যাটেলাইট প্রেরণের
চেষ্টা করছে। প্রতিটি অভিযানই ব্যর্থ হয়েছে। অক্টোবরেই আবার চেষ্টা করা হবেÑ এমন
প্রতিশ্রুতি কিম করেছেন। এবার সফলতার জন্য দেশটি রাশিয়ার সাহায্য চাইবে। উত্তর
কোরিয়া একাধিকবার দাবি করেছে, তাদের স্পেসক্রাফট যথেষ্ট শক্তিশালী। যদিও তাদের ওপর
গভীর নজর রাখা দক্ষিণ কোরিয়া বলেছেÑ এই মিলিটারি স্পেসক্রাফট উন্নত নয়। মহাকাশনির্ভর
গুপ্তচরবৃত্তির মাধ্যমে কিম মিসাইল থ্রেটের ক্ষেত্রে আরও বেশি পোক্ত অবস্থানে
থাকবেন। বিশেষত ব্যালিস্টিক মিসাইল তৈরিতে তিনি আরও শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছাবেন।
রাশিয়া কি উত্তর কোরিয়াকে সাহায্য করবেÑ পুতিনকে এই প্রশ্ন
করা হয়েছিল। তিনি রাশিয়ার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘অবশ্যই সাহায্য করব। এজন্যই তো
কিমের এই সফর। তিনি রকেট টেকনোলজি বিষয়ে ভীষণ আগ্রহী। আর তিনি নিজ দেশে রকেট
প্রযুক্তি চালু করার কথা ভাবছেন।’ মহাকাশযান উৎক্ষেপণকেন্দ্রের মতো চমৎকার একটি
স্থানে দুই রাষ্ট্রপ্রধানের বৈঠক আয়োজন করায় কিম পুতিনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এমন
উন্নত প্রযুক্তি দেখতে পেয়ে তিনি নিজেকে গর্বিত ভাবছেন। মহাকাশযান খাতের ভবিষ্যৎ
সম্ভাবনা এবং বর্তমান জ্ঞান সম্পর্কে অনেক কিছু জানার সুযোগ পাওয়া গেছে।
কিম পুতিনের সাফল্যের বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন,
রাশিয়া এই মুহূর্তে উত্তর কোরিয়ার পররাষ্ট্রনীতির প্রথম প্রাধান্য। সম্ভবত উত্তর
কোরিয়ায় খাদ্যশস্যের সরবরাহ এবং ছোটখাটো অস্ত্রচুক্তির মাধ্যমে কিছুটা সুবিধা
পাওয়ার কথা ভেবেই তিনি এমনভাবে কথা বলেছেন। কিম পুতিনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। পশ্চিমে
ইউক্রেনের সঙ্গে চলমান ‘পবিত্র যুদ্ধে’ মস্কোকে তিনি নিশ্চিত বিজয়ী হিসেবে দেখছেন।
তিনি বলেন, ‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই যুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর বীরত্বই তাদের জয়
এনে দেবে। প্রথা এবং একটানা লড়ে যাওয়ার মাধ্যমে নিজেদের আত্মসম্মান ধরে রাখার
মানসিকতাসম্পন্ন এবং আত্মমর্যাদাপ্রবণ রাশিয়ানরা বিজয়ী হবেই।’ আপাতত পুতিন
কিমের কাছ থেকে অস্ত্র আমদানির বিষয়ে আগ্রহী এবং এ নিয়েই তার ভূরাজনীতি। কিন্তু
কিমও কম যান না। দীর্ঘমেয়াদে তিনিও রাশিয়া থেকে কিছু স্বার্থ আদায়ের খেলা খেলবেন।
এর পরিণাম পশ্চিমাদের জন্য ভালো হওয়ার কথা নয়।
ইনডিপেন্ডেন্ট
ইউকে থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ : আমিরুল আবেদিন।