× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ময়মনসিংহে গণতন্ত্র বৈরী কর্মকাণ্ড

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০২২ ১৭:২৪ পিএম

আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০২২ ১৭:২৫ পিএম

ময়মনসিংহে গণতন্ত্র বৈরী কর্মকাণ্ড

বিএনপির কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে আয়োজিত জনসমাবেশকে কেন্দ্র করে ময়মনসিংহে ১৫ অক্টোবর ও তার আগের দিন যে পরিস্থিতি পরিলক্ষিত হয়েছে, তা এককথায় গণতন্ত্র বৈরী বললে অত্যুক্তি হবে না। ময়মনসিংহ থেকে বিভিন্ন রুটে সমাবেশের আগে গণপরিবহন চলাচল কোন অদৃশ্য ইশারায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এটি অবশ্যই জরুরি প্রশ্ন।

পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন ‘ওপরের নির্দেশে’ গণপরিবহন চলা বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে যে জনভোগান্তি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে তাতে প্রশ্ন জাগে গণতন্ত্রের জন্য এমন বৈরী প্রেক্ষাপট ফিরে ফিরে তৈরি হয় কেন? দেশে যে রাজনীতি চলছে, তা এককথায় বলতে গেলে বুর্জোয়াদের রাজনীতি। তারা ক্ষমতার জন্য এমনই দ্বন্দ্ব-সংঘাত-ফ্যাসাদে লিপ্ত হয় বা হবে। এটাই স্বাভাবিক। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে এ ব্যবস্থা থেকে উত্তরণের পথ কী? আমি বলব, বিকল্প রাজনীতি দরকার। আমি কোনো তৃতীয় রাজনীতির কথা বলছি না। বিকল্প রাজনীতি হলো, যে রাজনীতি হবে সমাজ বদলের রাজনীতি। মানুষের কল্যাণ ও মঙ্গলের রাজনীতি। পুঁজিবাদী এই সমাজব্যবস্থা বদলে সমষ্টিগত সম্পদের মালিকানা দরকার; যারা মনে করেন এই অসুস্থ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। মুক্ত আলোচনা কিংবা মতপ্রকাশ, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, আলাপ-আলোচনা, নাটক- এসবের মূল লক্ষ্য হবে রাজনীতির পরিবর্তন ঘটানো। সেই সঙ্গে পরমতসহিষুষ্ণতা ও ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা তো থাকতেই হবে।

গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের অধিকার রয়েছে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলনের। ময়মনসিংহের ওই আন্দোলন এ থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু ছিল না। সহিংসতাময় যেকোনো পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের প্রধানতম উপায় হচ্ছে, একে অপরের প্রতি গণতান্ত্রিক আচার-আচরণ দেখানো এবং পরমতসহিষ্ণুতা প্রদর্শন। একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধের প্রতিও প্রত্যেককে শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। এখানে আরও একটি কথা বলা যায়, বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে সভা-সমাবেশ করা তথা রাজনীতির মাঠে নামার সুযোগ পায়নি। এখন তারা নামার সুযোগ পেলেও তাদের দলের মধ্যেও কিন্তু উগ্রপন্থিরা রয়েছে, যারা উস্কানিমূলক বক্তব্য রেখে পরিস্থিতি কখনও কখনও আরও অসহনশীল করে তুলছে। তাদের সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে হবে। তবে ময়মনসিংহে তারা এমন কিছু করেনি। বিগত দিনের কর্মকাণ্ডের কারণে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের আন্তঃসম্পর্কের মধ্যে এতটাই দূরত্ব ও তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে; সেটা স্বাভাবিক হতে আরও অনেক সময় লাগবে।

আইনের শাসনের চেয়ে আমি জবাবদিহি বড় মনে করি। কারণ জবাবদিহি থাকলে আইনও বদল হবে। আসল কথাটি হচ্ছে জনমত। ভরসা কিন্তু এই সংসদে নয়, ভরসা সরকারও নয়, ভরসা হচ্ছে সেই জনমত, যে জনমত সংসদ ও সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারবে। যেখানে থাকতে হবে জবাবদিহি। গণতন্ত্রের মূল কথাটিই হলো জবাবদিহি। গণতন্ত্র কেবল ভোটে প্রতিষ্ঠিত হয় না। জনমত তৈরি হবে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। সে ক্ষেত্রে মিডিয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মিডিয়া এখন অনেক শক্তিশালী। মিডিয়া যদি এই খবরগুলো তুলে ধরে, জনমত গঠনে সহায়তা করে, তাহলে মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার হবে।

গণতন্ত্র বলতে নানা মত আছে। কেউ ভাবেন গণতন্ত্র হচ্ছে নির্বাচিত সরকার, অন্য পক্ষ বলে মোটেই না। গণতন্ত্র অনেক বড় ব্যাপার। এ হচ্ছে একটা পরিপূর্ণ সংস্কৃতি। সংজ্ঞা নিয়ে মতবিরোধ যতই থাকুক, গণতন্ত্র যে পরিচিত শাসনব্যবস্থাগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম, এ নিয়ে তেমন একটা দ্বিমত নেই। সর্বোত্তম কেন তা-ও আমরা জানি। কারণটা হচ্ছে এই, গণতন্ত্র কেবল ব্যক্তিকেই মর্যাদা দেয় না, ব্যক্তির অধিকার, তার স্বার্থ, বিকাশ এসবকে বিবেচনার একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখে। অন্য শাসনব্যবস্থায় এমনটা ঘটে না। সেখানে একনায়কত্ব, স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদ ইত্যাদি বিষয় নানা নামে কার্যকর থাকে। কয়েকজন শুধু স্বাধীনতা পায়, অন্য সবার স্বাধীনতা কেড়ে নেয়। ক্ষমতা নাগরিকদের হাতে থাকে না, চলে যায় শাসকদের হাতে। যেখানে রাষ্ট্র থাকে, সেখানেই এই প্রশ্নটা থাকে। সমস্যাটা সমাজেও আছে এবং থাকে। আসলে সমাজ যেখানে রাষ্ট্রও তো সেখানেই। 

ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির দ্বন্দ্বটাও খুবই স্বাভাবিক। আর এখানেই গণতন্ত্রের বিশেষ উপযোগিতা রয়েছে। গণতন্ত্র সবার স্বার্থ দেখতে চায় এবং ব্যক্তির স্বার্থকে মেলাতে চায় সমষ্টির স্বার্থের সঙ্গে। অর্থাৎ এমন একটা ব্যবস্থা চায় যেখানে ক্ষমতা বিশেষ কোনো কেন্দ্রে কুক্ষিগত থাকবে না, ছড়িয়ে থাকবে সমাজের সর্বত্র এবং রাষ্ট্র শাসন করবেন জনপ্রতিনিধিরা। এখানেই নির্বাচনের ব্যাপারটা আসে। জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনকে এতটাই গুরুত্ব দেওয়া হয় যে অনেকে ধারণা করেন যেখানে নির্বাচিত সরকার আছে, সেখানেই গণতন্ত্র রয়েছে। কিন্তু নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকতেও ময়মনসিংহে কেন এমন পরিস্থিতি দৃশ্যমান হলো? এমনটি তো আগেও দেখা গেছে। এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে লেখার শুরুতেই। 

নির্বাচন আসে এবং মনে করা হয় যে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরিণামে যা পাওয়া যায় তা মোটেই গণতন্ত্র নয়, সেটা হচ্ছে ভিন্ন কিছু। আর সাধারণ অভিজ্ঞতা এটাই যে, অগণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্নরা যদি নির্বাচিত হন অর্থাৎ নিজেকে বৈধ করে নেন, তবে তা অবৈধ স্বৈরাচারের চেয়েও ভয়ংকর হতে পারে। কেননা বৈধ স্বৈরাচার নিজেকে বৈধ মনে করে, তবে সে জনগণের রায় নিয়ে এসেছে, তাই যা ইচ্ছা তা করতে পারবে, যতটা সম্ভব আইন চালাবে, পাঁচ বছর পরে দেখা যাবে জনগণ তাদের কাজ পছন্দ করেছে কি করেনি। বলা বাহুল্য, এ রকম শাসনকে গণতন্ত্র বলে না। গণতন্ত্রের জন্য জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা আবশ্যক। কিন্তু তা-ও যথেষ্ট নয়, জবাবদিহি কার কাছে, স্বচ্ছতাই বা কতটা? আর ভোট? অভিযোগ আছে ভোটের কেনাবেচা চলে। আরও বড় সমস্যা যেটা সেটা হলো নাগরিকদের সামনে আসলেই কোনো পছন্দ থাকে না, তারা দুই দল থেকে একটিকে বেছে নেয়। যাদের উভয়েই হচ্ছে প্রায় একই রকমের। এমনটির নিরসন না ঘটলে ময়মনসিংহের মতো ঘটনা ঘটেই চলবে। 

গণতন্ত্রকে চিনতে হয় কয়েকটি উপাদান দিয়ে। উপাদানগুলো আমাদের খুবই পরিচিত; কিন্তু বারবার স্মরণ করা আবশ্যক। এদের মধ্যে প্রথম যেটি সেটি হলো অধিকার ও সুযোগের সাম্য। তারপর আসে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। এবং অবশ্যই দরকার হবে সব স্তরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শাসন। এসবই পন্থা, উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যক্তির স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও বিকাশকে নিশ্চিত করা। যথার্থ গণতন্ত্রের সঙ্গে তাই সমাজতন্ত্রের বিরোধ নেই; বলা যায় আসল পার্থক্যটা নামেরই, অন্য কিছুর নয়। আমাদের এখন যেটা দরকার সেটা হলো একটা গণতান্ত্রিক জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা। যেখানে মানুষ নিজেদের অধিকারের জন্য সংগঠিত হবে, সুবিধার জন্য নয়। সুবিধা মানে এই ধরনের আর্থিক সুবিধার জন্য নয়। নিজেদের একটা আদর্শগত অবস্থান থাকবে। তারা বলবে, আমরা দেশটাকে এইভাবে দেখতে চাই। আমরা আমাদের রাষ্ট্রের চরিত্রটাকে এইভাবে গঠন করতে চাই। ওই রাজনীতি যখন থাকবে তখন এই সমস্ত উৎপাত আর থাকবে না।

বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগ কিংবা অন্য দল মনে করে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সম্মতি নেওয়া দরকার। এই সম্মতির জন্যই তারা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যে আসে। নির্বাচনের বাইরে তাদের সঙ্গে জনগণের কোনো সংযোগ থাকে না। আমাদের দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। কিন্তু প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সংসদে বসলে জনগণের স্বার্থসংক্রান্ত বিষয়ে তেমন কোনো আলোচনা করে না। তাদের বক্তব্যগুলো আত্মকেন্দ্রিক এবং তারা পরস্পরকে আঘাত করে কথা বলতে থাকে। পরস্পরকে আক্রমণ করে কথা বলার কারণে বিরোধী দল সংসদে আসে না। ফলে সংসদ একটা একদলীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ময়মনসিংহে যে ধরনের ঘটনা ঘটেছে তার পুনরাবৃত্তি কোনোভাবেই কাম্য নয়। এজন্য সবচেয়ে জরুরি শুদ্ধ রাজনীতির অনুশীলন। শুদ্ধ রাজনৈতিক চর্চা ছাড়া গণতন্ত্রের কিংবা গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথ মসৃণ হবে না। 

লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক


প্রবা/ইউরি


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা