সম্পাদক
প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১২:৩৮ পিএম
শিল্পের মূল শক্তি শ্রমিক। শ্রমিকের শ্রমে-ঘামেই বিকশিত হয় শিল্প।
এতদঞ্চলের সিলেটের মালনীছড়ায় ১৮৫৪ সালে বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদন শুরু হয়েছিল। তখন চা
শিল্পকে বিকশিত করতে ব্রিটিশ সরকার ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে দরিদ্র আদিবাসীদের এ
অঞ্চলে নিয়ে আসে। ভূমিসহ নানান সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের নিয়ে আসা
হলেও আজ পর্যন্ত বাস্তবে এর কিছুই হয়নি বলা চলে। দেশের চা শিল্প এখন অনেক বিকশিত। উৎপাদন
ও রপ্তানি দুই ক্ষেত্রেই চিত্র অনেক স্ফীত। দেশে বর্তমানে চা-বাগানের সংখ্যা ১৬২টি
এবং এই বাগানগুলোতে কর্মরত রয়েছেন প্রায় ৭ লাখ শ্রমিক, যাদের বেশির ভাগই নারী। দেশের
উন্নয়ন-অগ্রগতির চিত্র যখন আশাজাগানিয়া তখনও চা-শ্রমিকরা জীবনমানের প্রায় সব সুযোগ
থেকেই পিছিয়ে। ১৩ সেপ্টেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ অক্সফাম ইন বাংলাদেশের সহযোগিতায়
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহ-অর্থায়নে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) গবেষণা
প্রতিবেদনের সূত্র ধরে যে চিত্র উঠে এসেছে তাতে উন্নয়ন-অগ্রগতির সুষম ফল অদৃশ্য।
বিলসের গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশের চা-বাগানগুলোতে পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা
ও নিরাপদ পানির সুবিধা এখনও অনেক কম। বেশিরভাগ বাগানেই নেই টয়লেটের ব্যবস্থা। ‘বাংলাদেশের
চা খাতে নিয়োজিত নারীশ্রমিক : অধিকার ও শোভন কাজ পরিস্থিতি’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে
যে চিত্র উঠে এসেছে তাতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে চা-শ্রমিকরা
যে ধরনের জীবনযাপন করছেন তা কোনোভাবেই মানবিক নয়। মজুরিবৃদ্ধিসহ তাদের অধিকার আদায়ের
লক্ষ্যে নিকট অতীতে আন্দোলনের পরও নির্ধারিত নতুন মজুরিহার বিদ্যমান মূল্যস্ফীতির তুলনায়
নিতান্তই কম। চা-বাগানের শ্রমিকদের স্বাক্ষরের মাধ্যমে হাজিরা তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থাও
নিশ্চিত হয়নি। চিকিৎসাসহ অন্য মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রেও যে পরিস্থিতি এখনও দৃশ্যমান
এর কোনো কিছুই মানবিক নয়। নিকট অতীতে চা-শ্রমিকদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করার ঘোষণা দেওয়ায় চা-শ্রমিকদের মধ্যে আশা-উদ্দীপনা
এবং জীবনমানের উন্নয়নে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছিল। প্রধানমন্ত্রীর ওই উদ্যোগ প্রশংসিত
হয় এবং চা-শ্রমিকরা তাদের আন্দোলন প্রত্যাহার করে কাজে যোগ দেন। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের
মাধ্যমে চা-শ্রমিকদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর মতবিনিময়ের বিষয়টি চা-শ্রমিকদের কাছে একেবারেই
ছিল অচিন্তনীয়। প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক ভূমিকার পরও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা
চা-শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নয়নে তাদের অবস্থান থেকে কতটা কী করেছেন এই প্রশ্ন থেকে
যায়। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকরা যদি স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপনের মাধ্যমে তাদের শ্রমশক্তি
কাজে লাগাতে পারেন তাহলে দেশের অর্থনীতিতে এর আরও ইতিবাচক প্রভাব নিঃসন্দেহে আশা করা
যায়। এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে মালিকপক্ষের সদিচ্ছা জরুরি। চা-শ্রমিকরা যে এখনও বৈষম্য ও
বঞ্চনার শিকার এই সত্য অস্বীকারের পথ নেই। শ্রম আইনে বলা আছে, ‘কোনো মালিক নিয়োগপত্র
প্রদান না করিয়া কোনো শ্রমিককে নিয়োগ করিতে পারিবেন না এবং নিয়োজিত প্রত্যেক শ্রমিককে
ছবিসহ পরিচয়পত্র প্রদান করিতে হইবে।’ কিন্তু চা-বাগানের অনেক শ্রমিক মালিকপক্ষের কাছ
থেকে শ্রম আইন অনুসারে নিয়োগপত্র পান না, এমন অভিযোগ বিস্তর। চা-শ্রমিকদের আবাসন, স্বাস্থ্য
ও শিক্ষাÑ এসব কোনো কিছুই উন্নয়ন-অগ্রগতির এই বাংলাদেশে তাদের সামনে দুর্ভাগ্যের আয়না
হয়ে থাকতে পারে না। সামাজিক ন্যায়বিচার এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া চা-শ্রমিকদের জীবনমানের
উন্নয়ন কঠিন। তারা বাগান থেকে যে রেশন পান তা-ও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তাদের বসবাসের
জন্য বাগান কর্তৃপক্ষ যে ঘর দেয় তা-ও অনেক ক্ষেত্রেই বসবাসের উপযোগী নয় বলেও অভিযোগ
আছে। আমরা মনে করি, কোনো মানদণ্ডেই তা আধুনিক ও মানবিক ব্যবস্থাপনা বলা যায় না। চা
উৎপাদন ও বাজারদরের সুখবর মিললেও শ্রমিকের ভাগ্য পরির্বতন কেন হয় নাÑ এমনটি বিস্ময়কর
যুগপৎ প্রশ্নবোধক।
চা-শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নয়নে চা-বাগান কর্তৃপক্ষের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির
প্রকাশ ন্যায়সঙ্গত প্রত্যাশা। তাদের শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সব ধরনের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত
করতে সরকারকে বাড়াতে হবে নজরদারি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চা-শ্রমিকদের
কল্যাণে বহুমুখী পদক্ষেপ নেওয়ার কারণেই তারা বঙ্গবন্ধুর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা পোষণ করেন।
আমরা মনে করি, মূল্যস্ফীতি ও অন্যান্য মানবিক বিষয় বিবেচনায় চা-শ্রমিকদের প্রতি যথাযথ
দায়িত্ব পালন করার দায় সর্বাগ্রে বর্তায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ওপর। দেড়শ বছরেরও বেশি
সময় ধরে যে শ্রমিকরা শুধু চা-বাগানগুলোকে বাঁচিয়েই রাখেননি, অর্থনীতিতেও অন্যতম জোগানদার
খাতে পরিণত করেছেন তারা মানবিক কোনো অধিকার থেকেই বঞ্চিত থাকতে পারেন না।