সুশাসন
মুনীরা খান
প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১২:৩৬ পিএম
মুনীরা খান
ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব
প্রতি বছর আমাদের ভোগাচ্ছে। চলতি বছর ডেঙ্গু মহামারি আকার ধারণ করেছে। জনমনে বেড়েছে
উদ্বেগ, বেড়েছে ভোগান্তি এবং রেকর্ড মৃত্যুও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুলেছে। প্রতিদিনই
ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। বর্ষার সময় সচরাচর সর্দি-কাশি-জ্বর ইত্যাদি হয়ে
থাকে। কিন্তু এ বছর ডেঙ্গু নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। তাই সাধারণ সর্দিজ্বর, ডায়রিয়া, মাথাব্যথা,
চোখব্যথা এমনকি গণমাধ্যমে প্রচারিত ডেঙ্গুর যেকোনো উপসর্গের সঙ্গে মিল পেলেই মানুষ
পরীক্ষা করাচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরীক্ষার ফল আসছে নেগেটিভ। এ নিয়েও বাড়ছে উদ্বেগ।
কারণ জ্বর বা অসুস্থতা সেরে গেলেও কেউ নিরাপদ থাকছে না। ডেঙ্গুর স্বীকৃত চিকিৎসা এখনও
আবিষ্কৃত হয়নি। পর্যাপ্ত পানি পান ও প্যারাসিটামল খেয়ে সুস্থ হওয়ার চেষ্টা করতে হচ্ছে
অনেককে। আর এ কাজ করতে গিয়ে অনেকে কিডনির ক্ষতি করে ফেলছেন।
ডেঙ্গু এখন চরম
উদ্বেগের কারণ, এটাই নিরেট বাস্তবতা। ঘরের ভেতর মানুষকে ভাবতে হচ্ছে মশার কথা। ছেলেমেয়ে
বাইরে মাঠে খেলতে যাবে, মশার কামড়ের ভয় করছেন অভিভাবকরা। মূল্যস্ফীতির কারণে জনজীবনে
এমনিতেই বাড়তি চাপ রয়েছে। এর মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার উদ্বেগের সঙ্গে রয়েছে চিকিৎসাব্যয়
কীভাবে নির্বাহ করা হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা। ঘরের ভেতর শান্তিতে বসে থাকার সুযোগ নেই।
দুঃসহ গরমেও অনেকে বাধ্য হয়ে ঘরে মশারি খাটাচ্ছেন। মশা তাড়ানোর জন্য কয়েল আর কেমিক্যাল
স্প্রে ব্যবহার করায় পরিবেশের পাশাপাশি স্বাস্থ্যও নানাভাবে ঝুঁকিগ্রস্ত হচ্ছে। অর্থাৎ
ডেঙ্গু এমন একটি সমস্যা যা আমাদের যাপিত জীবনকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে চলেছে।
৭ সেপ্টেম্বর
প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব’ শিরোনামে প্রকাশিত
প্রতিবেদনটি মনোযোগ আকর্ষণ করে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বিষয়ে বিশ্ব
স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রিয়েসুসের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। তিনি
বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রকোপের মুখে পড়েছে, যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে
গেছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশটির স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর ব্যাপক চাপ তৈরি হয়েছে।’ তিনি
এও বলেছেন, ‘মশাবাহিত এ রোগের বিস্তারের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের আংশিক দায় রয়েছে।’
অর্থাৎ ডেঙ্গুর পুরো দায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের ওপর দিলে চলবে না। জলবায়ু
পরিবর্তনের যদি এখানে আংশিক দায় থাকে তাহলে ডেঙ্গুর রোগবিস্তারের দায় কার কিংবা কোন
প্রতিষ্ঠানের ওপর বর্তায়Ñ এ প্রশ্নের উত্তর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমরা
জানতে চাই। ডেঙ্গু বা ডেঙ্গি যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এর বিস্তার ঠেকাতে রাষ্ট্রের
দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মসূচির সুফল দৃশ্যমান নয়। বরং নানা ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতির
অভিযোগই বেশি পাওয়া যাচ্ছে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে, দায়িত্বশীলরা কি দায় ও জবাবদিহি
ভুলে গেছেন?
ডেঙ্গুর বিস্তার
ঠেকাতে হলে মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করতে হবে। নগরাঞ্চলে মানবসৃষ্ট কারণে ডেঙ্গুর
প্রজননক্ষেত্র গড়ে ওঠে। নাগরিকরা ঘরে ও বাইরে সচেতন দায়িত্ব পালন করবেন; এটি যেমন স্বাভাবিক
তেমন বৃহৎ পরিসরে রাষ্ট্রীয় সংস্থা ও দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ ধারাবাহিকভাবে কার্যক্রম
পরিচালনা করবে এমনটিও প্রত্যাশিত। সাধারণ মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি
নির্বাচন করে থাকে। তাই রাষ্ট্রীয় এবং স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো প্রত্যাশা অনুসারে
কাজ করবে, এমনটিই গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বলে স্বীকৃত। মানুষ জনপ্রতিনিধিদের
কাছে যে ইতিবাচক উত্তর প্রত্যাশা করছে তা পাচ্ছে তো না-ই, উলটো দায়িত্বশীলরা সমস্যার
কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করছেন। ১৩ সেপ্টেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ একটি প্রতিবেদনে
দেখলাম স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ যাদের দায়িত্ব তারা ব্যর্থ হয়েছেন।
মিথ্যা নয়। কিন্তু দোষারোপ করে কিংবা দায় অন্যের উপর চাপিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী কি পার
পেতে পারেন? ডেঙ্গু চিকিৎসাব্যবস্থায় যেসব চরম নেতিবাচক চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে এর নিরসনে
তিনি কি করেছেন? স্বাস্থ্যখাতের পরতে পরতে অনিয়ম-দুর্নীতি জেঁকে আছে আর এর প্রত্যক্ষ
ভুক্তভোগী দেশের সাধারণ মানুষ। এ তো নতুন কোনো ব্যাধি নয়, কিন্তু প্রতিবিধান দৃশ্যমান
নয়।
অতীতে মশাবাহিত
রোগ ম্যালেরিয়া আমাদের জন্য ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল। ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে বিশেষায়িত
প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি নানা উদ্যোগ-কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছিল। অতীতের মতো ম্যালেরিয়া
এখন আর ভয়াবহ আকার ধারণ করে না, যদিও ম্যালেরিয়ায় এখনও অনেকে আক্রান্ত হয়। কিন্তু তা
জলবায়ুর প্রভাবে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও প্রযুক্তির বদৌলতে
চিকিৎসা খাতের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। নগরব্যবস্থার আধুনিকায়নের ফলে যেকোনো রোগের প্রকোপ-বিস্তার
ঠেকানো অনেকটাই সহজ হয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থতার ছায়াও অনেক দীর্ঘ। ডেঙ্গুর
ক্ষেত্রে তা-ই ভয়াবহভাবে দৃশ্যমান। ডেঙ্গুর প্রকোপ-বিস্তার ঠেকানোর ক্ষেত্রে মশার প্রজনন
ধ্বংসের বিকল্প নেই। ডেঙ্গুর বাহকের অস্তিত্ব বিলোপের জন্য প্রতিষ্ঠানগত কর্মসূচি ছাড়া
সফলতার সুযোগ কম। কারণ আমরা যদি প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিকে তাকালে ডেঙ্গু প্রতিরোধে
তাদের সফলতা দেখতে পাব। এমনকি এশিয়ার দেশ থাইল্যান্ডও এ ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মশার আচরণের যে পরিবর্তন ঘটেছে, সেগুলো বিবেচনায় রাখার পাশাপাশি
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সফল দেশগুলোর কর্মসূচি উদাহরণ হিসেবে নেওয়া জরুরি। তাদের কর্মসূচি
উদাহরণ ধরে নিয়ে আমাদের অঞ্চলের জন্য আলাদা কর্মসূচি গড়ে তুলতে হবে। কীটতত্ত্ববিদ ও
জনস্বাস্থ্যবিদদের বরাতে জানা গেছে, ডেঙ্গু কোনো মৌসুমি সংকট নয়। ডেঙ্গুর বিস্তার ঠেকাতে
হলে বছরব্যাপী এর প্রজননক্ষেত্র ধ্বংসে কাজ করতে হবে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে
সরকার ও নাগরিকের সমন্বয়মূলক ব্যবস্থার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এক্ষেত্রে সদিচ্ছা খুব
জরুরি। রাষ্ট্রীয় কাঠামো সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে। তাই এখানে মানবিক আবেগ হয়তো এত
গুরুত্বপূর্ণ নয়। গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সদিচ্ছাই প্রধান।
ব্যক্তিগত জীবনের একটি উদাহরণ দিই। চলতি বছর এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের সঙ্গে ম্যাচ
চলাকালে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের নবীন ক্রিকেটার মিরাজ সেঞ্চুরি করেন। কোনো কোনো মুসলিম
ক্রিকেটার ম্যাচে সেঞ্চুরি করলে সিজদা দিয়ে সৃষ্টিকর্তার প্রতি তার কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন
করেন। সেঞ্চুরি করার পর মিরাজও সিজদা দিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সম্ভবত প্রচণ্ড গরমে দীর্ঘক্ষণ
খেলায় তার পিঠে বা কোমরে ব্যথা হচ্ছিল। তাই তিনি ঝুঁকে সিজদা দেবেন কি না এ বিষয়ে সামান্য
কিছু সময় দ্বিধায় ভোগেন। আমার মনে হলো, পিঠে টান পড়তে পারে ভেবে তিনি হয়তো দ্বিধা করছেন।
কিন্তু কিছুক্ষণ পরই ব্যাট মাটিতে রেখে সিজদা দিলেন এবং তৃপ্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন।
বিষয়টি আমার মনে ছাপ ফেলেছে আবার অনুপ্রেরণাও জুগিয়েছে ভীষণ। আমরা অনেকেই সামান্য দ্বিধাবশত
অনেক কিছু করতে চাই না। তাই কোনো কাজ শঙ্কার হলেও উদ্যোগ নেওয়া দরকার। এজন্য চাই সদিচ্ছা।
আমি নিজেও এখন প্রার্থনার সময় সঠিকভাবে ঝুঁকি। দেখি আগের মতো অতটা অসুবিধা হচ্ছে না।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আজ কোনো খেলোয়াড় শয্যাগত হলে দেশের ক্ষতি নয় কি? একজন শিক্ষার্থী
পরীক্ষার আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে তার জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
নাগরিক পর্যায়ে নীতিনির্ধারকদের কাছে ডেঙ্গু বিষয়ে যে উত্তর প্রত্যাশিত তা পাওয়া যাচ্ছে না। সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ সময় জাতীয় সংকটকে নির্বাচনী প্রচারণা আকারে দেখালে সমস্যা। রক্তের জন্য, অক্সিজেনের জন্য হাসপাতালে ছোটাছুটি করে হয়রান যেন হতে না হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সবার চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আমি সরকারি-বেসরকারি সমাজসেবামূলক সংস্থাগুলোকে তাদের দায়বদ্ধতার কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। পাশাপাশি দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষকেও মনে করিয়ে দিতে চাই, অজুহাত দিয়ে ছাড় পাওয়ার চেষ্টা করা উচিত নয়। রাষ্ট্রে প্রতিটি মানুষের জীবনই অমূল্য। যার যার নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠ হতে হবে। ব্যর্থ হলে এর প্রতিবিধান নিশ্চিত করতে হবে। দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহির বিষয়টি থাকতে হবে অগ্রভাগে। সর্বাগ্রে জরুরি সুশাসন। সুশাসন নিশ্চিত হলে দায়বদ্ধতা, জবাবদিহি নিশ্চিত হতে বাধ্য। দায়িত্বশীলদের নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে অজুহাত খোঁজা মানে তা আরও বড় অন্যায়। ছোটবেলায় ‘গালিভারস ট্রাভেলস’ পড়েছিলাম। সেখানে লিলিপুটরা বিশালদেহী দৈত্যগোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধ করছিল। তখন এক লিলিপুট আরেক লিলিপুটকে বলে, ‘এত বড় লক্ষ্যে আমরা তির ভেদ করব কীভাবে?’ তখন অন্যজন জবাব দেয়, ‘এত বড় লক্ষ্যে তুমি নিশানা ভেদ না করার জায়গা পাচ্ছো কোথায়?’ দৃষ্টিভঙ্গি বদলের মাধ্যমে লিলিপুটরাই শেষে বিজয়ী হয়। আমরা যদি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাই তাহলে যে কোনো সংকট বা সমস্যার সমাধান করা কঠিন হবে না। সমন্বয় যেন কথার কথা হয়ে না থাকে। এরকম সংকটে সবচেয়ে জরুরি সমন্বয় ও যূথবদ্ধ প্রয়াস।