ফিরে দেখা
মযহারুল ইসলাম বাবলা
প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১২:৩৩ পিএম
মযহারুল ইসলাম বাবলা
সিপাহি বিদ্রোহের
প্রারম্ভিক সূত্রপাত বঙ্গদেশে। ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের ব্যারাকপুরের সিপাহিদের
প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রথম প্রকাশ্যে ইংরেজবিরোধী অভ্যুত্থানের ডাক দিয়েছিলেন সিপাহি
মঙ্গল পাণ্ডে। বিদ্রোহী মঙ্গল পাণ্ডেকে নিবৃত্ত করতে অস্ত্র উঁচিয়ে আসা দুই ইংরেজ অফিসার
অ্যাডজুট্যান্ট লেফটেন্যান্ট বাগ ও সার্জেন্ট মেজরকে প্রকাশ্যে হত্যা করে বিপ্লবের
সূচনা করেছিলেন সিপাহি মঙ্গল পাণ্ডে। সঙ্গীদের বিদ্রোহে অংশ নেওয়ার ডাক দিলেও, কেউ
সেদিন তাঁর সঙ্গী হয়নি। ব্যক্তিগত একজনের পক্ষে বিদ্রোহে জয়ী হওয়া যায় না। মঙ্গল পাণ্ডের
বিদ্রোহের প্রতি মানসিক-নৈতিক শতভাগ সমর্থনের পরও সঙ্গীরা কেউ সেদিন তাঁর সঙ্গী হয়নি,
অংশ নেয়নি বিদ্রোহে। পরিণতিতে সংগঠিত ইংরেজ বাহিনী কর্তৃক আক্রান্তের আগমুহূর্তে আত্মসমর্পণের
পরিবর্তে নিজ বন্দুকের গুলিতে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন মঙ্গল পাণ্ডে। গুলিবিদ্ধ মঙ্গল
পাণ্ডেকে ব্রিটিশ শাসকরা চিকিৎসায় সুস্থ করে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। ইংরেজ
অফিসারের আদেশ অমান্যের অভিযোগে অন্য ভারতীয় সিপাহি ঈশ্বরী পাণ্ডেকেও একই সঙ্গে ফাঁসিতে
ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। মঙ্গল পাণ্ডের বীরত্বপূর্ণ আত্মদান বিফলে যায়নি। এ ঘটনা সারা
ভারতবর্ষের সিপাহিদের মধ্যে প্রচণ্ড সাড়া জাগিয়েছিল। সিপাহি মঙ্গল পাণ্ডের আত্মদানে
উজ্জীবিত ভারতীয় সিপাহিরা সংঘবদ্ধভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সেনানিবাস-ব্যারাকে আক্রমণকারীর
ভূমিকায় সশস্ত্র বিদ্রোহ সংঘটিত করেছিল। মিরাট, দিল্লি, এলাহাবাদ, অযোধ্যা, লক্ষ্ণৌ,
কানপুর, ঝাঁসি, বারাণসী, পাটনা, বেরেলি প্রভৃত স্থানে সিপাহি বিদ্রোহ দাবানলের মতো
ছড়িয়ে পড়ে। ইংরেজ বাহিনী আত্মরক্ষার্থে দূরদূরান্তে পালিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে আত্মগোপনে
বাধ্য হয়। উল্লিখিত অঞ্চলসমূহে সিপাহিদের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব-নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
বঙ্গদেশে সিপাহি
বিদ্রোহের প্রবল সম্ভাবনার পরও কোথাও বিদ্রোহ সংঘটিত হতে পারেনি। একমাত্র হয়েছিল চট্টগ্রামে।
চট্টগ্রামের বিদ্রোহী সিপাহিরা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল। ১৮৫৭ সালের ১৮ নভেম্বর রাতে চট্টগ্রামের
৩৪ নম্বর রেজিমেন্টের সিপাহিরা বিনা রক্তপাতে পরাভূত করেছিল ইংরেজ বাহিনীকে। আত্মসমর্পণকারী
ইংরেজদের হত্যা না করে অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, কারাগারের সব বন্দিকে মুক্তি, ব্যারাক আগুন
দিয়ে পুড়িয়ে, অস্ত্রাগার বিস্ফোরণে উড়িয়ে, বিপুল সরকারি অর্থ লুণ্ঠন করে চট্টগ্রাম
শহরে বেরিয়ে আসে বিদ্রোহী সিপাহিরা। লুণ্ঠিত অর্থ তিনটি হাতি ও দুটি ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে
বিদ্রোহের নেতা হাবিলদার রজব আলী খাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম ত্যাগ করে স্বাধীন (করদরাজ্য)
ত্রিপুরা রাজ্য অভিমুখে রওনা হয়। ত্রিপুরার শাসনকর্তা স্থানীয় মহারাজা ঈশ্বরচন্দ্র
মাণিক্য। ত্রিপুরা সরাসরি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনাধীনে ছিল না। হাবিলদার
রজব আলী খাঁ বিদ্রোহ আরও ব্যাপক বিস্তৃত করার লক্ষ্যে স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্য বেছে
নিয়েছিলেন এই ভেবে, ইংরেজমুক্ত মহারাজার নিয়ন্ত্রিত স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যে তাদের
আশ্রয়ের সংকট হবে না। সেখান থেকে রাজ্যে রাজ্যে বিদ্রোহ ছড়িয়ে ইংরেজমুক্ত স্বাধীন ভারতবর্ষ
প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে পারবে। এ উদ্দেশ্যে বিদ্রোহী সিপাহিরা সংঘবদ্ধভাবে
সীতাকুণ্ড পেরিয়ে পাহাড়-জঙ্গলের পথ ধরে ত্রিপুরা অভিমুখে যাত্রা করেছিল। কিন্তু বিধিবাম!
ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের সিপাহি বিদ্রোহের সংবাদ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। চট্টগ্রামের বিদ্রোহী
সিপাহিদের শায়েস্তা ও নির্মূলে ইংরেজ বাহিনী ত্রিপুরার মহারাজাকে হুকুম প্রদান করে।
ত্রিপুরার মহারাজা ইংরেজ কোম্পানি শাসনের অনুগত এবং চরম আজ্ঞাবহ। তাই মহারাজা চট্টগ্রামের
বিদ্রোহী সিপাহিদের দমন অভিযানের দ্রুত প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ইংরেজ শাসনামলে ভারতীয়
রাজা, মহারাজা, নবাব, জমিদার সবাই ছিল ইংরেজ অনুগত। ব্যতিক্রম দুয়েকজন যে ছিল না, তা
নয়। যেমন ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাই। তিনি এই সিপাহি বিদ্রোহে বীরবিক্রমে ইংরেজদের বিরুদ্ধে
লড়াই করে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। অন্যদিকে হায়দরাবাদের নিজাম, সিন্ধিয়া, গায়কোয়ার, ভোপালের
বেগম, কাশ্মীরের গোপাল সিং, ত্রিপুরার মহারাজা প্রমুখ কার্যত ছিলেন ইংরেজদের হুকুমের দাস।
চট্টগ্রামের সিপাহিরা
ত্রিপুরা রাজ্যে প্রবেশের মুখে আক্রান্ত হয় মহারাজার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে। আচানক
অনভিপ্রেত আক্রমণে অনেক সিপাহি মারা যায়। অনেকে হয় বন্দি। ত্রিপুরার মহারাজার বাহিনী
দ্বারা আক্রান্তে তিনটি হাতিসহ লুণ্ঠিত প্রচুর অর্থ খোয়া যায়। এমন শোচনীয় পরিস্থিতিতে
দিগ্দিশাহীন চট্টগ্রামের সিপাহিদের সংগঠিত অংশটি ত্রিপুরার পরিবর্তে কুমিল্লার পাহাড়ের
পথ ধরে মণিপুর রাজ্যের দিকে অগ্রসর হয়। সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল আরও কঠিন বিপদ।
মণিপুর রাজ্য অভিমুখে সিলেটে চট্টগ্রামের সিপাহিদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে ইংরেজ মেজর
বাইঙ্গের নেতৃত্বে সুসজ্জিত পদাতিক বাহিনী। মেজর বাইঙ্গের অধীনে থাকা ভারতীয় শিখ সম্প্রদায়ের
সিপাহিদের কাছে চট্টগ্রামের সিপাহিরা সাহায্য-সহযোগিতার আকুল আবেদন জানিয়েও সাড়া পায়নি।
বিপরীতে তারা চট্টগ্রামের সিপাহিদের ওপর সর্বশক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মেজর বাইঙ্গের নেতৃত্বে
লাতু নামক স্থানে প্রচণ্ড যুদ্ধে মেজর বাইঙ্গ নিহত হয়। সিলেটের পদাতিক বাহিনীর উপর্যুপরি
আক্রমণে চট্টগ্রামের প্রচুর সিপাহি মৃত্যুবরণ করে। ইংরেজ নেতৃত্বের বিশাল সাঁজোয়া বাহিনীর
সঙ্গে দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ক্লান্ত-অবসন্ন চট্টগ্রামের সিপাহিদের পক্ষে যুদ্ধজয় ছিল অসম্ভব।
নিশ্চিত পরাজয় উপলব্ধি করেই বেঁচে যাওয়া সিপাহিরা আত্মরক্ষার্থে লাতু ও মণিপুরের বিস্তীর্ণ
জঙ্গলে ঢুকে যায়।
মনোবলহারা চট্টগ্রামের
সিপাহিদের বেঁচে যাওয়া যে অংশটি জঙ্গলে ঢুকে পড়েছিল, তাদের শেষ পরিণতি কী হয়েছিল, তা
আর জানা সম্ভব হয়নি। এভাবেই বঙ্গদেশে একমাত্র সংঘটিত চট্টগ্রামের সিপাহি বিপ্লবের পরিসমাপ্তি
ঘটে। সিপাহি বিদ্রোহের বীরত্বপূর্ণ অবদানের ধারাবাহিকতায় ১৯৩০ সালের চট্টগ্রাম যুব
বিদ্রোহ। ব্রিটিশবিরোধী লড়াই-সংগ্রামে অগ্নিযুগের বীরপুরুষ মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে
চট্টগ্রামের বীরসন্তানরা পরাক্রমশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল ১৯৩০
সালের এপ্রিলে। দেশপ্রেমের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগের নজির দেশ ও জাতির জন্য অনুকরণীয়
দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল বীরচট্টলা। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল থেকে পরবর্তী তিন দিন চট্টগ্রাম
ছিল স্বাধীন, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত। ওই তিন দিন চট্টগ্রামে উড়েছিল স্বাধীন ভারতবর্ষের
পতাকা। চট্টগ্রামের স্বদেশি সশস্ত্র বিপ্লব ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবান্বিত
স্মারক। দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ-পরবর্তী তিন দিন চট্টগ্রাম ছিল পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত, স্বাধীন। ওই তিন দিনও চট্টগ্রামে উড়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রসংবলিত পতাকা। মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের অসামান্য ভূমিকা-অবদান-বীরত্ব অতীতের ধারাবাহিকতার সূত্রে গাঁথা। কোনোটি কোনোটির থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, সংলগ্ন অবশ্যই। আমাদের স্বাধীনতা ও জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সব পর্বে চট্টগ্রামের বীরত্বপূর্ণ অবদান ইতিহাসস্বীকৃত।