× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

নির্বাচন ও রাজনীতি

অগ্রভাগে থাকুক জননিরাপত্তার কৌশল

ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ

প্রকাশ : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৪:০৯ পিএম

অগ্রভাগে থাকুক জননিরাপত্তার কৌশল

তুরস্কের জনপ্রিয় নাট্যকার, ঔপন্যাসিক ও লেখক মেহমেত মুরাত ইলডান নির্বাচন নিয়ে বেশকিছু মন্তব্য করে সাড়া ফেলেছিলেন। তার মতে, কোনো দেশে নির্বোধ মানুষের ভোটে একটি নির্বোধ সরকার গঠিত হওয়ার সবচেয়ে বড় উপকারিতা হলো সেই দেশে থাকা মোট নির্বোধের সংখ্যা জানা যায়। তিনি আরও বলেছেন, ‘তুমি যদি এমনই নির্বোধ হও যে, শয়তান ও ফেরেশতার মধ্যেও পার্থক্য বোঝো না, তবে খুব তাড়াতাড়িই তুমি শয়তানকে দেখতে পাবে। আর গণতন্ত্রে অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে নির্বাচনের ঠিক পরেই এমনটি ঘটে।’ তার এই বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক আছে, দ্বিমত আছে এবং তা গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারে। তবে বলা বাহুল্য, এমন অনাকাঙ্ক্ষিত, বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন তখনই সম্ভব যখন নির্বাচনের আগে, নির্বাচন চলাকালে এবং নির্বাচনের পরপর দেশের সম্পদ ও জনজীবনে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

পৃথিবীজুড়ে নির্বাচনে সহিংসতার ইতিহাস অনেক পুরোনো। আজ থেকে ১০৩ বছর আগের কথা। বর্তমান বিশ্বে গণতন্ত্রের সবক শেখানো দেশ যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের ওকোই এলাকার শ্বেতাঙ্গরা তখনও সেখানকার কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়া বা ভোট প্রদানের অধিকার মেনে নিতে পারেনি। তার পরও ২০২২ সালের ২ নভেম্বর অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ওকোইর কৃষ্ণাঙ্গ ভোটাররা দলে দলে ভোট দিতে যায়। এতে উত্তেজিত শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর আক্রমণ করে এবং তাদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রভৃতি জ্বালিয়ে দেয় ও তাদের এলাকাছাড়া করে। এ নির্বাচনের দিনই কয়েক ডজন কৃষ্ণাঙ্গের লাল রক্তে সিক্ত হয় ওকোইর জমিন। যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথ সোনিয়ান ম্যাগাজিনে লেখা ১৩ নভেম্বর, ২০২০-এর ভাষ্যমতে, সেদিন কৃষ্ণাঙ্গদের বাড়িঘরের পাশাপাশি দুটি চার্চও পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং কোনো কোনো কৃষ্ণাঙ্গকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করে টেলিফোন তারের খাম্বার সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়। তবে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা জানতেও পারেনি কেউ। ২০১৮ সালের ২৫ জুলাই পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের ১২ দিন আগে (১৩ জুলাই, শুক্রবার) বেলুচিস্তান প্রদেশের মাসটাং শহরে বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টি আয়োজিত নির্বাচনী সভায় বিস্ফোরণ ঘটে। এতে দলটির এমপি প্রার্থী সিরাজ রাইসানিসহ ১২৮ জনের মৃত্যু ঘটে। ২০১১ সালের ১৬ এপ্রিল নাইজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। এ নির্বাচনের পরবর্তী তিন দিনে সেখানকার উত্তরাঞ্চলের ১২ জেলায় সহিংসতায় অন্তত ৮০০ জনের মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। তিন দেশের এই তিনটি পৃথক ঘটনায় অঙ্গ হারানো, শারীরিকভাবে আহত ও মানসিকভাবে অসুস্থতার সংখ্যা অজানা থাকলেও এ সংখ্যা যে কয়েক হাজার পেরিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে নির্বাচনের দিন এবং নির্বাচনের আগে ও পরে সহিংসতা একটি নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর তথাকথিত বিজয়-উল্লাসের ক্ষত (বিএনপি-জামায়াত জোট) আজও শুকায়নি। এখানে নির্বাচন করতে গিয়ে কেউ আহত হলেও শীর্ষপদ থেকে জিজ্ঞাসা করা হয়Ñ ‘উনি কি ইন্তেকাল করেছেন?’ ইদানীং টেলিভিশন টকশো ও বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচন থেকে শুরু করে অতি সম্প্রতি ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনকে উপজীব্য করে নানা অভিযোগ দেখা যায়। এর মধ্যে প্রার্থী ও সমর্থকদের গুম-খুন, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, মামলা, হামলা, নমিনেশন পেপার উত্তোলন ও জমাদানে বাধা কিংবা নির্বাচন করতে না চাইলেও করতে বাধ্য করা ইত্যাদি ঘটছে ভোটের আগেই। নির্বাচনের দিন কেন্দ্রে যাওয়ার রাস্তায় সহিংসতা, ভোটব্যাংক নামে সুপরিচিত নির্দিষ্ট কিছু গ্রাম বা এলাকা ঘিরে রেখে ভোটারদের ঘর থেকে বের হতে না দেওয়া, কেন্দ্রে সহিংসতা ছড়িয়ে ভোটারদের ছত্রভঙ্গ করা ও বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য করার অভিযোগও নতুন নয়। গোপন কক্ষে ডাকাতের উপস্থিতি ও ইভিএমে ভোটারদের পরিবর্তে ডাকাতের ভোটদান, ব্যালট পেপারে জোর করে গণহারে সিল মারা, ভোটবাক্স চুরি, ব্যালট পেপার ছিনতাই, একের ভোট অন্যকে দিয়ে প্রদান ও শিশুদের দিয়ে ভোট প্রদানের মতো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভোটের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে শান্তিপ্রিয় মানুষ-এসবও নতুন কথা নয়। ভোট না দিয়ে ঘরে বসে থাকলেও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নেই। কোনো প্রার্থী বা দলের সমর্থকরা যদি মনে করেন নির্দিষ্ট কোনো এলাকার বাসিন্দারা তাকে ভোট দেয়নি, তবে তাদের ওপর চলে নির্যাতন। অতীতে নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের একটি গ্রামে বিপক্ষদলের আক্রমণ ও শিশু ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটেছে। নির্বাচন প্রতিহত করার নামে অগ্নিসন্ত্রাস তথা যাত্রীবাহী গাড়িতে আগুন দিয়ে জনগণের জানমালের নৃশংস ক্ষতি, ভোটকেন্দ্র স্কুল পুড়িয়ে দেওয়া, ট্রেন, রেলস্টেশন, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও অন্যান্য সরকারি ভবনে অগ্নিসংযোগ, প্রিসাইডিং অফিসার ও অন্য ভোট কর্মকর্তাদের হুমকি এবং তাদের ওপর আক্রমণের মতো ঘটনা কলঙ্কিত করেছে এ দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাপনা ও গণতন্ত্রচর্চা।

বাংলাদেশের নির্বাচন অনেক ক্ষেত্রেই কোনো কোনো বিশেষ গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের কাছে সাক্ষাৎ আতঙ্কের নাম। এ দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সাধারণভাবে একটি বিশেষ দলের ভোটব্যাংক হিসেবে গণ্য করা হয়। তাই অনেক ক্ষেত্রেই ভোটের দিন তাদের পাড়ামহল্লা ঘিরে রাখে বিরোধী শিবিরের সদস্যরা। তা ছাড়া ঝুঁকির মধ্যে থাকে তিনটি পার্বত্য জেলার সাধারণ উপজাতীয় জনগণ। অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে আসা অস্ত্রের শক্তিতে বলীয়ান স্থানীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সরকারের অসারত্ব ও নিজেদের আধিপত্য প্রমাণ করতে সুস্থ ভোট আয়োজনে এবং ভোটার উপস্থিতিতে বাধা দেয়। চাঁদপুরে বিশেষ এক পীরের অনুসারীদের মধ্যে একটি বড় অংশ মহিলাদের ভোটদানে বিরত রাখে। ফলে ভোটের দিনটি নানা আশঙ্কায় কাটে একশ্রেণির মানুষের।

আসলে আমরা কী ধরনের উন্নয়ন চাই, কাদের জন্য কী ধরনের উন্নয়ন দরকার এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা ও বিশ্লেষণক্রমে এগোনো দরকার। মানুষের উন্নয়ন ধারণা কী তা বুঝতে হবে সবার আগে। উন্নয়নের অগ্রভাগে থাকবে জননিরাপত্তা নিশ্চিত নিশ্চিত করার বিষয়টি। তুলনামূলকভাবে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এখনও অনেক নিরাপদ। তবে এতে আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস হচ্ছে ষড়যন্ত্রের। বিগত দিনে ভুল রাজনীতি ও হঠকারিতার জন্য রাজনীতির এক বড় পক্ষ এখন ব্যাকফুটে। সেখান থেকে বের হওয়ার কোনো রাস্তা তারা খুঁজে পাচ্ছে না। তাই তারা পথ খোঁজে ষড়যন্ত্রের। আর এর জন্য তাদের কাছে উপযুক্ত নির্বাচনকালীন কিংবা এর আগে-পরের সময়। আবারও বলি, ২০০১ সালের নির্বাচন-উত্তর মানবতাবিরোধী ঘটনাবলি এর কদর্য প্রমাণ।

নতুন উপসর্গ হলো ভোটের আগে ও পরে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা আরোপ। সুষ্ঠু ভোট আয়োজনে ব্যর্থতার দায়ে অতি সম্প্রতি সিয়েরা লিওন এমন নিষেধাজ্ঞা পেয়েছে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র একই কারণে একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে আরও কিছু ব্যক্তি, বাহিনী ও দেশের ওপর, যার প্রভাব পড়ে জনজীবনে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অর্ধশতবর্ষী সাময়িকী ফরেন পলিসি ২৪ জুলাই, ২০২৩ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত তথ্যের ভিত্তিতে লিখেছে, বর্তমানে কিউবা, ইরান, উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া, সিরিয়া ও ভেনেজুয়েলা এ ছয়টি দেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ ছাড়া যে ১৭টি দেশের নির্দিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সেগুলো হলো আফগানিস্তান, বেলারুশ, কঙ্গো, ইথিওপিয়া, ইরাক, লেবানন, লিবিয়া, মালি, নিকারাগুয়া, সুদান ও ইয়েমেন প্রভৃতি। সিয়েরা লিওন বা বাংলাদেশের নাম এ তালিকায় না থাকলেও পৃথক আদেশে উভয় দেশের কতিপয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর এ নিষেধাজ্ঞা বিদ্যমান। যুক্তরাষ্ট্রের পরিপূর্ণ নিষেধাজ্ঞার ফলে একটি দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের তথা অন্য অনেক দেশের আর্থিক লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। তখনই ব্যবসাবাণিজ্যে মন্দা ও শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরি হয়, যা জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করে।

বাংলাদেশে ২০২৪ সাল শুরু হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক প্রাক্কালে। নতুন বছরের শুরুটা নিরাপদ করতে হলে দেশ ও জনগণের নিরাপত্তায় বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। ঘোষণা দিয়ে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান এবং নির্বাচনের ঠিক আগে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামালেই জননিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না। এজন্য প্রকাশ্যে ও গোপনে নানা ধরনের কৌশল প্রয়োগ করা বাঞ্ছনীয়। এসব কৌশল দায়িত্বপ্রাপ্তরা ভালোভাবেই জানেন। সেই কৌশলগুলো বাস্তবে আন্তরিকতার সঙ্গে প্রয়োগ করেই দেশের জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সব পক্ষের সদিচ্ছা ও সক্ষমতা প্রমাণ করতে হবে।

 

  •  অবসরপ্রাপ্ত মেজর, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গবেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা