সম্পাদক
প্রকাশ : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১১:০৫ এএম
বাংলা প্রবাদে আছে, ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়। দেশের উপকূলবাসীর
নিত্যঝুঁকির জীবনযাপনে এই উদ্ধৃতিই যেন সত্য। উপকূলবাসীর জীবনযাপন ঝুঁকিমুক্ত করতে
এ পর্যন্ত কথা হয়েছে বিস্তর কিন্তু কাজের কাজ কতটা কী হয়েছে, এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজাও
জরুরি। উপকূলবাসী সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ডরায়Ñ ৯ সেপ্টেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ‘প্রাণহানির
শঙ্কা নিয়ে ৩ লাখ মানুষের বসবাস’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিই যেন এর সমার্থক। প্রতিবেদনে
লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগর উপজেলার মেঘনা নদীর তীরবর্তী ১২টি ইউনিয়নের প্রায় ৩ লাখ
মানুষ কী ভয়াবহ জীবনঝুঁকিতে রয়েছে, তা-ই উঠে এসেছে। পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র ও বেড়িবাঁধ
না থাকায় ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, বন্যাসহ যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে রামগতি ও কমলনগর উপজেলাবাসী
ভয়ে থরথর করে।
আমরা জানি, উপকূলবাসীর জীবনযুদ্ধ কত কঠিন। প্রকৃতির রুদ্ররোষ তো আছেই,
এর পাশাপাশি তাদের জীবন-জীবিকার যুদ্ধও চালাতে হয় চরম প্রতিকূলতায়। লক্ষ্মীপুরের ওই
দুই উপজেলার চরকালকিনি, সাহেবেরহাট, চরমার্টিন, চরলরেন্স, চরফলকম, পাটারিরহাট, চরআলগি,
চররমিজ বড়খেরি, চরগাজীসহ ১২টি ইউনিয়ন এবং রামগতি পৌরসভা মেঘনার তীরে অবস্থিত। বিস্তীর্ণ
এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে আশ্রয় নেওয়ার জন্য আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে মাত্র ৪৪টি। প্রাকৃতিক
দুর্যোগের কোনো আভাস পেলেই এসব জনপদের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। আমরা জানি, দেশের বিস্তীর্ণ
উপকূলীয় অঞ্চলেই বেড়িবাঁধ নিয়ে প্রশ্ন আছে। যা আছে তা-ও জীর্ণশীর্ণ। অনেক এলাকায় নেই
আশ্রয়কেন্দ্রও। কিন্তু লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগর উপজেলার মেঘনার তীরবর্তী মানুষদের
জীবনচিত্র আরও বেশি ঝুঁকির মুখে। রামগতি পৌর এলাকায় সাড়ে চার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ
করা হলেও বাকি এলাকা উন্মুক্ত থাকায় সেখানে বসবাসরত বিপুলসংখ্যক মানুষের দুর্যোগ-ঝুঁকি
রয়েই গেছে।
অতীতে ঘূর্ণিঝড় উপকূলের জনজীবন ভয়াবহভাবে তছনছ করে দিয়েছে। কোনো কোনো
উপকূলীয় এলাকায় মানুষ সবই হারিয়ে উদ্বাস্তুর তালিকায় নাম লিখিয়েছে। আবার অনেক স্থানে
এখনও দুর্যোগের ক্ষত দৃশ্যমান। প্রাকৃতিক দুর্যোগে হতদরিদ্র মানুষই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত
হয়। নদীভাঙন আমাদের দেশে নদীতীরবর্তী মানুষের সামনে আরেক মূর্তিমান আতঙ্ক। নদীভাঙনে
উদ্বাস্তুর তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। লক্ষ্মীপুরের মেঘনার তীরবর্তী মানুষও এ থেকে
বিচ্ছিন্ন নয়। ত্রুটিপূর্ণ নদীশাসন ব্যবস্থাপনা, দখল ইত্যাদির বহুমুখী নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের
প্রভাব আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে উপকূলঘেষা কিংবা উপকূলের নদীঘেঁষা জনপদগুলোকে।
লক্ষ্মীপুরের উপকূলবাসী তো বটেই সামগ্রিকভাবে দেশের উপকূলে বসবাসরত মানুষরা দরিদ্র।
সরকারের সামাজিক নিরাপত্তাজালের অধীনে যেসব কর্মসূচি আছে উপকূলে এরও যথাযথ বাস্তবায়ন
নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। দেশের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলে একদিকে রয়েছে জীবন-জীবিকার চরম সংকট,
অন্যদিকে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস-বন্যার নিষ্ঠুর কশাঘাত। লবণাক্ততা গ্রাস করে ফেলেছে উপকূলীয়
জেলাগুলোর কৃষিজমি। ব্যাহত হচ্ছে চাষাবাদ। বেকার হয়ে পড়ছেন উপকূলের কৃষিজীবী ও শ্রমিকরা।
মিঠাপানির উদ্ভিদ ও ফলের গাছও মরে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে মিঠাপানির মাছসহ অন্যান্য
জলজ প্রাণী। নলকূপে উঠে আসছে লোনাপানি। অতিরিক্ত লবণাক্ততা জনস্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব
ফেলছে। ক্রমেই বাড়ছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। এর বাইরে আমরাও নই। আর উপকূলবাসীর জন্য তা ‘মড়ার
উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এসব কিছুর বৈরী প্রভাব থেকে উপকূলবাসীকে রক্ষায় ইতোমধ্যে কর্মপরিকল্পনা
কম নেওয়া হয়নি বটে কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবায়নচিত্র আশাব্যঞ্জক নয়। উপরন্তু সরকারের
গৃহীত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের অনিয়ম-অস্বচ্ছতা-দায়িত্বহীনতা-উদাসীনতার
অভিযোগও কম নয়। এমন প্রেক্ষাপটে চরম প্রতিকূল অবস্থায় বসবাসকারী উপকূল কিংবা বড় বড়
নদীর তীরবর্তী মানুষদের জীবনযাপনের পথ কতটা বিপদসঙ্কুল, এর আর বিশদ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের
প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। আমাদের বক্তব্য, দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির সুষম চিত্র উপকূলেও
দৃশ্যমান হোক। প্রাকৃতিক বৈরী আচরণ থেকে উপকূলবাসীকে রক্ষার সব রকম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। তাদের কৃষিপণ্য উৎপাদনের পথ মসৃণ করার পাশাপাশি তাদের জন্য
কর্মসৃজনের ব্যবস্থা করাও সমভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সর্বাগ্রে প্রয়োজন জীবনের নিরাপত্তা
নিশ্চিত করা। বেড়িবাঁধসহ নদীভাঙন রোধে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনার দ্রুত বাস্তবায়ন
করতে হবে, যাতে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য একটি অংশের জীবনযাপনের সার্বিক নিরাপত্তা
নিশ্চিত হয়। অরক্ষিত উপকূলের সুরক্ষায় কথা হয়েছে বিস্তর। কিন্তু কাজের কাজ হয়েছে অনেক
কম। সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে প্রাধান্য পাক উপকূলের জনজীবন। আমরা মনে করি, জীবনযাপনের
ক্ষেত্রে সুষম চিত্র যদি দৃশ্যমান করা না যায় তাহলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না।