ভূরাজনীতি
ড. ফরিদুল আলম
প্রকাশ : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১১:০২ এএম
ড. ফরিদুল আলম
জি-২০ সম্মেলনে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণকে দেশি-বিদেশি বিশ্লেষকরা বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক
গুরুত্ব বাড়ার নজির হিসেবে দেখছেন। ইতোমধ্যে শেখ হাসিনা-নরেন্দ্র মোদি বৈঠকে কয়েকটি
সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। আঞ্চলিক শান্তি ও সহযোগিতার বিষয়ে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী
একমত হয়েছেন এবং দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক আরও ভালো হবে, এমনটিই আমাদের প্রত্যাশা।
জি-২০ আঞ্চলিক জোটে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র সদস্য রাষ্ট্র ভারত। এবারই প্রথম জি-২০ সম্মেলন
অনুষ্ঠিত হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায়। জি-২০ জোটে ভারতের সদস্যপদ থাকায় দক্ষিণ এশিয়া ভূরাজনৈতিক
প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল। ভুলে গেলে চলবে না, দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ
রাষ্ট্র ভারত সমগ্র এশিয়াতেও চীনের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র বলে অভিহিত। ভারতের
সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সম্প্রতি নতুন মাত্রা পেয়েছে এবং এ বিষয়ে প্রতিদিনের
বাংলাদেশ-এ এই স্তম্ভেই কিছুদিন আগে লিখেছি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের আদর্শগত দ্বন্দ্ব
স্পষ্ট দেখা যায়। মাল্টিপোলার বিশ্বে ভূরাজনীতির সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বার্থও ক্রমেই জড়িয়ে
পড়ছে।
২০০০ সাল থেকেই
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কৌশলগত পদ্ধতি অনুসরণ করে চলেছে। এই কৌশলগত অবস্থানের
কারণে ভারতের চাওয়া-পাওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ভারত-মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র সম্মিলিতভাবে যদি ভূরাজনীতি ও অর্থনীতিকে প্রভাবিত করতে চায়, তাহলে তাদের
পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে নির্ভরযোগ্য সহযোগী প্রয়োজন হবে। আর দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র বাংলাদেশই
ভারতের নির্ভরযোগ্য সহযোগীর ভূমিকা পালন করতে পারে। বিগত এক দশকে অর্থনীতি থেকে শুরু
করে বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় অগ্রগতি দেখিয়েছে। এই এক দশকে রাজ্যশাসন স্থিতিশীলতাও
অর্জিত হয়েছে। বর্তমান সরকারের সঙ্গে ভারতের চমৎকার বোঝাপড়াও সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায়
স্পষ্ট হয়েছে। মূল কথা হলো, চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
সঙ্গে সম্মিলিতভাবে ভূরাজনীতি ও অর্থনীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে। আর যখন ভারত
নিজের এই ভূরাজনৈতিক প্রভাব দেখাতে চাইবে তখন তার দু-চারটি বিশ্বস্ত সহযোগী রাষ্ট্র
প্রয়োজন হবে। কাজেই ভারত তাদের নিজ স্বার্থেই বাংলাদেশের আস্থা অর্জন করার চেষ্টা করবে।
জি-২০-এর সভাপতিত্ব থাকায় ভারত বাংলাদেশকে এই সম্মেলনে আহ্বান করেছে, যা অবশ্যই বাংলাদেশের
ভৌগোলিক গুরুত্বকে নির্দেশ করে। এই সম্মেলনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বিশ্বের সামনে বাংলাদেশ
কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেই বার্তারই প্রতিফলন।
বাংলাদেশকে ঘিরে
বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রেরই কিছু অস্বস্তি রয়েছে। জি-২০ সম্মেলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে
ঘিরে বিভিন্ন রাষ্ট্রের থাকা অস্বস্তি অনেকাংশে দূর হবেÑ এমন প্রত্যাশা ভুল কিছু নয়।
এই সম্মেলনে আমন্ত্রিত বিভিন্ন রাষ্ট্র ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক ও আলোচনার মাধ্যমে
কূটনৈতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ তৎপরতা চালাতে পারবে। জি-২০ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা নানা বৈঠকে অংশ নিচ্ছেন। সংবাদমাধ্যম এই বৈঠককে নানাভাবে বিশ্লেষণ করছে। সংবাদমাধ্যমে
ইতিবাচক-নেতিবাচক দুই ধরনের বিশ্লেষণই দেখতে পাওয়া যায়। কে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ
করছে সেটিই গুরুত্বপূর্ণ। মাত্র দুই দিন আগে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ
বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। সফরে এসে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর সমালোচনা এবং সরকারের প্রশংসা
করে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যকে আশঙ্কাজনক মনে করছে দেশের অন্যতম প্রধান
বিরোধী দল বিএনপি। যদিও এখানে আশঙ্কার কোনো কারণ নেই।
বৃহৎ শক্তিগুলোর
মর্যাদার লড়াইয়ে বাংলাদেশের নিরপেক্ষ অবস্থান আমাদের ক্ষমতার বলয়ের ক্ষেত্র হতে দেবে
না। ভুলে গেলে চলবে না, রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কৌশলগত। রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক
চুক্তি হয়েছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে চুক্তি হয়েছে। এই কৌশলগত
সম্পর্কটি গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের যত চাপই দিক, আমাদের অর্থনৈতিক
ও রাজনৈতিক স্বার্থে রাশিয়ার সঙ্গে এই সম্পর্ক ধরে রাখতে হবে। এ কথা বিশ্ব শক্তিরাও
জানে। একাত্তর-পরবর্তী সময়ের যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ আজ আর নেই। আমরা অর্থনৈতিক
অগ্রগতির পাশাপাশি রাজ্যশাসন স্থিতিশীলতা অর্জন করতে পেরেছি। রাশিয়া-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-চীনের
তা অজানা নয়। জি-২০ সম্মেলনের পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ বাংলাদেশ সফরে
আসবেন। এটিও একটি ইতিবাচক বার্তা। আজকের বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৫টি উদীয়মান অর্থনীতির
দেশ বলে পরিচিত । তাই বাংলাদেশকে ক্ষমতার বলয়ে ব্যবহারের চেষ্টা অতীতের মতো আর
সহজ নয়। আশি-নব্বই দশকের প্রেক্ষাপটে আমরা মাল্টিপোলার বিশ্বকে বোঝার চেষ্টা করতে গেলে
আশঙ্কা কাজ করবেই। ৯ সেপ্টেম্বর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, ই আইইউয়ের প্রতিবেদনে ২০৪০ সালের
মধ্যে শীর্ষ ২০ অর্থনীতির একটী দেশ হবে বাংলাদেশ।
‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব,
কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’Ñ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চিন্তাপ্রসূত কূটনীতির
এই মূলমন্ত্রই ভূরাজনীতিতে আমাদের নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখতে সাহায্য করছে। বিভিন্ন
রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে কূটনৈতিক কৌশল ও নিরপেক্ষতা
বজায় রাখে। আমরা নানা সময়ে যুক্তি দিয়ে অন্য রাষ্ট্রকে বোঝাতে পারছি আমাদের জাতীয় স্বার্থেই
আমরা যেকোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখব। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই
স্থিতিশীলতা এবং পররাষ্ট্রনীতির দৃঢ়তা আমাদের কাঙ্ক্ষিত সাফল্য এনে দিতে পারছে। অর্থাৎ
আমাদের পররাষ্ট্রনীতি আমাদের সক্ষমতার বিষয়টি তুলে ধরে। ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির
দৃঢ়তা এবং আমাদের সক্ষমতার একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। জি-২০ সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ভীষণ ব্যস্ত থাকবেন। এই ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করবেন। অর্থাৎ এত ব্যস্ততার মধ্যেও বাংলাদেশকে ঘিরে তাদের স্বার্থ
তো রয়েছে বটেই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শেখ হাসিনার সঙ্গে সেলফি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে
ইতোমধ্যে ভাইরাল হয়েছে। এরও গুরুত্ব কম নয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশের গুরুত্বের বিষয়টি
ফের নতুন করে স্পষ্ট হলো। কারণ রাশিয়ার সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক রাখার পাশাপাশি বাংলাদেশকে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ব্যাপক গুরুত্ব দিচ্ছে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ
বিষয় নিয়ে বিদেশিদের আগ্রহ বেড়েই চলেছেÑ এমন একটি অভিযোগ প্রায়ই পাওয়া যায়। তবে আমার
মনে হয় না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিংবা ভারত বাংলাদেশের নির্বাচন ও
অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোতে নাক গলাতে ইচ্ছুক। বিদেশিরা আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে থাকা মানবাধিকার
ও গণতন্ত্র নিয়ে প্রায়শই মন্তব্য করছেন। এমন মন্তব্য তারা করছেন কারণ দেশের প্রধান
বিরোধী দল বিএনপি এবং তাদের সহযোগী দলগুলোর নেতাদের মুখে এমন বক্তব্যই উঠে আসছে। আমরা
লক্ষ করব, বিরোধী দলের একাংশ সরকারবিরোধী প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর জন্য বিগত কয়েক বছর প্রচুর
শ্রম ব্যয় করেছে। আর এই প্রোপাগান্ডা বাইর থেকে দেখে বিভিন্ন সময় বিদেশিরা মন্তব্য
করেছেন। ইদানীং মনে হচ্ছে, এ বিষয়গুলো নিয়ে বিদেশিরা বক্তব্য দিতে গেলে ভীষণ বিব্রতবোধ
করছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছে। তারা বলেছে,
বাংলাদেশের নির্বাচনে এই দুই দেশের কোনো প্রভাব থাকবে না। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যার
সমাধান এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সুসংহত করার দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে।
তাই বিদেশিদের বিষয়টি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের পথ খুঁজে নিতে হবে।
সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের জন্য সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু কোনো দল
যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে এবং অযৌক্তিক রাজনৈতিক দাবি করে তাহলে রাজনৈতিক সংকট
দূর হবে না। বরং দেশের ভাবমূর্তি নানাভাবে ক্ষুণ্ন হবে।
জি-২০ সম্মেলন শেষে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ বাংলাদেশ সফরে আসবেন। ৩৩ বছর পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর গুরুত্বসহকারে আলোচিত হচ্ছে। তবে কারও কারও মতে, আফ্রিকা ও ইউরোপে প্রভাব থাকলেও দক্ষিণ এশিয়া ও এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে ফ্রান্সের কোনো প্রভাব নেই। তাই ফ্রান্সের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের রূপায়ণ সম্পর্কে কেউ কোনো ধারণায় পৌঁছাতে পারছে না। ভুলে গেলে চলবে না, ফ্রান্স জি-৭ জোটভুক্ত রাষ্ট্র। তা ছাড়া জাতিসংঘেও তাদের ভেটো ক্ষমতা রয়েছে। ফ্রান্সে মাখোঁ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মুখে থাকলেও দেশটিতে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ঠিক রয়েছে। ফ্রান্সে অনেক বাংলাদেশি রয়েছেন। তাই ফ্রান্সের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে উঠলে আমরা নানাভাবে উপকৃত হব। তা ছাড়া পশ্চিমা বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে ফ্রান্স এদিকে আসতে চাওয়া ইতিবাচকভাবেই দেখতে হবে। পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে যে ধারণা পোষণ করে বলে আমরা মনে করছি, সে জায়গা থেকে ফ্রান্স নিজের অবস্থান আমাদের কাছে স্পষ্ট করতে চাচ্ছে। অবশ্য কী হবে তা মাখোঁর সফরের পরই আমরা বুঝতে পারব।