রাজনীতি
মহিউদ্দিন খান মোহন
প্রকাশ : ৩১ আগস্ট ২০২৩ ১১:৪৪ এএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
আওয়ামী লীগ এ
দেশের একটি অতি পুরোনো রাজনৈতিক দল। সদ্যোজাত পাকিস্তান রাষ্ট্রে সেই ১৯৪৯ সালে প্রথম
বিরোধী দল হিসেবে এর আত্মপ্রকাশ, পাকিস্তানের ক্ষমতায় তখন মুসলিম লীগ। মুসলীম লীগ সরকারের
অন্যায়-অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রথম মুখ খোলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তিনিই আওয়ামী
লীগের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম সভাপতি। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তখনকার তরুণ জননেতা মো.
শামসুল হক, যুগ্মসম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। সেই শুরু আওয়ামী লীগের পথপরিক্রমা। মওলানা
ভাসানীর হাতে যে আওয়ামী লীগের জন্ম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে তার পরিপূর্ণ
বিকাশ। জন্মের পর আওয়ামী লীগের ওপর দিয়ে বহু ঝড়ঝাপটা গেছে, কখনও ভেঙে পড়েছে ডালপালা,
কখনও বা নুইয়ে পড়েছে বৃক্ষটি। কিন্তু নিঃশেষ হয়ে যায়নি। আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একবার
শুধু এর বিলুপ্তি ঘটেছিল। সেটা ১৯৭৫ সালে, যখন বঙ্গবন্ধু সব দল বিলুপ্ত করে বাংলাদেশ
কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ-বাকশাল গঠন করেন। কিন্তু ওই বছরই ১৫ আগস্ট তাঁর মর্মান্তিক
হত্যাকাণ্ড যেমন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে পরিবর্তন আনে, তেমনি আওয়ামী লীগেও। সায়েম-জিয়া
সরকারের জারি করা রাজনৈতিক দলবিধি, অর্থাৎ পিপিআরের অধীনে ১৯৭৬ সালে পুনরুজ্জীবন ঘটে
আওয়ামী লীগের। একটি বিষয় লক্ষণীয়, যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাঁচিয়ে রাখার স্লোগান দেন
বা দিতেন, তারা বঙ্গবন্ধুর শেষ কীর্তি বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ অনুভব করেননি। যদি করতেন
তাহলে আওয়ামী লীগ নয়, পিপিআরের অধীনে বাকশাল পুনরুজ্জীবিত হতো। যদি সেটা করা হতো, তাহলে
বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত দলটি আজও টিকে থাকত। যদিও আশির দশকের শেষ দিকে মহিউদ্দিন আহমদ
ও আবদুর রাজ্জাক আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে বাকশাল করেছিলেন, কিন্তু বেশিদিন টেকেনি সেই
দল। কয়েক বছরের মধ্যেই তারা তাঁবু গুটিয়ে পুরোনো ঘরে ফিরে আসেন।
আওয়ামী লীগের
আগের এবং এর সমসাময়িক অনেক দলের এখন আর অস্তিত্ব নেই। নামে মাত্র কোনো কোনোটি থাকলেও
তা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময়কার দল মুসলিম লীগ এবং শেরেবাংলার
কৃষক-প্রজা পার্টির অস্তিত্ব এখন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে মওলানা
ভাসানী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ। ১৯৭৮ সালে দলটির তৎকালীন
চেয়ারম্যান মশিয়ুর রহমান যাদু মিয়ার নেতৃত্বে তা বিলীন হয় বিএনপিতে। যদিও মশিয়ুর রহমান
যাদু মিয়ার নাতি জেবেল রহমান গানি দলের পতাকা ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। কত দিন পারবেন
কে জানে। আওয়ামী লীগের সমসাময়িক আরও অনেক দল ছিল, যেগুলো এখন আর নেই। কিন্তু এখনও আওয়ামী
লীগ টিকে আছে বহাল তবিয়তে। বরং বলা যায়, বেশ শক্তিশালী অবস্থানেই রয়েছে। শুধু তাই নয়,
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধও হয়েছে এই দলের নেতৃত্বে। বর্তমানে টানা তিনবার সরকারে আছে
দলটি। এই সময়ের মধ্যে অনেক প্রশংসনীয় কাজ করেছে তারা। ফলে জনমনে এই সরকার তথা আওয়ামী
লীগ সম্পর্কে ব্যাপক ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হওয়ার কথা। যদিও সরকারে থাকলে একটি রাজনৈতিক
দলের জনপ্রিয়তায় ঘাটতি দেখা দেয়। কিন্তু ব্যাপক জনভিত্তিসম্পন্ন রাজনৈতিক দলের বেলায়
তা তেমন কোনো নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে না। বলা নিষ্প্রয়োজন, সেই জনভিত্তিই
আওয়ামী লীগের মূল পুঁজি। সেই সঙ্গে রয়েছে তাদের দেশব্যাপী শক্তিশালী সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক।
ফলে কেউ এ দলকে ধাক্কা মেরে দাগের বাইরে ফেলে দিতে পারবে, এমনটা না ভাবাই ভালো।
অবশ্য আওয়ামী
লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি বলে থাকে, দেশবাসীর ৮০ শতাংশ তাদের পক্ষে অর্থাৎ আওয়ামী
লীগের বিপক্ষে। এটা ঠিক, টানা তিন মেয়াদে সরকারে থাকার কারণে দলটির নেতাকর্মীদের একটি
অংশের মধ্যে এক ধরনের ড্যামকেয়ার ভাব তৈরি হয়েছে। তাদের কিছু কর্মকাণ্ড সরকার, দল এমনকি
খোদ সরকারপ্রধানকেও নানা সময়ে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। ওইসব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ত্বরিত
অ্যাকশনে গিয়ে সরকার চেষ্টা করেছে ইমেজ ধরে রাখতে। পাশাপাশি বাজারে নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্যের
তাপ জনগণের মনে ক্ষোভের উত্তাপ সৃষ্টি করেছে তাতে সন্দেহ নেই। এটা কেউই অস্বীকার করতে
পারবে না, সরকারদলীয় কতিপয় নেতাকর্মীর প্রবল প্রতাপ এবং দ্রব্যমূল্যের জনজীবনে বিরূপ
প্রভাব ফেলেছে। অনেকেরই অভিমত, এর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে আগামী জাতীয়
সংসদ নির্বাচনে।
ধরা যাক সেই নির্বাচনে
নানাবিধ কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দিল না, আওয়ামী লীগ পরাজিত হলো।
তাই বলে কি আওয়ামী লীগ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে? এমন কথা আওয়ামী লীগের চরম শত্রুও বলতে পারবে
না। যদি কেউ বলে, তাহলে মানুষ তার মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। কিন্তু একই
আশঙ্কা যদি আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই ব্যক্ত করা হয়, আর তা যদি উচ্চারিত হয় সর্বোচ্চ
পর্যায়ের কোনো নেতার মুখে, তাহলে? তখন কি তা ধর্তব্যের মধ্যে না নিয়ে পারা যায়? অতিসম্প্রতি
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় গেলে
এক রাতের মধ্যে আওয়ামী লীগকে শেষ করে দেবে। (প্রতিদিনের বাংলাদেশ, ২৭ আগস্ট, ২০২৩)
ওবায়দুল কাদেরের কথায় দুটি প্রশ্ন অত্যন্ত গুরুত্ববহ হয়ে দেখা দিয়েছে। এক. আওয়ামী লীগ কি এতই ঠুনকো অবস্থায় উপনীত হয়েছে যে, তাকে এক রাতের মধ্যে কোনো একটি রাজনৈতিক দল শেষ করে দিতে পারে? দুই. আওয়ামী লীগের মতো একটি বিশাল সাংগঠনিক নেটওয়ার্কসমৃদ্ধ রাজনৈতিক দলকে সমূলে বিনাশ করা বিএনপির মতো একটি দলের পক্ষে সম্ভব কি না? ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাব, কোনো একটি রাজনৈতিক দলকে অন্য কোনো রাজনৈতিক দল ধ্বংস করতে পারেনি; স্বৈরশাসকরা ছাড়া। রাজনৈতিক দল ধ্বংস হয় বা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে নিজেদের কৃতকর্মের কারণে। সে অবস্থা এখনও আওয়ামী লীগে তৈরি হয়েছে বলে মনে হয় না। আর বিএনপি যেখানে নিজেদের সাংগঠনিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছে, সেখানে তারা তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে এক রাতে শেষ করে ফেলবে, এমন দুঃস্বপ্ন বোধকরি তারাও দেখে না। বাস্তবতাও সেরকম ইঙ্গিত দেয় না। তাহলে হঠাৎ কেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সরকারের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের এমন ধারণা হলো, সেটাই প্রশ্ন।