সম্পাদকীয়
সম্পাদক
প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৩ ১৩:৩২ পিএম
ঐতিহ্য সংরক্ষণে সরকারের অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি নতুন নয়। আমরা শুনে
আসছি, ঐতিহ্য রক্ষায় সরকার অত্যন্ত মনোযোগী এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়-অধিদপ্তর এ ব্যাপারে
তৎপর রয়েছে। বলা যায়, ঐতিহ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে মনোজাগতিকভাবে লৌহবাসর গড়ে তোলা
হয়েছে। তবে এই লৌহবাসরে যে ছিদ্র রয়েছে, এরই ফের আরেকটি নজির মিলল ২৩ আগস্ট প্রতিদিনের
বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত একটি সচিত্র প্রতিবেদনে। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত দেশি-বিদেশি পর্যটকদের
আকর্ষণের অন্যতম একটি চিত্তভোলানো ক্ষেত্র। কিন্তু কুয়াকাটা সৈকতের বুক চিরে জেগে
ওঠা অন্তত ২০০ বছরের পুরোনো পালতোলা নৌকাটির অরক্ষিত চিত্র পর্যটকদের চিত্তে প্রশ্নের
পাহাড় গড়ে। সৈকতের ঝাউবাগানসংলগ্ন বালুর নিচ থেকে ২০১৩ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর
রাষ্ট্রের আরও কয়েকটি বাহিনী ও সংস্থার সহায়তায় নৌকাটি সৈকতের জিরো পয়েন্টের প্রায়
তিন কিলোমিটার পূর্ব দিক থেকে তুলে বৌদ্ধবিহারের পাশে প্রতিস্থাপন করে। দুঃখজনক হলেও
সত্য, বিগত ১০ বছরেও এই ঐতিহ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব না হওয়ায় অরক্ষিত অবস্থায়
ঐতিহ্যবাহী নৌকাটি ক্ষয়ে যাচ্ছে।
এই অমূল্য নিদর্শন স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করার লক্ষ্যে প্রত্নতত্ত্ব
অধিদপ্তরের প্রতিশ্রুতি ছিল এই নৌকাটিকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হবে ‘নৌকা জাদুঘর’। কিন্তু
এক দশকেও তা আলোর মুখ দেখেনি। এজন্য ২৩ শতাংশ জমি বরাদ্দ চেয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে
আরও অনেক আগে চিঠি পাঠানো হলেও এর নেই কোনো অগ্রগতি। পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে মৌখিকভাবে
ওই জমি ব্যবহারের কথা বলা হলেও এ-সংক্রান্ত কোনো সরকারি সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়
থেকে আজও মেলেনি। এই নৌকাটির ব্যবহার নিয়ে ভিন্ন মত আছে, কিন্তু ইতিহাস-ঐতিহ্যের নিদর্শন
রক্ষায় ব্যর্থতার বিষয়টি নিঃসন্দেহে পরিতাপের। কোথাও বলা হয়েছে, স্থানীয় রাখাইন সম্প্রদায়ের
পূর্বপুরুষরা প্রতিবেশী তৎকালীন বার্মা আজকের মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য থেকে বিতাড়িত
হয়ে আসার মাধ্যম হিসেবে নৌকাটি ব্যবহার করেছিলেন। বর্তমান প্রজন্মের স্থানীয় রাখাইনরা
তাদের অগ্রপ্রজন্মের এই ভাষ্যকে ঐতিহাসিক সত্য বলে স্বীকার করলেও তাদের জমিতে এর সংরক্ষণে
বিরোধিতা করে এবং এখান থেকে তা সরিয়ে নেওয়ার পক্ষে জনমত সৃষ্টির উদ্যোগও নিয়েছিল। প্রতিদিনের
বাংলাদেশ-এর ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফরাসি নৌকা বিশেষজ্ঞ ইভাস মারের নেতৃত্বে একটি
দল নৌকাটি উত্তোলনে ব্যর্থ হলে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেনা ও নৌবাহিনীর টেকনিক্যাল
কোরের সদস্য এবং বাংলাদেশ রেলওয়ের সহায়তায় নৌকাটি তুলে বৌদ্ধবিহারের পাশে প্রতিস্থাপন
করা হয়। কিন্তু বর্তমানে ওই ঐতিহ্যের ভগ্নদশা আমাদের ব্যথিত করে।
বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস বলে একটি দিন এখন বিশ্বে মহাসমারোহে পালিত হয়।
১৯৮২ সালে ‘ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল ফর মনুমেন্টস এ অ্যান্ড সাইটস’ তিউনিশিয়ায় একটি
আলোচনা সভায় ১৮ এপ্রিলকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। পরের বছর
দিনটি বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস হিসেবে পালনে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পায়। এরপর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন
দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের তাগিদের প্রেক্ষাপটে দিনটি পালিত হয়ে আসছে কিন্তু
পরিমেয় এবং অপরিমেয় উভয় সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের প্রতিপালনে আমরা
কতটা সাফল্য অর্জন করেছি, এ নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন আছে। কুয়াকাটায় অরক্ষিত অবস্থায় সংরক্ষিত
২০০ বছরের সেই পুরোনো নৌকাটি এরই খণ্ডিত দৃষ্টান্ত। আমরা জানি, আমাদের কিছু ঐতিহ্যকে
ইতোমধ্যে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে। এর মধ্যে সোমপুর মহাবিহার এবং বাগেরহাট
মসজিদ অন্যতম। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী এখন পর্যন্ত প্রায় ৫২৪টি প্রত্নস্থল
সংরক্ষণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে
থাকলেও পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে এবং পর্যটকদের পর্যটনসহায়ক কতটা কী উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ
নেওয়া হয়েছে, প্রশ্ন আছে এ নিয়েও। দুর্ভাগ্যজনভাবে পর্যটনশিল্পে ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
ব্যবস্থাপনা’ অবহেলিত রয়ে গেছে। আমরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ‘পর্যটন ও হোটেল ব্যবস্থাপনা’র
সঙ্গে পরিচিত হতে পারলেও ‘পর্যটন ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ব্যবস্থাপনা’র বিষয়গুলোর সঙ্গে
এখনও পরিচিত হতে পারিনি। দেশের ঐতিহ্য সংরক্ষণে এবং পর্যটনশিল্পকে বিকশিত করার বৃহৎ
স্বার্থে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে সব স্থাপনা এবং ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে চিহ্নিত সবকিছুর
সুরক্ষায় দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠ হতে হবে। কুয়াকাটার বৌদ্ধবিহারসংলগ্ন বেড়িবাঁধে রক্ষিত
২০০ বছরের পুরোনো নৌকাটির সংরক্ষণ সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সমভাবেই গুরুত্বপূর্ণ।