× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

উন্নয়ন

পরিকল্পনা ও সমন্বয়ে গলদ সরান

ড. আদিল মুহাম্মদ খান

প্রকাশ : ২২ আগস্ট ২০২৩ ০৯:৫১ এএম

আপডেট : ২২ আগস্ট ২০২৩ ১১:৩৬ এএম

ড. আদিল মুহাম্মদ খান

ড. আদিল মুহাম্মদ খান

উন্নয়ন একটি বহুমাত্রিক ধারণা। তবে উন্নয়ন মানেই বৃহৎ অবকাঠামো নয়। বরং উন্নয়ন মানে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা অনুমান, মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়নের স্বরূপ উন্মোচন এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার বৈজ্ঞানিক ও পরীক্ষালব্ধ ধারণা পোষণ করে জনকল্যাণের স্বার্থে কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করা। আমাদের দেশের অধিকাংশ উন্নয়ন পরিকল্পনা অপরিকল্পিত। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে। তবে উন্নয়নের এ মহাযাত্রায় প্রতিবক দুর্যোগের কারণে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছে। নগরে বৃষ্টিপাতের কারণে নগরাঞ্চলে জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। সম্প্রতি ভারী বৃষ্টিপাতে চট্টগ্রাম মহানগরী পানিতে তলায়। উন্নয়ন প্রকল্পে আমাদের ঘাটতির বিষয়টি দুর্যোগ নানাভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে এবং এ থেকে প্রতিনিয়ত স্পষ্ট হয়ে উঠছে, প্রকৃতপ্রস্তাবে অনেকক্ষেত্রেই সুষমমাত্রায় প্রকল্পের বাস্তবায়ন হচ্ছে না বরং অনেক ক্ষেত্রেই অর্থের অপচয় ঘটে চলেছে। এজন্য আমাদের প্রথমে উন্নয়নের সার্বিক ধারণাটি বোঝা জরুরি। এজন্য উন্নয়নের মাধ্যমে অবকাঠামোর উন্নয়ন নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রাকৃতিক ভারসাম্যও বজায় রাখতে হবে। যেকোনো স্থানেই উন্নয়নের মাধ্যমে ওই অঞ্চলের সমাজব্যবস্থা, ভূ-প্রকৃতি, প্রাকৃতিক ভারসাম্য, জলাশয়-জলাভূমির চরিত্র, জলবায়ুর ধারাবাহিকতা, জীবনব্যবস্থার আধুনিকায়নের রূপ কেমন হবে, তা নিশ্চিত করা হয়। এই নিশ্চিতকরণের আগে পরিকল্পনা এবং পরিকল্পনা অনুসারে কার্যক্রম পরিচালনার বিকল্প নেই। সম্প্রতি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছে তারই আলোকে এই বিশ্লেষণ।

সম্প্রতি অনেকগুলো প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি প্রকল্পই মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এসব পরিকল্পনা বাস্তবে কোনো ফলাফল দিতে পারছে না। বরং এসব পরিকল্পনা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়ে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অথবা নতুন ভোগান্তির সূত্রপাত করছে। যেকোনো পরিকল্পনার আগে তার উপযোগিতা পরীক্ষা করে দেখা অত্যাবশ্যক। শুধু উপযোগিতা পরীক্ষাই নয়, প্রকল্পের ক্ষেত্রে আমাদের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ দিতে হয়। সবকিছু বিবেচনা করেই একটি প্রকল্প দাঁড় করাতে হয়। না হলে ওই প্রকল্প শেষ পর্যন্ত আমাদের কাজে আসে না বরং আরও বড় সমস্যার সম্মুখীন করে। অথচ উপযোগিতা বিশ্লেষণ করা ছাড়াই প্রচুর প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। উপযোগিতা পরীক্ষা না করায় প্রকল্পের মধ্যে সমন্বয়সাধন হয়নি। নগরে জলাবদ্ধতা একটি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। পুরো নগরে বৃষ্টির পানি কীভাবে নিষ্কাশিত হবে, এই ব্যবস্থা জোরদার করার বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা বা পরীক্ষা করা হয়নি। তাই প্রচুর অর্থ ব্যয় করে নালা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা নির্মাণ করার পরও জলাবদ্ধতা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকল্পের ক্ষেত্রে বড় অবকাঠামো ও লক্ষ্যমাত্রাকেই বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে করণীয় বৈজ্ঞানিক ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পদক্ষেপ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামানো হয়নি। উন্নয়নের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে নাগরিক সুবিধা এবং নগরের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্য পায়নি। সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত না হওয়ায় এই উন্নয়ন আমাদের জন্য ভোগান্তির একটি বড় কারণ হয়ে উঠেছে।

হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম শতভাগ ডাবল রেললাইন গড়ে তোলা হয়। অন্তত ১০০ বছরেও পানিতে ডুববে নাÑ এমনভাবেই রেললাইন নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু চট্টগ্রামে ভারী বৃষ্টিপাতেই রেললাইন পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। এটি সর্বসাম্প্রতিক ঘটনা। এমন ঘটনা আরও অনেক ঘটেছে এবং ভবিষ্যতেও ঘটার আশঙ্কা বিদ্যমান। বারবার প্রতিটি প্রকল্পে ঘাটতি ও সমীক্ষণে ভুল আমাদের অর্থের অপচয় করছে। এমনটিও নতুন কিছু নয়। নিকট অতীতে সুনামগঞ্জে বন্যার ফলে হাওরাঞ্চলে বানানো সড়কপথ পানিতে ডুবে যায়। তখন আমরা দেখেছি, হাওরের মধ্যে এমন একটি সড়ক গড়ে তোলার পরও পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাব ছিল। এ কারণে বন্যার পানি ঢালু বেয়ে নেমে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছিল না। এগুলো অবকাঠামো পরিকল্পনার ভুল। দেশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রকল্প ভৌগোলিক বিবেচনায় অত্যন্ত স্পর্শকাতর। সেসব অঞ্চলে ঝুঁকি ও প্রকল্পের সমন্বয়ের সম্ভাব্যতা যাচাই না করতে পারার ফলে এমনটি হয়ে থাকে। প্রকল্পের উপযোগিতা বিশ্লেষণের পাশাপাশি ঝুঁকির সম্ভাবনা, ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা, প্রাকৃতিক নানা বিষয় অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। সুনামগঞ্জের প্রকল্পটি স্পর্শকাতর, কারণ হাওরাঞ্চলের মধ্যখান দিয়ে সড়কটি গেছে, বৃষ্টির সময় পাহাড়ি ঢলের শঙ্কা থেকে যায় এবং ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় এটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্প তো বটেই। অথচ প্রকৃতির ভারসাম্য, জলাশয়-জলাভূমির প্রকৃতি ইত্যাদি বিবেচনা করে এই প্রকল্প পরিচালনা করা হয়েছে কি না, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ওই অঞ্চলে দুর্যোগ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তা জনজীবনে কতটা দুর্ভোগ বয়ে আনবে, তা বিবেচনায় রাখলে এত ঘাটতি থাকত না।

যেকোনো অঞ্চলে বড় উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালনার সময় বিগত ১০০ বছরের আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান যাচাই করতে হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতির পরিমাণ প্রাক্কলনের মাধ্যমে যাচাই করে একটি সম্ভাব্য পরিকল্পনা গড়ে নিতে হয়। তেমনটি না হলে এমন শোচনীয় অপচয়ের মুখোমুখি হতেই হবে। নগর বাদে ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চলে গাছপালা, বনাঞ্চল, জলাশয়সহ অনেক প্রাকৃতিক উপাদান থাকে। প্রাকৃতিক উপাদান ধ্বংস না করে সমন্বয়ের মাধ্যমে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা জরুরি। তা করতে না পারলে আরও ভয়াবহ ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে। সংরক্ষিত বন এবং জনবসতি রয়েছেÑ এমন স্থানে যেকোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পরিকল্পনার আগে প্রাক্কলনে প্রচুর সময় ব্যয় করতে হয়। প্রাক্কলনের জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। শুধু কিছু পরিসংখ্যান যাচাই করে এবং মাপজোক করে একটি প্রতিবেদন দাখিল করলে সমস্যার সমাধান হবে না। অথচ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে, এজন্য যে পরিমাণ প্রাক্কলন পদ্ধতির প্রয়োগ জরুরি ছিল, তা করা হয়নি বরং প্রতিবেদন ও পরিসংখ্যাননির্ভর হয়ে প্রতিটি প্রকল্প পরিচালনা করা হয়েছে। সঙ্গত কারণেই অনুমান করা যায় এগুলো ভুল পদ্ধতি। শুধু পরিকল্পনার বাস্তবায়নই নয়, অবকাঠামো নির্মাণের গুণগত মান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও গাফিলতি রয়েছে। যেকোনো অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে নির্মাণ উপকরণ, নির্মাণ পদ্ধতিসহ সার্বিক গুণগত মানের উন্নয়নের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়ে থাকে। কিন্তু এখানেও আমাদের চরম ঘাটতি রয়েছে। তাই বড় বড় অবকাঠামো প্রাক্কলিত সময়ের আগেই নানা স্থানে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে।

আবার আমাদের এই যে অপরিকল্পিত নগরায়ন তাও কিন্তু থামানো যাচ্ছে না। কারণ এক্ষেত্রে যাদের দায়িত্ব, তারাও তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন এমনটি বলার সুযোগ নেই। ঢাকার কথাই যদি বলি, তাহলে এখানে উন্নয়নের পরিকল্পনা ও তদারকির দায়িত্ব রাজউক এবং সিটি করপোরেশনের। ১৯৯৫ সালে ডিএমডিপি বা ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান তৈরি করা হয়, তা ছিল ভালো পরিকল্পনা। এর আগেও অনেক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দিন শেষে সেসব একটি কাগজ ছাড়া কিছু নয়। পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে যে সুশাসন ও মনিটরিং দরকার, তা আমাদের এখানে ভয়ংকরভাবে দুর্বল। ঢাকার আশপাশের জলাশয়গুলো নির্বিচার ভরাট করে অনেক সরকারি প্রকল্প হয়েছে। সরকারিভাবে যখন জলাধার ভরাট করে স্থাপনা তৈরি করা হয়, তখন এসব সংস্থা নিশ্চুপ থাকে। অন্যদিকে বেসরকারি খাতের প্রকল্পে তো কোনো নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না। এসব প্রকল্প যারা করেন, তারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনেক ক্ষমতাবান, অনেক সময় রাষ্ট্রের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। তারা কেবল ভরাটের মধ্যে সীমিত থাকেন না, নগরায়ণ আইনকেও পাল্টে দেন।

তবে, অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয়তার কথাও এড়িয়ে যাওয়ার নয়। যেকোনো বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সম্ভাব্যতার পাশাপাশি এর অত্যাবশ্যকীয়তা প্রাক্কলনে নানা সুবিধা দিয়ে থাকে। সুনামগঞ্জ, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ইত্যাদি অঞ্চলে অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে সতর্কতা সর্বাগ্রে প্রাধান্য পাওয়ার কথা। নগরে একটি প্রকল্প গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ এবং অন্যান্য বিশেষ অঞ্চলে প্রকল্প গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ এক নয়।

সবকিছু একই কাতারে যাচাই করে নির্মাণ করা যাবে না। তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতির পাল্লাই ভারী হবে বেশি। একটি প্রকল্প ওই অঞ্চলের মানুষের জীবনে ইতিবাচক-নেতিবাচক প্রভাব কীভাবে আনে তা প্রকল্পের পর আমরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি। কিন্তু তার আগে এই প্রকল্প জনজীবনে কেমন প্রভাব ফেলতে পারে, তাও যাচাই করে নেওয়া জরুরি। তারপরও প্রকল্প হয় এবং প্রতিবারই প্রকল্পের নানা ঘাটতি জনদুর্ভোগের মাধ্যমে ফুটে ওঠে। বিস্ময়কর হলেও সত্য, এসব প্রকল্পে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। তদন্ত হয়। তদন্তের পর অভিযোগ প্রমাণ হয় অনেক সময়। কিন্তু তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা হয় না। প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও অভিযুক্তদের শাস্তি দেওয়া হয় না। ফলে অর্থের অপচয় বাড়ে। রাষ্ট্র আইনের শাসনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। যেই দুর্নীতি করুক তার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতেই হবে। অথচ দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দেওয়ার এক ধরনের অপসংস্কৃতি আমাদের মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। এই অপতৎপরতাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান করা না গেলে অনাগত ভবিষ্যৎ শুভকর কিছু হবে না।

  • নগর পরিকল্পনাবিদ  অধ্যাপকজাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা