সর্বজনীন পেনশন
আব্দুল বায়েস
প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২৩ ১০:০১ এএম
আব্দুল বায়েস
করোনাকালে কানাডার প্রধানমন্ত্রী, বলা যায় উন্নত দেশগুলোয় তার নাগরিকদের জন্য যে অর্থসাহায্য ঢেলেছিলেন, তা দেখেশুনে এ দেশের সবার চোখ তো চড়কগাছ! কোথায় পেল এত টাকা? আলাদিনের চেরাগ নাকি? আসলে এ টাকা এসেছে জনগণের সঞ্চিত অর্থ থেকে। উন্নত দেশে অবসরপ্রাপ্তরা অত আরামে দিনাতিপাত করতে পারেন তার কারণ কর্মজীবনে তারা অর্থ অর্জনের একটা মোটা অংশ ‘বিসর্জন’ দেন আয়কর কিংবা বিভিন্ন স্কিমের নামে। আমরা বুড়ো বয়সে কষ্ট পাই কারণ, জোয়ানকালে সব অর্থ খেয়ে খোয়াই। আজ যিনি কষ্ট করবেন, বুড়ো বয়সে তিনি মিষ্টি পাবেন আর এখন মিষ্টি খেয়ে টাকা খোয়ালে ভবিষ্যতে কষ্ট ভোগ করতে হবেÑ এটা অর্থনীতির বিধান; বীমা বা পেনশন স্কিমের পেছনের মূল কথা।
এক.
প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ দিয়ে নিবন্ধটি শুরু করতে হয়, তা না হলে
সুবিচার করা হয় না। বোধ করি বাংলাদেশে এযাবৎকালের অন্যতম মাইলফলক সর্বজনীন পেনশন স্কিম
প্রবর্তনের প্রত্যয়; যা ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ব্যবহার করেছিল বাংলাদেশ আওয়ামী
লীগ। সুতরাং সেই প্রতিশ্রুতির প্রতিফলনস্বরূপ বাংলাদেশের নাগরিকদের পেনশনব্যবস্থার
আওতায় আনতে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি (স্কিম) চালু করেছে সরকার। কেউ বলবেন দেরি হয়েছে,
কিন্তু আমরা বলব বেটার লেট দ্যান নেভার।
‘সুখে ভরবে আগামী দিন, পেনশন হবে সর্বজনীন’ এ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থার উদ্বোধন হলো গত ১৭ আগস্ট। এই স্কিম উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘দেশের প্রত্যেক নাগরিককে উন্নত জীবন দিতে চাই। সবার আরও ভালো ও উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থার উদ্বোধন করা হলো।’
দুই.
একনজরে দেখা যায়
সর্বজনীন স্কিম চিত্রটি এক অর্থে চিত্তহারীও বটে। প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা করে ১০ বছর
চাঁদা চালালে পেনশন মিলবে ১ হাজার ৫৩০ টাকা, ২০ বছর পর ৪ হাজার ৯২৭ টাকা, ৩০ বছর পর
১২ হাজার ৪৬৬ টাকা এবং ৪২ বছর পর ৩৪ হাজার ৪৬৫ টাকা। যদি মাসে চাঁদার পরিমাণ হয় ১০
হাজার টাকা, তাহলে একই সময়ের ব্যবধানে পেনশন মিলবে যথাক্রমে ১৫ হাজার ৩০২, ৪৯ হাজার
২৬৮, ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬৬ ও ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৬৫৫ টাকা। প্রাথমিকভাবে ছয়টির মধ্যে চারটি
স্কিম যথা প্রগতি, সুরক্ষা, সমতা ও প্রবাসী উদ্বোধন করা হয়েছে। স্মর্তব্য, বেসরকারি
চাকরিজীবীদের জন্য রয়েছে প্রগতি স্কিম, স্বকর্মে নিয়োজিত নাগরিকদের জন্য সুরক্ষা স্কিম
আর নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য থাকছে সমতা স্কিম (প্রতিদিনের বাংলাদেশ, ১৮ আগস্ট ২০২৩)।
আরও কিছু তথ্য দেওয়া দরকার। ক. ‘ইউপেনশন’ নামে খোলা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যে-কেউ পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন; তবে অবশ্যই সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে নয়তো জরিমানা। খ. এ কর্মসূচিতে ১৮ বছর বয়সে যুক্ত হতে পারলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা মিলবে; যুক্ত হতে বয়স যত বাড়বে আনুপাতিক হারে সুবিধা তত কমবে। মোট কথা, যত কিস্তি দেওয়া হয়েছে সেই টাকার চেয়ে ২ থেকে ১২ গুণ টাকা পেনশন পাওয়া যাবে। এবং গ. অসচ্ছল চাঁদাদাতা ১২ মাস পর্যন্ত কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে পেনশন হিসাবটি স্থগিত হবে না। চার. নিবন্ধিত হওয়া যাবে গ্রামের বাড়ির কাছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে গিয়ে অ্যাপের সাহায্যে। মাসিক কিস্তি সোনালী ব্যাংক সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের খোলা অ্যাকাউন্টে এবং যেকোনো এমএফএস দিয়ে।
তিন.
সর্বজনীন পেনশন স্কিমের ভাবনাটি এ মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরি, কারণ আমাদের গড়পড়তা প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল বেড়ে চলেছে, যখন গড় আয়ু ৭৩ বছর। গড় বৃদ্ধির খবরটি যেমন সুখের, বয়স্কদের সুরক্ষার অনুপস্থিতি তেমনি দুঃখের। বাংলাদেশি জনগণের গড় বয়স এখন ২৬-২৭ বছর, যা নির্দেশ করে আমরা এক জনমিতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি; যা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য কল্যাণকর। কিন্তু একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, বৃদ্ধদের অনুপাতও বাড়ছে এবং সরকারি এক হিসাব বলছে, ২০৩১ নাগাদ বয়স্কদের অনুপাত হবে মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংস; যা ২০১৭ সালে ছিলে ১১ ভাগ। অথচ আমাদের দেশে একমাত্র সরকারি খাত ছাড়া অন্য কোথাও পেনশনের ব্যবস্থা নেই। অবশ্য ব্যক্তি খাতে কিংবা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় প্রভিডেন্ট ফান্ড , গ্রাচ্যুইটি ইত্যাদি আছে কিন্তু সার্বিক সুরক্ষা বলতে যা বোঝায় তা নেই। এক কথায়, বর্তমান বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৪০ ভাগের কোনো পেনশন নেই। অবসরের পর এদের ঠাঁই অন্যের গলগ্রহে কিংবা বৃদ্ধাশ্রমে, মানসিক বিপর্যয়ের মুখে। দ্বিতীয়ত, সময়ের আবর্তনে মাথাপিছু আয় বেড়েছে, এমনকি রিকশাচালক বা গৃহপরিচারিকার হাতে স্মার্টফোন বলে দেয়, কিস্তি চালাতে খুব একটা কষ্ট হওয়ার কথা নয়। তৃতীয়ত, মধ্যম আয়ের দেশের নাগরিকের জন্য পেনশন স্কিম থাকবে না, এমন অবস্থা গ্রহণযোগ্য নয়। এবং সবশেষে, এমনকি দরিদ্র জনগণের একটা অংশ বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক পকেটে অর্থ জমা রেখে বিশাল ঝুঁকি ও টেনশনের মধ্যমে সময় পার করছে; আর একটু ওপরের আয়ের মানুষ বেসরকারি বীমা গ্রহণ করেছে। সুতরাং পেনশন স্কিমের টাকার জোগান দেওয়া কষ্টকর হলেও অসম্ভব কিছু নয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করলে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের মাধ্যমে এই জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
চার.
বাংলাদেশে কিছু বড় প্রকল্পও বিফলে গেছে বলে অভিযোগ আছে এবং সেই সূত্রে চলমান সর্বজনীন পেনশন স্কিমের সফলতার সম্ভাবনা নিয়ে সংশয় থাকা স্বাভাবিক। তবে পূর্ণ সার্থকতা পেতে হলে বেশকিছু দিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রথমত, ঊর্ধ্বমুখী সরকারি ব্যয় এবং নিম্নমুখী রাজস্বের নিরিখে পেনশন স্কিমটি চালু রাখা চেলেঞ্জিং হবে। বিশেষত বর্তমান বৈশ্বিক সংকটের মুখে সরকারি ভর্তুকি কোথা থেকে আসবে তা বিরাট এক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। দ্বিতীয়ত, জবাবদিহিতা এবং সুশাসন পেনশন স্কিমটি বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত। বিশেষ করে বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে জবাবদিহিতা ও সুসাসনের প্রকট অভাব সন্দেহের বীজ বপন করে এবং তার সঙ্গে রয়েছে আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতা। জনগণের সঞ্চিত অর্থ এবং তার সঙ্গে সরকারি অনুদানÑ এ পুরো অর্থ বিনিয়োগে যদি গাফিলতি ঘটে তাহলে সর্বজনীন পেনশন স্কিমটি বড় মাপের ধাক্কা খেতে পারে। এখানেই স্বচ্ছতার প্রশ্নটি উঁকি মারেÑকোথায়, কীভাবে এবং কখন কী পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা হবে তার বিস্তারিত বিবরণ জনগণের সামনে তুলে ধরা। তার অর্থ, নিয়মিত তদারকি, শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ ও স্বয়ংক্রিয় তথ্য বিতরণ। তৃতীয়ত, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালনÑ এ নীতি স্কিমটির জন্য জরুরি। তার অর্থ, ব্যাংক লুট, বিদেশে অবৈধভাবে অর্থ পাচার বা মেগা প্রকল্পের দুর্নীতি রোধে যে দুর্বলতার ছাপ প্রত্যক্ষ করা গেছে, তা যেন সর্বজনীন পেনশন স্কিমে না থাকে।
পাঁচ.
আমাদের আর্থিক
খাত বিশেষ করে ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক নেতিবাচক কথা হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে
আবারও ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার গলদ সারানোর ওপর জোর দিতে বলি। সর্বজনীন পেনশন স্কিমের
সঙ্গে স্বচ্ছ ব্যাংকিং ব্যবস্থার ব্ষিয়টি ওতপ্রোত জড়িত। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও সতর্ক নজর দরকার। অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন,
‘বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ বড় কথা নয়; বরং দেখতে হবে এর প্রবণতা কী। রিজার্ভের
প্রবণতা নিচের দিকে নামতে থাকলে ঠেকানো কঠিন। আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ নিতে অনেক
শর্তের মধ্যে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমানোর কথাও আছে। কিন্তু খেলাপি ঋণ অনেক দশক ধরে
দেখছি। শুধু কাগজে সই করলেই কি খেলাপি ঋণ কমে যাবে? এটি সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক ব্যাপার।
খেলাপি ঋণ কমানোর শর্ত দেওয়ার মাধ্যমে আইএমএফ খুশি, আমরাও খুশি’। হক কথা।
ব্যাংক খাতের সংস্কার করা আমাদের উচিত ছিল বহু আগে। দাতাদের শর্তে কর্তব্য পালন একটি সভ্য জাতির শোভা পায় না। শর্তগুলো বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিক হবে এটি আশা করা অন্যায় নয়। কারণ আইএমএফ থেকে প্রাপ্ত ঋণ বড় কিছু না হলেও অন্যদের কাছ থেকে ঋণ পেতে সহায়ক হয়। এবারের মতো অতীতের ব্যর্থতা ভুলে খাদের কিনার থেকে ফিরে আসা মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত বলে মনে করি। আয়নায় মুখ দেখার বিকল্প নেই। সর্বজনীন পেনশন স্কিমের সাফল্যের জন্য সার্বিক ব্যবস্থায় দক্ষতার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। ব্যাংকিং খাতের ক্ষত উপশমে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজর আরও গভীর করে জরুরি।
ছয়.
সবশেষে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন নবধারামূলক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের (যেমন ডিজিটাল বাংলাদেশ) সঙ্গে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর বিষয়টি বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে বিশ্বাস। বর্তমানে একটা বিশেষ শ্রেণি নানাভাবে নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করে থাকে, কিন্তু আমজনতার জন্য এ স্কিম নিঃসন্দেহে বৈষম্যরোধক; আর তাই অভিনন্দন।