জনস্বাস্থ্য
ড. কবিরুল বাশার
প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২৩ ০৯:৪৯ এএম
ড. কবিরুল বাশার
হাজার হাজার বছর
ধরে মশাবাহিত রোগ মানব ইতিহাসে অসুস্থতা এবং মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে লিপিবদ্ধ রয়েছে।
উনিশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের আগ পর্যন্ত কেউই বুঝতে পারেনি যে মশা মানুষের রোগের কারণ।
প্রথম জানা যায় ১৮৭৭ সালে। যখন ব্রিটিশ ডাক্তার প্যাট্রিক ম্যানসন আবিষ্কার করলেন,
কিউলেক্স প্রজাতির মশা মানুষের ফাইলেরিয়াল রাউন্ডওয়ার্ম বহন করতে পারে। পরবর্তী দুই
দশকে তিনি এবং ফ্রান্স, ইতালি, রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্য গবেষকরা ম্যালেরিয়ার
গবেষণায় মনোনিবেশ করেন; যা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও নাতিশীতোষ্ণ দেশগুলোয় একটি প্রধান ঘাতক।
তারা আস্তে আস্তে মানুষ ও মশার মধ্যে ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ এবং জীববিজ্ঞানের জটিল সমীকরণ
বুঝতে শুরু করেন। আবিষ্কার করেন ম্যালেরিয়া রোগের কারণ অ্যানোফিলিস মশা।
১৯৩০ সাল থেকে
প্রতি বছরের ২০ আগস্ট দিনটি বিশ্ব মশা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। বিশ্ব মশা দিবস ২০২৩-এর
প্রতিপাদ্য ‘এটি এখনও উন্মোচন করা বাকি’ (ইট ইজ ইয়েট টু বি ডিসক্লোসড)।
মানুষের বিভিন্ন
ভয়াবহ অসুখের মধ্যে মশাবাহিত ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ফাইলেরিয়া, জিকা
ও জাপানিজ এনসেফালাইটিস উল্লেখযোগ্য। তাই মশাবাহিত রোগের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসাধারণকে
বিশেষভাবে সচেতন করার জন্য বিশ্ব মশা দিবস পৃথিবীজুড়ে পালিত হয়। মশাবাহিত রোগ থেকে
বাঁচার জন্য, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এই দিনে বিশ্বজুড়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি
পালন করা হয়। ১৮৯৪ সালে ম্যানসন ম্যালেরিয়া প্যারাসাইটের সম্ভাব্য ভেক্টর হিসেবে
মশার অধ্যয়ন করতে ভারতীয় মেডিকেল সার্ভিসের মেডিকেল অফিসার রোনাল্ড রসকে রাজি করান।
বছরের পর বছর নিরর্থক গবেষণার পর রস শেষ পর্যন্ত ১৮৯৭ সালে প্রমাণ করেন, অ্যানোফিলিস
মশা ম্যালেরিয়া-পরজীবী বহন করতে পারে। তিনি তার আবিষ্কারের দিন, ২০ আগস্ট, ১৮৯৭-কে
‘মশা দিবস’ বলে অভিহিত করেছিলেন। লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন
পরে তার আবিষ্কারের তাৎপর্য চিহ্নিত করতে ২০ আগস্ট বিশ্ব মশা দিবসের নামকরণ করে, যা
প্রতি বছর পালিত হয়। অ্যানোফিলিস মশার সঙ্গে এই জটিল যোগসূত্রটিও দেখিয়েছে যে, মশার
কামড় রোধ এবং মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা Ñ ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ Ñ ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে
মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। বিভিন্ন বিজ্ঞানীর গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে এ পর্যন্ত
১২৬ প্রজাতির মশা শনাক্ত করা হয়েছে। তার মধ্যে বর্তমান ঢাকায় আমরা পাই ১৬ প্রজাতি।
উষ্ণ-আর্দ্র আবহাওয়া থাকায় বাংলাদেশ মশা ও মশাবাহিত রোগ বিস্তারের জন্য উত্তম জায়গা।
বাংলাদেশে মশাবাহিত রোগগুলোর অন্যতম হলো ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া
ও জাপানিজ এনসেফালাইটিস।
বর্তমানে আমরা
মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর ঝুঁকি মাথায় নিয়ে পার করছি। বাংলাদেশে ডেঙ্গুর ইতিহাস পুরোনো।
১৯৬৪ সালে প্রথম বাংলাদেশে ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্ত হলেও সেটিকে তখন ঢাকা ফিভার বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ২০০০ সালে প্রথম ডেঙ্গু
শনাক্ত হয় এবং ৫ হাজার ৫০০ মানুষ আক্রান্ত হয়। এরপর প্রতি বছরই কমবেশি ডেঙ্গু হয়েছে
তবে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা দেশবাসী সবচেয়ে বেশি দেখেছে ২০১৯ সালে। ওই বছর সরকারি হিসাব
অনুযায়ী ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং ১৭৯ জন মারা যায়। এ বছর
ডেঙ্গুতে মৃত্যু বাংলাদেশের ইতিহাস ভেঙে রেকর্ড করেছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা
নেওয়া রোগীর সংখ্যা এখন লাখ ছুঁইছুঁই। আমরা যে ফোরকাস্টিং মডেল তৈরি করি তাতে স্পষ্ট
দেখা যাচ্ছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এ বছর বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ হবে।
ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটায় ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী এডিস মশার দুটি প্রজাতি; যার একটি এডিস
ইজিপ্টি, আরেকটি হলো অ্যালবোপিকটাস। এডিস ইজিপ্টিকে শহুরে মশা বা নগরের মশা অথবা গৃহপালিত
মশা বলা হয়; আর অ্যালবোপিকটাসকে বলা হয় এশিয়ান টাইগার মশা অথবা গ্রামের মশা। এডিস
মশা পাত্রে জমা পানিতে জন্মায়, বর্ষাকালে এর ঘনত্ব বেশি হয়। তাই ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব
এ সময়টায় বেড়ে যায়। বিশ্বব্যাপী মশা দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য মশা ও মশাবাহিত রোগ
সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলা। মশা নিয়ন্ত্রণে সরকারি-বেসরকারি, সামাজিক এবং ব্যক্তি
পর্যায়ের সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।
প্রতিটি জেলা শহরেও এখন ডেঙ্গু বিস্তৃত হয়ে পড়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল বিভাগের বেশ কয়েকটি শহরের অবস্থা খারাপ। সংকটময় পরিস্থিতিতে কাউকে দোষারোপ না করে যার যার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে মশা নিয়ন্ত্রণে সম্পৃক্ত হওয়া প্রয়োজন। সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব রাস্তাঘাট, উন্মুক্ত স্থান, সরকারি স্থাপনা, বাস টার্মিনালগুলোয় এডিস মশার প্রজনন বন্ধ ও নিয়ন্ত্রণ করা আর নগরবাসীর দায়িত্ব তার বাড়ি এবং আঙিনায় এডিস মশার প্রজনন যেন না হয় তা নিশ্চিত করা। সপ্তাহে এক দিন যার যার বাড়ি ঘুরে দেখতে হবে যেন কোথাও কোনো পাত্রে পানি জমা না হয়। বাসায় যদি এমন কোনো পাত্র থাকে যেখানে পানি জমা হওয়ার আশঙ্কা আছে, সেই পাত্রটি উল্টিয়ে অথবা এমন জায়গায় রাখতে হবে যেন সেখানে বৃষ্টির পানি পড়ে মশার প্রজননস্থলে পরিণত না হয়। সিটি করপোরেশন ও নগরবাসীর সম্মিলিত কার্যক্রমই পারে ডেঙ্গু প্রতিরোধে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে। সাধারণ মানুষের সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। মশাবাহিত রোগ থেকে মুক্ত থাকব আমরা।