জন্মদিন
ড. হারুন রশীদ
প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০২৩ ১২:৪৩ পিএম
আপডেট : ১৮ আগস্ট ২০২৩ ১৩:১৩ পিএম
সেলিম আল দীন : ১৮ আগস্ট, ১৯৪৯-১৪ জানুয়ারি, ২০০৮
আজ (১৮ আগস্ট) বাংলা নাটকের গৌড়জন নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের
জন্মদিন। তার নাটক বাংলা থিয়েটারের বহুযুগের প্রতীক্ষার অবসান ঘটায়। বাংলার মাটিতে,
জলহাওয়ায় প্রাণের ভাষাতেই জন্ম নেওয়া তার নাটকগুলো বাংলা নাটকের সব উপাদান ছুঁয়ে যায়
আধুনিকের মন নিয়ে। এ কারণেই বাঙালির কাছে সেলিম আল দীন এক অবিস্মৃত নাম। ১৯৪৯ সালের
১৮ আগস্ট সীমান্তবর্তী ফেনী জেলার সমুদ্রবর্তী সোনাগাজী উপজেলার সেনের খিলে জন্মগ্রহণ
করেন সেলিম আল দীন। বিশ্বসাহিত্যের ধ্রুপদি ধারায় শ্রমজীবী মানুষ এবং বাংলার আবহমানকালের
সংস্কৃতি এক মহাকাব্যিক ব্যাপ্তিদানে সার্থক হন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা
ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি নেওয়ার পর কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেন অধ্যাপনাকে। ১৯৭৪
সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। এর পর থেকেই
তার কর্মক্ষেত্র বিস্তৃততর হতে থাকে। ১৯৮৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তার উদ্যোগেই
খোলা হয় নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে এ বিভাগকে
তিনি অধিষ্ঠিত করেন মর্যাদার আসনে। অধ্যাপনার পাশাপাশি এ দেশের নাট্যশিল্প বিশ্ব নাট্যধারার
সঙ্গে সমপঙ্ক্তিতে সমাসীন করার লক্ষ্যে ১৯৮১-৮২ সালে দেশব্যাপী গড়ে তোলেন বাংলাদেশ
গ্রাম থিয়েটার। এর আগেই অবশ্য তার আজীবনের শিল্পসঙ্গী নাট্যনির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফের
সঙ্গে যুক্ত হয়ে ঢাকা থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন।
ছোটবেলা থেকেই তার লেখকজীবন শুরু হলেও ১৯৬৮ সালে কবি আহসান হাবীব
সম্পাদিত ‘দৈনিক পাকিস্তান’ (অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলা) পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে কালো
মানুষদের নিয়ে প্রথম বাংলা প্রবন্ধ ‘নিগ্রো সাহিত্য’ প্রকাশিত হয়। তার প্রথম রেডিও
নাটক ‘বিপরীত তমসায়’ ১৯৬৯ সালে এবং প্রথম টেলিভিশন নাটক আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায়
‘লিব্রিয়াম’ প্রচারিত হয় ১৯৭০ সালে। ‘বহুবচন’ কর্তৃক প্রযোজিত হয় তার প্রথম মঞ্চনাটক
‘সর্প বিষয়ক গল্প’ ১৯৭২ সালে। এর পর থেকে একের পর এক নতুন নতুন বিষয় ও আঙ্গিকে সৃষ্ট
তার নাটক উচ্চারিত হয় বাংলা মঞ্চে, টেলিভিশনে। শুরু করেছিলেন বিদেশ অনুপ্রাণিত নিরীক্ষাকে
ভর করে, কিন্তু খুব শিগগিরই তা বর্জন করে বাংলার মধ্যযুগীয় নাট্যরীতির সম্ভারে গড়ে
তুললেন নিজর জগৎ। ভাঙা মানুষ, তারুণ্যের বিলীয়মান উপজাতি, লাঞ্ছিত নারী এবং নিচুতলার
মানুষেরই ভিড় লভ্য তার নাটকে। পাশ্চাত্য শিল্পের সব বিভাজনকে বাঙালির সহস্র বছরের নন্দনতত্ত্বের
আলোকে অস্বীকার করে এক নবতর শিল্পরীতি প্রবর্তন করেন তিনি। যার নাম দেন ‘দ্বৈতাদ্বৈতবাদী
শিল্পতত্ত্ব’।
আখ্যান বা বর্ণনাত্মক নাট্যরীতিতে লেখা উপাখ্যানগুলোয় তিনি কাব্য,
উপন্যাস, চিত্রকর্ম প্রভৃতি শিল্পধারাকে এক মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করেছেন।
মধ্যযুগের বাংলা নাট্যরীতি নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। বাংলাদেশে একমাত্র
বাংলা নাট্যকোষেরও তিনি প্রণেতা। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণকেন্দ্রিক এথনিক থিয়েটারেরও
তিনি উদ্ভাবনকারী। ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৬ সালে পান জাতীয়
চলচিত্র পুরস্কার। ২০০৭ সালে একুশে পদকে ভূষিত করা হয় তাকে। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের
উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি মর্ত্যলোকের মায়া ত্যাগ করে চলে
যান অনন্তলোকে। কিন্তু রেখে যান তার অবিনশ্বর মহাকাব্যিক সব সৃষ্টিসম্ভার। যে জীবন
তিনি ধারণ করেছিলেন তা যুগস্রষ্টা শিল্পীর জন্য স্বল্পায়ুরদ কিন্তু যে জীবন তিনি যাপন
করেছিলেন এবং ছুঁয়েছিলেন তার ব্যাপ্তি সীমাতীত। গৌরব ও সাফল্যের শীর্ষস্থানে তাঁর সীমান্ত।
সেলিম আল দীনের রচনার নিত্যপাঠ নবতর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করায় পাঠককে। বিনম্র শ্রদ্ধায়
স্মরণ করি তাঁকে।