× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

পঁচাত্তর ট্র্যাজেডি : কিছু অজানা বৃত্তান্ত

মিনার মনসুর

প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৩ ১২:৫০ পিএম

মিনার মনসুর।

মিনার মনসুর।

কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলাম না আমরা। একপর্যায়ে আমরা একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। সেটি হলো, যত বাধাই আসুক, যথাযথ ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে আমরা বঙ্গবন্ধুর প্রথম শাহাদতবার্ষিকী পালন করব। সে অনুযায়ী রাত ১২টা থেকে কুরআনখানি শুরু হলো। একই সঙ্গে চলতে লাগল কাঙালি ভোজের আয়োজন। কেউ চাল দিল, কেউ ডাল। একবস্তা চাল দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রতি নিবেদিত চাক্তাইয়ের একজন আড়তদার। একমাত্র গরুটি কিনে দিয়েছিলেন স্থানীয় নিভৃতচারী এক ব্যাংক ম্যানেজারÑ যিনি বঙ্গবন্ধুর জন্য নীরবে অশ্রুপাত করতেন। খুব সন্তর্পণে সমমনা সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হলো মিলাদ হবে। বঙ্গবন্ধুসহ সেই কালরাতের শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত হবে। হবে সংক্ষিপ্ত একটি স্মরণসভাও। 

রাত ১টার দিকে আসে পুলিশের কয়েকটি গাড়ি। তারা জানতে চান, এখানে কী হচ্ছে। আমরা সত্য কথাই বলি। তারা আয়োজকদের নাম-ঠিকানা জানতে চান। আমি প্রথমেই আমার ও আমার বড় ভাই রাশেদ মনোয়ারের নাম বলি। পরে ওদের চাপের মুখে আরও কয়েকজনের নাম বলি। এখন ভেবে শিহরিত হচ্ছি যে আমরা দুভাই ছাড়া মূল উদ্যোক্তাদের ৫ জনই ছিল স্কুলের অষ্টম থেকে দশম শ্রেণির ছাত্র। সব তথ্য জানার পর যথারীতি পুলিশ তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে। যতদূর মনে আছে, সেদিন তারা আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছিলেন।

রান্নার কাজ শেষ। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আমরা যখন মিলাদের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি ঠিক তখনই শুরু হয়ে যায় দৌড়াদৌড়ি আর চিৎকার। কী হচ্ছে বুঝতে না পারলেও আমরা কয়েকজন দাঁড়িয়ে থাকি। যা হওয়ার হবে! ঠিক তখনই আর্মির গাড়িটি এসে থামে আমাদের সামনে। পেছনে আরও দুটি। উত্তেজিত ভঙ্গিতে একজন অফিসার নেমে আসেন গাড়ি থেকে। কিছুটা অবাকও হন আমাদের অনড় অবস্থান দেখে। পুলিশের দায়িত্বরত একজন কর্মকর্তা এসে তাকে স্যালুট করেন। কিছুটা রাগত স্বরে তিনি জানতে চান, এখানে কী হচ্ছে? পুলিশ কর্মকর্তা আমতা আমতা করে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। 

সামরিক কর্তা চিৎকার করে জানতে চান, এখানে নেতা কে? আমরা দুভাই এগিয়ে যাই। বলি, ‘আমরা।’ পেছনে তাকিয়ে দেখি স্কুলপড়ুয়া সেই বালকের দল আমাদের ছেড়ে যায়নি। আর্মি অফিসারও চোখ কুঁচকে তাদের দেখেন। তারপর ওয়াকিটকিতে কার সঙ্গে যেন ‘স্যার স্যার’ করে কথা বলেন কয়েক মিনিট। বলেন, ‘ও কিছু না স্যার। কয়েকটা পিচ্চি। পুলিশকে বলে দিচ্ছি। ওরাই সব সামাল দেবে।’

সেদিন আমরা মিলাদ করতে পারিনি। হয়নি কাঙালি ভোজও। রান্না করা খাবারগুলো হাঁড়িসুদ্ধ ছুড়ে ফেলা হয়েছিল পার্শ্ববর্তী ডোবায়। তারপরও সব বাধা অগ্রাহ্য করে বিকালে ছোট আকারের একটি স্মরণসভা হয়েছিল। খোরশেদ আলম সুজন, বশিরউদ্দিন মাহমুদ ও জামশেদুল আলম চৌধুরীসহ আত্মগোপনে থাকা চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের বেশ কজন নেতাকর্মী অংশ নিয়েছিলেন তাতে। তবে দীর্ঘ সাড়ে চার দশক পর যখন আমি সেই দিনটিকে পুনর্নির্মাণ করতে চাচ্ছি, সেই সব অকুতোভয় বালকের কথা ভেবে আমার চোখ ভিজে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই বহুদিন। সবার নামও মনে নেই। তবে লিটন (জামশেদুল হায়দার) নাসির ও নিখিলের কথা আমি কীভাবে বিস্মৃত হব? সত্যি বলতে কী, সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি নিয়েছিল তারাই। এ মুহূর্তে মনে পড়ে গেল আমার স্কুলজীবনের বন্ধু শাহরিয়ার খালেদের কথাও। সেও ছিল বুক চিতিয়ে। সূর্যসেন ও প্রীতিলতার উত্তরসূরিদের নত মস্তকে শ্রদ্ধা জানাই। তারাই তো আমাদের সাহস জুগিয়েছিল সেদিন। 

কয়েক মাসের ব্যবধানে আমাদের হাতে আসে কবি নির্মলেন্দু গ‍ুণের সেই অসামান্য কবিতাটিÑ ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’। বাংলা একাডেমির এক অনুষ্ঠানে স্বকণ্ঠে কবিতাটি পাঠ করে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। সেই কবিতা তখন আমাদের ভেতরে যে কী বিপুল অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল তা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। তাৎক্ষণিকভাবে কবিতাটির শত শত কপি গোপনে মুদ্রিত করে আমরা জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিই। বঙ্গবন্ধুর ছবি-সংবলিত ভূপেন হাজারিকার গানের সেই বাণী এবং নির্মলেন্দু গ‍ুণের এই কবিতা শুধু যে আমাকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল তা-ই নয়, হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো আমরা প্রতিবাদের সর্বোত্তম পথটিও পেয়ে যাই। সেই শুরু।

‘বঙ্গবন্ধুর তৃতীয় শাহাদতবার্ষিকী স্মরণিকা’ হিসেবে ১৯৭৮ সালের ১৫ই আগস্ট আমরা প্রথম প্রকাশ করি ‘এপিটাফ’। এ নামকরণের মূলেও ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার বিষাদময় পটভূমি। ডিমাই ১/৮ সাইজের ৪০ পৃষ্ঠার এ সংকলনে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ৪টি প্রবন্ধ, একটি সম্পাদকীয় (পুনর্মুদ্রিত) এবং ১২টি কবিতা ছাপা হয়। প্রচ্ছদে তুলে ধরা হয় বঙ্গবন্ধুর স্মরণীয় কিছু বাণী। এটি প্রকাশ করতে গিয়েও অভাবনীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় আমাদের। পত্রিকাটির কাজ হচ্ছিল চট্টগ্রামের ঘাটফরহাদবেগের কাকলি প্রেসে। হঠাৎ সেখানে হানা। ছাপানো ফর্মাগুলো নিয়ে যায় পুলিশ। চলে তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ। মালিক (নামটি এখন আর মনে করতে পারছি না) বেঁকে বসেন। বন্ধ হয়ে যায় পত্রিকার কাজ। আমাদের হতাশা যখন চরমে, তখনই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন চট্টগ্রামের বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ আল হারুন। 

বনেদি পরিবারের সন্তান হারুন ভাই তখন চট্টগ্রামের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দৈনিক ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকারও সম্পাদক। সেই দুঃসময়েও হাতে গোনা যে কজন আওয়ামী লীগ নেতা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গবন্ধুভক্ত নেতাকর্মীদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন নিজের বাসগৃহের দরজা, হারুন ভাই তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তিনিই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ট্রাস্টের মাধ্যমে পরিচালিত একটি প্রেসে ‘এপিটাফ’ মুদ্রণের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। নাম ছিল ‘অগ্রসর প্রিন্টিং প্রেস’। কালিঝুলিময় প্রায় অন্ধকার ভৌতিক সেই প্রেসে বাইরে তালা দিয়ে রাতে আমরা কাজ করতাম লুঙ্গি পরে মাথায় টুপি দিয়ে। তখনই আমরা খবর পাই যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রচারপত্র প্রকাশ করার কারণে সামরিক গোয়েন্দারা তুলে নিয়ে গেছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের এক ছাত্রসহ দুই তরুণকে। তাদের মধ্যে একজন প্রাণে বেঁচে গেলেও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন সেনা নির্যাতনে।

‘এপিটাফ’ আমাদের সাহস বাড়িয়ে দেয়। পরের বছরই আমরা প্রকাশ করি ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রতিবাদী কবিতা ও ছড়া সংকলন ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’ প্রকাশিত হয়ে গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। স্বল্প পরিসরের লিটলম্যাগধর্মী এ-প্রকাশনাটি তখন বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। প্রতিবাদী তরুণ লেখক ও সংস্কৃতিকর্মীদের উদ্যোগে প্রায় একই সময়ে আরও কিছু স্মরণিকা-সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। তবে আমাদের জানা মতে, পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে বাংলাদেশে ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ই হলো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ স্মারক সংকলন বা স্মারকগ্রন্থÑ যেখানে কবিতা ছাড়াও মূল্যায়নধর্মী খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল। 

চট্টগ্রামের এপিটাফ প্রকাশনী (৩৮৬ সিরাজউদ্দৌলা সড়ক, আন্দরকিল্লা) থেকে সর্বমোট ১৩১ পৃষ্ঠার এ-স্মারকগ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বরে। বঙ্গবন্ধুর চতুর্থ শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষে আমরা এটি প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু যে-প্রেসে গ্রন্থটি ছাপার কাজ চলছিল শেষ মুহূর্তে সেখানে গোয়েন্দা নজরদারি শুরু হওয়ায় এর প্রকাশনা এক মাস পিছিয়ে যায়। তবে আমাদের উদ্দেশ্য আশাতীত সফল হয়েছিল। 

তখন কোনো সংকলনই ৫০০ কপির বেশি ছাপা হতো না। আমরা সাহস করে ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’-এর ১২৫০ কপি ছেপেছিলাম। প্রকাশের মাত্র এক মাসের মধ্যেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল সব কপি। তারপরও চাহিদা ছিল বিপুল। সারা দেশ থেকে অসংখ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কপির জন্য আমাদের ক্রমাগত তাগাদা দিয়েছেন। অগ্রিম টাকাও পাঠিয়েছেন অনেকে। দেশের বাইরে থেকেও আমরা বহু চিঠি পেয়েছি। তার মধ্যে আমেরিকার ‘লাইব্রেরি অব কংগ্রেস’-এর চিঠিও ছিল। তারাও বেশ কিছু কপি কিনতে চেয়েছিল ঢাকার একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। কিন্তু সেনাশাসকদের অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ও ভীতির কারণে কোনো প্রেসই গ্রন্থটি পুনর্মুদ্রণ করতে রাজি হয়নি। পরে অবশ্য ১৯৯৮ ও ২০১০ সালে গ্রন্থটির আরও দুটি ঢাউস সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। তবে সংকলনটি প্রথম প্রকাশের অভিজ্ঞতা আমাকে আজও শিহরিত করে।

আমাদের মধ্যে তীব্র ক্রোধ ছিল এ কথা সত্য। ছিল ঘাতকদের প্রতি পর্বতপ্রমাণ ঘৃণা। কিন্তু ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ কোনো তাৎক্ষণিক আবেগের ফসল ছিল না। বহু বিনিদ্র রাত আমরা উৎসর্গ করেছি এর পেছনে। আমাদের সাধ ছিল আকাশচুম্বী। প্রথমে আমরা ভেবেছি, বিশ্বের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া সংগ্রহ করে তা গ্রন্থাকারে প্রকাশ করব বাংলা ও ইংরেজিতে। আমাদের বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিল, ফিদেল ক্যাস্ট্রো ও ইন্দিরা গান্ধীসহ সেই সময়ের বিশ্ববরেণ্য নেতারা অবশ্যই এতে সাড়া দেবেন। আর তাদের সম্মিলিত প্রতিবাদ কেবল বিশ্বজনমত গঠনেই সহায়ক হবে না, বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর ক্ষেত্রেও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কিন্তু সাধ থাকলেও সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সাধ্য আমাদের ছিল না। ফলে আমরা আমাদের ভাবনার বৃত্তকে সংকুচিত করে ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ প্রকাশে উদ্যোগী হই। 

সংকলনটি প্রকাশের উত্তেজনায় আমরা এতটাই আচ্ছন্ন ছিলাম যে শুরুতে অর্থসংস্থান কীভাবে হবে সে-কথা আমরা একবারও ভাবিনি। এ কারণে পরে আমাদের অনেক ভুগতেও হয়েছে। কিন্তু আমরা তা গ্রাহ্য করিনি। লেখার জন্য লেখক, কবি ও বুদ্ধিজীবীদের দুয়ারে দুয়ারে ধরনা দিয়েছি। চট্টগ্রাম থেকে এসে দিনের পর দিন পড়ে থেকেছি ঢাকায়। ঢাকার পথঘাট ভালো চিনতাম না। অগ্রজ কবীর আনোয়ার (চলচ্চিত্র নির্মাতা), কবিবন্ধু জাফর ওয়াজেদ (বর্তমানে পিআইবির মহাপরিচালক), রেজা সেলিম ও মুজাহিদ শরীফকে নিয়ে খ্যাত-অখ্যাত প্রায় সব বুদ্ধিজীবী ও লেখকের দরজার কড়া নেড়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফরিদপুরের সন্তান ‘স্বকীয়তা’ সম্পাদক ইসরাইল খানও (বর্তমানে বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক) আমাদের অকুণ্ঠ সহায়তা দিয়েছেন। অভিজ্ঞতা তিক্ত-মধুর। বোস প্রফেসর আবদুল মতিন চৌধুরী, ড. মযহারুল ইসলাম ও আবু জাফর শামসুদ্দীনসহ কেউ কেউ সস্নেহে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। কেঁদেছেন শিশুর মতো। আবার অনেকে মুখের ওপর দরজা বন্ধও করে দিয়েছেন। তাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বিশেষ অনুগ্রহভাজন ব্যক্তির সংখ্যাও কম ছিল না। তবে আমরা হাল ছেড়ে দিইনি। আমাদের সৌভাগ্য যে অন্নদাশঙ্কর রায় ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখাও আমরা পেয়েছিলাম। কবি বেলাল চৌধুরীর মাধ্যমে সেই লেখা আমাদের হস্তগত হয়েছিল।

‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ যৌথভাবে সম্পাদনা করেছিলাম আমি ও আমার সহপাঠী দিলওয়ার চৌধুরী। আমরা উভয়ে তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। আর গ্রন্থটি মুদ্রণের দুঃসাহস দেখিয়ে আমাদের হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন নিবেদন প্রেসের কর্ণধার মহিউদ্দিন শাহ আলম নিপু। পাশে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে আরও কেউ কেউ অবশ্যই ছিলেন। তার মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য দুটি মানুষের কথা আমাকে বলতেই হবে। তাঁরা হলেনÑ চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবু ছালেহ ও ছাত্রনেতা বশির উদ্দিন মাহমুদÑ যার কথা আগেই বলা হয়েছে। ছালেহ ভাই দিনের পর দিন আমাদের নিয়ে পায়ে হেঁটেই সারা শহর চষে বেড়িয়েছেন অর্থ সংগ্রহের জন্য। হাত পেতেছেন অনেকের কাছে। খুব যে সাড়া পাওয়া গেছে তা বলা যাবে না। তবে ছালেহ ভাই সেদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তা আমাদের আজও প্রেরণা জোগায়। অথচ তাঁর নিজেরই তখন খুব খারাপ অবস্থা। তা সত্ত্বেও তাঁর বৃহৎ হৃদয়ের দরজা সব সময়ই খোলা ছিল আমাদের জন্য। তিনি ছিলেন একই সঙ্গে আমাদের বন্ধু ও নেতা। 

গ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছিলেন সেদিনের ঝকঝকে তরুণ কবি ও ভিন্নধারার খ্যাপাটে শিল্পী খালিদ আহসান। প্রচ্ছদের বিষয়বস্তু ছিলÑ লাল পটভূমিতে কালো একটি পাথরÑ যা নির্মিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যাপরবর্তী সময়ে তাঁকে নিয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত ভয়ংকর সব খবরের কাটিং দিয়ে। সেই পাথর ফুঁড়ে ফুটে আছে একটি গোলাপ। এটি ছিল স্বদেশের রক্তাক্ত বুকের ওপর চেপে বসা জগদ্দল পাথরের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদের একটি প্রতীকী রূপ। 

পরে ১৯৮০ সালের ১৫ই আগস্টে আমরা ‘আবার যুদ্ধে যাবো’ নামে একটি দুঃসাহসী বিশেষ বুলেটিন প্রকাশ করিÑ যা পঁচাত্তরপরবর্তী প্রতিবাদী ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে মুজিববর্ষে বাংলা একাডেমি কর্তৃক পুনঃপ্রকাশিত ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ গ্রন্থটির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। 

এটাকে এক অর্থে ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’-এর সম্পূরক প্রকাশনাও বলা যেতে পারে। কারণ ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’-এ আমরা যে ক্ষোভ ও জনপ্রতিবাদকে ভাষা দিতে চেয়েছিলাম, এ প্রকাশনাটিতে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। এতে সেই সময়ের দেশবরেণ্য রাজনীতিক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের বঙ্গবন্ধু-হত্যার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হয়েছিল। তার মধ্যে স্বনামখ্যাত আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, সুফিয়া কামাল, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, আবু জাফর শামসুদ্দীন, আবদুল মতিন চৌধুরী, কলিম শরাফী, কবীর চৌধুরী, সন্তোষ গুপ্ত, আনিসুজ্জামান, দেবদাস চক্রবর্তী, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, আলী আকসাদ, রাহাত খান, বেলাল চৌধুরী, নির্মলেন্দু গ‍ুণ, আলী যাকের, আবদুল জব্বার, কবীর আনোয়ার ও কামাল চৌধুরীসহ বহু বিশিষ্ট জনের স্বাক্ষরসংবলিত প্রতিক্রিয়া ছাপা হয়েছিল। এই বুলেটিনটি বঙ্গবন্ধু হত্যাপরবর্তীকালে প্রকাশিত প্রতিবাদী ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। 

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম একক কাব্যগ্রন্থটিও প্রকাশিত হয় এপিটাফ প্রকাশনী থেকে। মহাদেব সাহার সাড়া জাগানো এ-গ্রন্থটি আমরা প্রকাশ করি ১৯৮২ সালে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয় আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে’। বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করা এ-গ্রন্থটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে আমার জীবন। বেশ কিছুদিন পালিয়ে বেড়াতে হয় আমাকে। দেশে তখন লে. জে. এরশাদের স্বৈরশাসন। সামরিক শাসনের কোপানলে পড়ে মাঝপথে থেমে যায় আমাদের এ ক্ষুদ্র প্রতিবাদী প্রকাশনা উদ্যোগটি। তবে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র পরিসরে শোককে শক্তিতে পরিণত করার প্রত্যয়ে ‘ভয় হতে অভয় মাঝে’ আমাদের যে-যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ততদিনে ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। সেদিনের সামান্য চারাগাছটি পরিণত হয়েছে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের অসামান্য অপ্রতিরোধ্য এক মহীরুহে।

  • লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক পরিচালক, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা