× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

রাষ্ট্রচিন্তা

ঐক্য কেন অত্যাবশ্যক

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০২৩ ০০:২৯ এএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

ঐক্যের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। একা একা কেউই কোনো কিছু সৃষ্টি করতে পারে না, প্রয়োজন হয় সমর্থন ও সহযোগিতার এবং এজন্যই দরকার ঐক্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে ঐক্যের বড়ই অভাব। এর বিপরীতে বিচ্ছিন্নতার খুব বেশি তৎপরতা। আমাদের এই বিচ্ছিন্নতার ইতিহাস নতুন নয়, অনেক পুরোনো। এ ভূখণ্ড দীর্ঘদিন ছিল পরাধীন। পরাধীন থাকলে দেশকে নিজের বলে মনে হয় না। আমাদের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাধীন বাংলাদেশে এ দেশটাকে কজন নিজের বলে মনে করেন?

আমাদের সামনে এই নজিরও আছে, এখানে যৌথ কাজ এগোয় না। সমষ্টিগত কর্মকাণ্ড সবচেয়ে বেশি যেখানে জরুরি সেটা হলো রাজনৈতিক অঙ্গন। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, রাজনৈতিক দলগুলো সহজেই ভেঙে যায়, দুই টুকরো হয়, টুকরো টুকরো যে হয় না তাও নয়। ডানপন্থি কিংবা বামপন্থি সবার ক্ষেত্রেই তা দেখা যায়। এসব বিচ্ছিন্নতা ঘটেছে কিংবা ঘটে একটা মূল বাস্তবতার দরুন। সেটা হলো, নিম্নমধ্যবিত্তের কর্তৃত্ব। মধ্যবিত্তের নয়, নিম্নমধ্যবিত্তেরই। আমাদের রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি সর্বত্রই কর্তৃত্ব করে এই শ্রেণি। এই শ্রেণিচরিত্রের মধ্যেই বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। তাদের প্রধান কাজ হচ্ছে ঈর্ষা করা। ঈর্ষা করে, কিন্তু ঘৃণা করে। ঈর্ষা করে কাকে? বাইরের কাউকে নয়, করে নিকট প্রতিবেশী ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের। এমনই সংকীর্ণ যে, এর বাইরে যায় না। ওপরে যারা আছে তাদের দেখে তাদের টেনে নামানো যাবে এমনটা ভাবে না নিচে যারা রয়েছে তাদের উপেক্ষা করে। নিম্নমধ্যবিত্তের ঈর্ষার পাত্র হচ্ছে তারা, যারা কাছে রয়েছে অথচ ওপরে উঠে যাচ্ছে বলে মনে হয়। পরশ্রীকাতরতা কাছের মানুষের জন্যই।

যে সমাজকাঠামো বিদ্যমান সেটি ইংরেজ একদিন নিজের প্রয়োজনে তৈরি করেছিল। এটি শোষণমূলক। এতে অল্প মানুষের সুযোগ রয়েছে বেশি মানুষকে শোষণ করার; শোষণ করে ধনী হওয়ার। এ ব্যবস্থা উৎপাদনে উৎসাহী নয়, উৎসাহী লুণ্ঠনে। সমাজের এই গঠন এবং পুঁজিবাদের আদর্শ এদের বদলাতে না পারলে সৃষ্টিশীলতা বাড়বে না। কেন না এরা উভয়েই হচ্ছে মস্তবড় প্রতিবন্ধক। সৃষ্টির জন্য অবশ্যই একতা চাই। ঐক্য অত্যাবশ্যক। আমরা বারবার ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। যোগ দিয়েছি বিভিন্ন আন্দোলনে। কিন্তু ঐক্য টেকেনি। সবচেয়ে বড় ঐক্য দেখা গেছে একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্বে। এর তো কোনো তুলনা হয় না। শ্রেণি, পেশা, সম্প্রদায়, অঞ্চল সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে মানুষ এক হয়েছিল একটি স্বপ্নের দ্বারা তাড়িত হয়ে। দুঃস্বপ্নের মধ্যে ছিল আমাদের প্রতিদিনের বসবাস, কিন্তু আমরা অসম্ভবরকমের সৃষ্টিশীল হয়ে উঠেছিলাম। যুদ্ধের ব্যাপারে আমাদের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না, গেরিলা যুদ্ধের তো নয়ই; অথচ গেরিলা যুদ্ধে কি অসাধারণ উদ্ভাবনশক্তি তখন দেখা গেছে। সুশিক্ষিত ও সুসজ্জিত ৯০ হাজার পাকিস্তানি সেনা যে আত্মসমর্পণ করেছিল, সেটা তো এমনি এমনি ঘটেনি। এই ঘটনা ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সৃষ্টিশীলতার কাছে পাকিস্তানি হানাদারদের ধ্বংসাত্মক শক্তির পরাজয়। কিন্তু দুঃখজনক হলো, সমাজতান্ত্রিক ঐক্যের যে আলো জ্বলে উঠেছিল, তা নিভে গেল, পথ হারিয়ে আমরা লিপ্ত হলাম পারস্পরিক সংঘর্ষে। এ পরাজয়ও ঐতিহাসিক বটে। বাহাত্তরের সংবিধানে তকাটাছেঁড়া হলো, অনেক কিছু বাদ দেওয়া হলো যা ওই পরাজয়েরই স্মারকচিহ্ন।

বর্তমান সমাজ তিন ভাগে বিভক্ত। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র। এটা নানাভাবে বোঝা যায়। টের পাওয়া যায় শিক্ষার দিকে তাকালেও। শিক্ষা এখন সমাজের মতোই খাড়াখাড়ি তিন ভাগ হয়ে গেছেÑইংরেজি মাধ্যম, বাংলা মাধ্যম ও মাদ্রাসা। ইংরেজি মাধ্যম বিত্তবানদের জন্য, মধ্যবিত্তদের জন্য রয়েছে বাংলা মাধ্যম আর গরিব মানুষের ভরসা মাদ্রাসা। শিক্ষার সঙ্গে সমাজের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তো থাকবেই। শিক্ষা সমাজের ওপর ভর করেই দাঁড়িয়ে থাকে এবং সমাজের যে বাস্তবতা তাকেই প্রতিফলিত করে। কিন্তু সত্য তো এটাও যে, শিক্ষা সমাজকে বদলে দেবে এটাই আমরা আশা করি। নইলে ‘শিক্ষা শিক্ষা’ বলে অত করে আওয়াজ তোলা কেন? আমাদের প্রত্যাশা থাকে যে শিক্ষা জাতিগঠনে সাহায্য করবে। তার অর্থ তো শিক্ষা সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করবে। কিন্তু বাস্তবে যা ঘটছে সেটা তো দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণ উল্টো ব্যাপার। ভিন্ন নয়, একেবারেই উল্টো। সমাজের ভেতর যে শ্রেণিবিভাজন, শিক্ষা তাকেই বাড়িয়ে তুলছে। শিক্ষার তিন ধারা সমাজের তিন ভাগকে পরস্পর আলাদা করে দিচ্ছে। শিক্ষা যত বাড়ছে, বিভাজনও ততই যেন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি একাধারে করুণ ও হাস্যকর।

শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কার চাই। কিন্তু তার জন্য জরুরি হচ্ছে, সমাজে পরিবর্তন আনা যাতে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়। যে গণতন্ত্রের ভিত্তিই হচ্ছে মানুষে মানুষে অধিকার ও সুযোগের সাম্য গড়ে তোলা। শিক্ষার ক্ষেত্রে যে অনগ্রসরতা এর কারণ সমাজের ভেতরেই রয়েছে। সেখানে যে বৈষম্য ও বিভাজন বিদ্যমান, শিক্ষার ব্যাপারেও তারই প্রতিফলন ও প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই। আরও আছে রাজনীতি। কোনো কিছুই রাজনীতির বাইরে নয়। আমরা তুমুল রাজনৈতিক আন্দোলন করেছি, দেশ স্বাধীন করেছি কিন্তু সমাজ বদলায়নি। আমাদের রাষ্ট্র উন্নতির যে আদর্শকে শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরেছে সেটা হলো পুঁজিবাদ। রাষ্ট্র পারছে না তার দায়িত্ব পালন করতে এবং তারই নানা লক্ষণ প্রকাশিত হয় বিভিন্নরূপে। উন্নতি অল্প মানুষকে খুশি করে, অধিকাংশ মানুষকেই কাঁদায়। এ উন্নতি নদীর মতো সমতলে প্রবহমান থাকে না, নিচের দিকে নেমে যায় না, আশপাশের ভূমিকে উর্বর করে না। উন্নতির এ তৎপরতা খাড়াখাড়ি ওপরের দিকে উঠে যায়। তার চরিত্রটা পাহাড়-পর্বতের মতো নিরেট ও নিষ্ঠুর; সে দাঁড়িয়ে থাকে অন্যদের ঘাড়ের ওপর, কখনও নত হয় না, জলসিঞ্চন তো পরের ব্যাপার, তার উৎসাহ বরং প্রস্তর নিক্ষেপে। উন্নতির এ পাহাড় ও কালাপাহাড়গুলো বাংলাদেশের মানুষকে বৈষম্যের ছায়ামুক্ত করেনি। ব্যক্তিগতভাবে অল্প কিছু মানুষ যতই উন্নত হচ্ছে, সমষ্টিগতভাবে অধিকাংশ মানুষের জন্য অবনতি অনিবার্য হয়ে পড়ছে।

মুক্তি লক্ষ্যার্জনের সমষ্টিগত স্বপ্নটাই ছিল আমাদের জন্য চালিকাশক্তি। সেটিই ছিল সাম্যে, সবার বুকের ভেতর। ওই স্বপ্নের প্রণোদনাতেই আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম। মুখোমুখি হয়েছিলাম নিপীড়নকারী রাষ্ট্রের। এজন্য আমাদের যে আত্মত্যাগ করতে হয়েছে, তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। শেষ পর্যন্ত আমরা জয়ী হয়েছি, স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। কিন্তু মুক্তির ওই সর্বজনীন স্বপ্নটি আমরা ধরে রাখতে পারিনি। ব্যক্তিগত স্বার্থ অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালায়। মানুষে মানুষে মৈত্রী গড়ে উঠতে দেয় না। পরস্পরকে পরস্পরের গুরুতর শত্রু করে তোলে। মুক্তিযুদ্ধ ছিল দেশপ্রেমের চূড়ান্ত প্রকাশ। প্রতিটি মানুষ তখন বিপন্ন, কিন্তু প্রত্যেকেই যুক্ত ছিল প্রত্যেকের সঙ্গে, একটি অদৃশ্য ও সূক্ষ্ম অথচ অত্যন্ত কার্যকর বন্ধনে আমরা এক হয়ে গিয়েছিলাম। একই সমতলে ছিল আমাদের অবস্থান। বাস্তবিকতার দুঃসহ যন্ত্রণার ভেতরে বসবাস করে মুক্তির ওই স্থির স্বপ্ন আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছিল। কিন্তু স্বাধীন দেশে আমরা ঐক্য ধরে রাখতে পারলাম না। নির্বাচন প্রক্রিয়া, রাজনীতি সবকিছুই হলো প্রশ্নবিদ্ধ। গণতান্ত্রিক রাজনীতির যে ঔজ্বল্য তা কেন দৃশ্যমান নয়, এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন।

গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করা যাবে কী করে? প্রতিষ্ঠা করার পথ একটাই, সেটা হচ্ছে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন; যে আন্দোলন অবশ্যই হতে হবে বৈষম্যবিরোধী অর্থাৎ যার মূল কথা পুঁজিবাদবিরোধিতা। আমাদের এখন যে রাজনীতি চলছে তার আদর্শগত ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন আছে। দুটি প্রধান দল দুটি ধারা তৈরি করেছে। তার মূল উদ্দেশ্য ক্ষমতায় যাওয়া এবং থাকা। রাজনীতি সব সময়ই ক্ষমতাকেন্দ্রিক, ক্ষমতার বাইরে রাজনীতির কোনো অবস্থান নেই। কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ডে মানুষের আস্থায় আঘাত লেগেছে। মানুষের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য যাদের ভূমিকা রাখার কথা তারা তা পারছেন না। আমাদের বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতির দুটি ধারা রয়েছেÑএকটি আন্দোলনের, অন্যটি নির্বাচনের। এ দুটি এক হয়। আন্দোলন চায় সমাজ পরিবর্তন। নির্বাচন চায় সমাজ পরিবর্তন। এ দুয়ের ভেতর পার্থক্যটা একেবারেই মৌলিক। আমাদের রাজনৈতিক অর্জনগুলো আন্দোলনের পথেই এসেছে, নির্বাচনের পথে নয়। সত্তরের নির্বাচনের পর যে আমাদের যুদ্ধে যেতে হয়েছে এটা মোটেই তাৎপর্যহীন নয়। মূল কথাটা হলো, রাজনীতির কোনো বিকল্প নেই এবং রাজনীতিকে যদি সঠিক পথে এগোতে হয়, তাহলে রাজনীতিকদের জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থেকে সেই পথে নিয়ে যেতে হবে।


  • শিক্ষাবিদ ও সমাজবিশ্লেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা