জলবায়ু পরিবর্তন
লিয়ানা এস ওয়েন
প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৩ ১৪:২০ পিএম
চলতি বছরের গ্রীষ্মে তীব্র গরমে উত্তপ্ত সবাই। ওয়ার্ল্ড মিটিওরলজিক্যাল অর্গানাইজেশনের তথ্য অনুসারে জুলাই ছিল সবচেয়ে উত্তপ্ত মাস। ১৯৬০ সালের থেকে প্রতি বছর গড়ে দুটি দাবদাহ হলেও চলতি বছর তা ছয়ে পৌঁছেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ধারাটি শুধু পরিবেশগত সংকট তা বলা যাবে না। এ সংকটের ফলে জনস্বাস্থ্যও বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। যেকোনো আবহাওয়াজনিত দুর্যোগ যেমন ঝড় কিংবা বন্যার তুলনায় দাবদাহে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। অধিকাংশ মৃত্যুই হিটস্ট্রোকের ফলে ঘটেছে। প্রচণ্ড গরমে শরীর যখন দেহের অভ্যন্তরীণ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের সঙ্গে সংযোগ হারায়, তখনই এমন সংকট দেখা দেয়। মানবদেহের অভ্যন্তরের যেকোনো অঙ্গ কয়েক মিনিটের মধ্যে অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ফোনিক্স অঞ্চলে টানা ৩০ দিনে তাপমাত্রা ১১০ ডিগ্রির ওপর পৌঁছায়। সেখানে অন্তত ২৫ জন হিটস্ট্রোকে মারা যান। এ ছাড়া আরও ২৪৯টি মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সিএনএনের সাক্ষাৎকারে এক চিকিৎসক জানিয়েছেন, কোভিড-১৯ মহামারির পর এই প্রথম একসঙ্গে এত রোগীকে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
তীব্র গরমে নানা ঝুঁকিপূর্ণ
শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষত হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস ও কিডনির কার্যকারিতা হ্রাস
করিয়ে অন্য জটিল রোগের শঙ্কা বাড়াতে পারে। ল্যানসেট প্ল্যানেটারি হেলথের এক পর্যবেক্ষণে
বলা হয়েছে, কার্ডিওভাসকুলার রোগে আক্রান্ত ১২ শতাংশ মানুষ প্রচণ্ড গরমে মারা যেতে পারে।
এ ছাড়া অন্য কয়েকটি পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, কিডনির জটিল রোগ কিংবা ফুসফুসের ক্ষতিকর
রোগের সঙ্গে প্রচণ্ড গরম আবহাওয়ার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। প্রচণ্ড গরমে আমাদের শরীরেরই
ক্ষতি হয় এমন নয়, ঘুম ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারের কার্যকারিতা
কমতে শুরু করে। ফলে মানসিক স্বাস্থ্যও ঝুঁকির মুখে পড়ে। ল্যানসেট ও ন্যাচার ক্লাইমেট
চেঞ্জের এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাভাবিক তাপমাত্রার তুলনায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা
বৃদ্ধি অবসাদ, দুশ্চিন্তার পাশাপাশি আত্মপ্রবণতাও বাড়ায়। মনে রাখতে হবে, তরুণ প্রজন্মের
কাছে জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যাটি একটি মানসিক সংকটও বটে। আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, তীব্র
গরমের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ রোগ সংক্রমণের শঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। ২০০৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত
পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দেখা গেছে, মশা, মাছি ও শুককীটের মাধ্যমে সংক্রমিত রোগের সংখ্যাও
বাড়তে শুরু করেছে। এসব সংক্রমণের মধ্যে লাইম রোগ রয়েছে। শুককীট থেকে ছড়ানো এ রোগ আমাদের
নিউরোলজিক্যাল ব্যবস্থা অকেজো করে দিতে পারে। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে
মশাবাহিত ওয়েস্ট নাইল রোগে অন্তত ১২৭ জন মারা গেছেন।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে ম্যালেরিয়ার
সংকট বেড়েছে। অণুজীব থেকে ছড়ানো এ রোগে গোটা পৃথিবীতে প্রতি বছর অন্তত ৫ লাখ মানুষ
মারা যায়। অতীতে এ সমস্যা শুধু আফ্রিকা অঞ্চলের হলেও গোটা বিশ্বের জন্যই ম্যালেরিয়া
এখন একটি বড় সংকট। কারণ আগে ম্যালেরিয়া ছড়ানোর জন্য যারা ঘুরতে এসেছেন তাদের দায়ী করা
হতো। কিন্তু গত কয়েক মাসে ফ্লোরিডা ও টেক্সাসের স্থানীয় অঞ্চল থেকেই এ রোগের বিস্তার
ঘটতে দেখা গেছে। অর্থাৎ ওই অঞ্চলে ম্যালেরিয়াবাহী মশার কামড়েই তারা আক্রান্ত হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ম্যালেরিয়া এখনও বড় সমস্যা নয়। কিন্তু বিশ্বের অনেক অঞ্চলেই
এমন মশাবাহিত সংক্রমণ একটি বড় সমস্যা হয়ে ধরা দিয়েছে। জলবায়ু যত পরিবর্তিত হবে ততই
পাশের দেশগুলোও নানাভাবে একে অন্যকে প্রভাবিত করবে। বিশেষত জনস্বাস্থ্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকির
মুখে পড়বে। জলবায়ুর কারণে অন্তত ২০০ ধরনের সংক্রমণ রোগ ছড়ায়। এ বিষয়টির ভয়াবহতা অনুধাবন
করতে হবে।
তাপমাত্রা বাড়ার ফলে জনস্বাস্থ্যে
যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে তা মোকাবিলার একাধিক প্রক্রিয়া রয়েছে। প্রথমে যে
অঞ্চলে তীব্র গরমে মানুষের জীবন শঙ্কার মুখে রয়েছে তা শনাক্ত করতে হবে। তারপর তাদের
চিকিৎসাসেবা দিতে হবে। বিশেষত সাইকিয়াট্রিক ও থেরাপিউটিক চিকিৎসাও অন্তর্ভুক্ত করতে
হবে। দ্বিতীয়ত, দাবদাহ মোকাবিলার জন্য আমাদের প্রস্তুতি গড়ে তুলতে হবে। কতটুকু গরম
আমাদের জন্য সহনীয় হতে পারে তা এখনই বোঝা দরকার। যখনই সন্দেহ হবে তখন ছায়াযুক্ত জায়গায়
থাকতে হবে। এয়ার কন্ডিশন রয়েছে এমন জায়গায় থাকতে পারলে ভালো। মানুষকেও সচেতন হতে হবে।
সবকিছু প্রক্রিয়া ও নীতিমালার মাধ্যমে ঠিক করা যাবে না। মানুষের মধ্যে সহযোগিতাপ্রবণতা
বাড়াতে হবে এবং কীভাবে দ্রুত চিকিৎসাসেবা নেওয়া যায় সে ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে হবে।
তৃতীয়ত, আমাদের চারপাশে যেসব নিয়ন্ত্রণাধীন উপাদান বদলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব
ঠেকানো যায়, সেগুলোর সমন্বয় করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, প্রচণ্ড গরম
আপনার ঘুম ব্যাহত করে এবং নানাভাবে মানসিক জটিলতা বাড়ায়। বাড়ির আশপাশে মশা জন্মাতে
পারে এমন পানি সরিয়ে ফেলতে হবে। মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে
হবে। এ মুহূর্তে স্বাস্থ্য খাত থেকে শুরু করে প্রতিটি খাতকে গুরুত্ব দিতে হবে কীভাবে
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শ্লথ করা যায়। কীভাবে তারা তাপমাত্রা বৃদ্ধি কমাতে অবদান
রাখতে পারে তা নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্তে আসতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন জনস্বাস্থ্যে নেতিবাচক
প্রভাব ফেলে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এ সমস্যা সামনে আরও বড় হয়ে দেখা দেবে। পরবর্তী
প্রজন্মের জন্য তা যেন বিষফোড়া হয়ে না দাঁড়ায়।
ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে ইষৎ সংক্ষেপিত
অনুবাদ: আমিরুল আবেদিন