সম্পাদকীয়
সম্পাদক
প্রকাশ : ২৮ জুলাই ২০২৩ ১২:৪৭ পিএম
চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার পথ কতটা কণ্টকাকীর্ণ এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নতুন করে নিষ্প্রয়োজন। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তির পথ মসৃণ করা যায়নিÑসংবাদমাধ্যমে উঠে আসা চিত্র এরই সাক্ষ্যবহ। এ সম্পাদকীয় স্তম্ভেই আমরা ইতঃপূর্বে তাগিদ দিয়েছি, ডেঙ্গুজনিত পরিস্থিতিতে রোগীর চিকিৎসাসেবা পাওয়া যাতে সহজলভ্য হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু ২৬ জুলাই ভোরে রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুকন্যাকে ভর্তি করাতে গিয়ে বাবার হাতে হাতকড়া লাগে। হাবিবুর রহমান ও তার স্ত্রী সাথী আকতার সন্তানকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে যে অপ্রীতিকর ঘটনার শিকার হয়েছেন, তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ২৭ জুলাই প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর সচিত্র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুকন্যাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে গিয়ে তারা কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতার মুখে পড়েন। সাত বছরের শিশু আদিবা শারীরিক জটিল পরিস্থিতি নিয়ে হাসপাতালে গেলেও তাকে কর্তৃপক্ষ ভর্তি করাতে অস্বীকৃতি জানায় শয্যাসংকটের কথা বলে। অসুস্থ সন্তানের শারীরিক জটিল পরিস্থিতিতে তার মা-বাবা দিগবিদিক হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের সঙ্গে হাবিবুর রহমানের বাগবিতণ্ডা থেকে হাতাহাতি পর্যন্ত গড়ায়। পরে তাকে পুলিশে দিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করেন হাসপাতালের একজন চিকিৎসক। এক পর্যায়ে শিশুটিকে ভর্তি করা হলেও তার বাবাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। এ অবস্থায় সাথী আকতার অসুস্থ সন্তানকে নিয়েই থানায় ছুটে যান। সেখানে গিয়ে শিশুটি আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে এ অবস্থায়ই তাকে বাসায় নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন অসহায় মা। কি দুঃসহ অবস্থা!
হাসপাতালে শয্যা খালি নেই এমনটি বলে কোনো কর্তব্যরত চিকিৎসক
অধিকতর সংকটাপন্ন রোগীকে ফিরিয়ে দিতে পারেন না। যেকোনো মা-বাবার চোখের সামনে বিপদাপন্ন
সন্তান বিশেষ করে তা যদি হয় অসুস্থতাজনিত তাহলে তাদের পক্ষে নিজেকে অবিচল রাখা কতটা
দুরূহ তা-ও বলার অপেক্ষা রাখে না। চিকিৎসক কিংবা চিকিৎসাসেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই
দায়বদ্ধ যথাযথ চিকিৎসাসেবা দিতে। কিন্তু মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্মস্পর্শী
ঘটনায় আবারও প্রতীয়মান হলো, দেশে চিকিৎসাসেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল অনেকেই তাদের
দায়-কর্তব্যের পাট চুকিয়ে ফেলেছেন। সম্প্রতি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ চিকিৎসা সেবাসংক্রান্ত
ধারাবাহিক প্রতিবেদনে যে নৈরাজ্যকর চিত্র উঠে এসেছে, ঘটে যাওয়া ঘটনাটি এ থেকে বিচ্ছিন্ন
কিছু নয়। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। একই সঙ্গে আমরা আশা করব, এমন অনাকাঙ্ক্ষিত
ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ তো বটেই, যথাযথ প্রতিকারও নিশ্চিত করতে হবে মানবিকতার মর্যাদা
রক্ষায়। হাবিবুর রহমানকে পরদিন আদালত জামিন দিলেও মানবতার বিপর্যয়ের ক্ষত তো সহজে শুকাবার
নয়।
আমরা গত করোনা দুর্যোগেও দেখেছি, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে
রোগী ও স্বজনদের অনেক ক্ষেত্রেই হেনস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছে। যতই সীমাবদ্ধতা থাকুক,
একজন রোগী যখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিংবা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন তখন তাকে মানবিক তাগিদেই
চিকিৎসা প্রদানে হেলাফেলার অবকাশ নেই। এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই আমরা এও লিখেছিলাম, ডেঙ্গু
পরিস্থিতিতে সৃষ্ট সংকটে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে অধিকতর দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বিগত করোনা দুর্যোগে মানবিক সংকটকে পুঁজি করে যেমন অনেক
ক্ষেত্রেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে, তেমনি ডেঙ্গু পরিস্থিতিতেও এর পুনরাবৃত্তি দৃশ্যমান
হয়। কোনো মানবিক সমাজে এমনটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। সন্তানকে সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে
রেখে তার বাবাকে পুলিশ বেঁধে নিয়ে যাবে তা-ও অমানবিক। রোগী কিংবা স্বজনের যথাযথ চিকিৎসাসেবা
পাওয়ার আকুতি ন্যায়সঙ্গত অধিকার এবং এর নিশ্চয়তা দেওয়া সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তো বটেই,
রাষ্ট্রেরও দায়। অসুস্থ সন্তানকে নিয়ে মা থানায় ছুটে যান চিকিৎসা না করিয়েই, এমনটি
কোন পরিস্থিতিতে হতে পারেÑএর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও নিঃসন্দেহে প্রীতিকর হতে পারে না।
আইনের প্রয়োগ কিংবা অপপ্রয়োগ নিয়ে আমাদের সমাজে বিস্তর কথা রয়েছে।
এ ক্ষেত্রে মুগদা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের যূথবদ্ধতায় যে ঘটনা ঘটেছে তা আরও জটিল
প্রশ্নের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা আশা করব, সরকার এর যথাযথ প্রতিবিধান নিশ্চিত করবে
নির্মোহ অবস্থান নিয়ে। মানবতার দায় যেকোনো মানুষের কাছে তো বটেই, সরকার কিংবা সরকারের
দায়িত্বশীলদের কাছে প্রশ্নাতীত। হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগের সত্যাসত্য
নির্ণয়ের সময় নিশ্চয়ই বয়ে যায়নি কিন্তু যথাসময়ে রোগীর চিকিৎসা না পাওয়ার ঘটনা ফ্রেমে
বন্দি থাকার বিষয় নয়। মুগদা হাসপাতালে মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত ঘটনার আশু সুবিচার কাম্য।