× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

জেন্ডার

কতটুকু ক্ষমতায়িত হয়েছে নারী

লোপা মমতাজ

প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৩ ১৩:০১ পিএম

কতটুকু ক্ষমতায়িত হয়েছে নারী

‘একবার কোন স্থলে চলন্ত ট্রেণে মেয়েদের কক্ষে একটা চোর উঠিল। চোর বহাল তবিয়তে একে একে প্রত্যেকের অলঙ্কার খুলিয়া লইল; কিন্তু লজ্জায় জড়সড় লজ্জাবতী অবলা সরলা কুলবালাগণ কোন বাধা দিলেন না। তাঁহারা সকলে ক্রমাগত ঘোমটা টানিয়া থাকিলেন। “তওবা! তওবা! কাঁহা সে মর্দ্দুয়া আ গয়া!” বলিয়া কেহ কেহ বোরকার “নেকাব” টানিলেন। পরে চোর মহাশয় ট্রেণের এলার্মের শিকল টানিয়া গাড়ি থামাইয়া নির্ব্বিঘ্নে নামিয়া গেল।’ বেগম রোকেয়ার ‘অবরোধবাসিনী’তে বাঙালি নারীকে যেভাবে দেখা গেছে সেই প্রেক্ষাপট অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। রোকেয়ার দেখা সেই নারীরা এখন আর মুখ বুজে থাকে না। চিৎকার করে আওয়াজ তুলতে শিখেছে।

দেশ এগিয়েছে। সময় পাল্টেছে। আমাদের নারীরা এখন রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন। বিচারপতি, সচিব, ডেপুটি গভর্নর, রাষ্ট্রদূত থেকে শুরু করে মানবাধিকার কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন নারী। পর্বত জয় করছেন নারী। অর্থনৈতিক উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন নারী। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে সার্বিকভাবে শিক্ষায় পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণ বেশি। দেশের ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতার ৮০ শতাংশই নারী, যারা নানা রকম উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত। দেশের পোশাক কারখানার নারী শ্রমিক এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা নারীরা মিলে দেশের নারী উন্নয়নে অভাবনীয় সাফল্য এনে দিয়েছেন। নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার শীর্ষে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের নারী অগ্রগতি আজ সারা বিশ্বে প্রশংসিত। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে শিক্ষায়-জ্ঞানে-বিজ্ঞানে গত দুই দশকে নারীর আগ্রযাত্রা চোখে পড়ার মতো। তবু মনে প্রশ্ন জাগে, গুটিকতক নারীর জীবনের উন্নয়নের ফলে কি সমাজের সর্বস্তরে নারীর জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেছে? আরও প্রশ্ন, এই উন্নয়নের ফলে মতামত প্রদানে নারী-পুরুষের সমতা কি এসেছে? নারীর প্রতি সহিংসতা কি কমেছে? কর্মক্ষেত্রে-পথেঘাটে নারী নিরাপত্তার উন্নয়ন কি ঘটছে? আইন-আদালতে নারী কি তার ওপর ঘটে যাওয়া নির্যাতনের বিচার পাচ্ছে? সম্পত্তিতে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অধিকার কি অর্জিত হয়েছে? প্রশ্ন অনেক... উত্তর মেলা ভার...।

যদি চুলচেরা বিশ্লেষণ করি তবে দেখতে পাব, নারী উন্নয়নের অন্য পিঠে রয়েছে নারীর প্রতি চরম অবহেলা, বৈষম্য ও ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র। সম্পত্তির উত্তরাধিকারের প্রশ্নে ধর্মের দোহাই দিয়ে এখনও নারীকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। সমাজে এখনও নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্য বিদ্যমান। নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনাও দিন দিন বাড়ছে। নারীর স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা না থাকায়, নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে কন্যাশিশুদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও বাড়ছে। এখনও পথঘাটে, গণপরিবহনে, অফিসে, ঘরে নারী নিরাপত্তাহীন।এখনও সমাজে বহু যুগের পুরোনো পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা প্রবলভাবে রাজত্ব করছে। ফলে পারিবারিক সহিংসতা, খুন, ধর্ষণ,অপহরণ এবং যৌন হয়রানির মতো ঘটনা বাড়ছে। সংবাদমাধ্যমে জানা যায়, ২০২২ সালে মোট ৯ হাজার ৭৬৪ জন নারী সহিংসতার শিকার হয়েছেন। যৌতুকের কারণে মারধর করা হয়েছে ২ হাজার ৬৭৫ জনকে এবং যৌতুক না পেয়ে হত্যা করা হয়েছে ১৫৫ জনকে।ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪ হাজার ৩৬০ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৫০ জনকে। নারী ও শিশু নির্যাতনের হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। দেখা যাচ্ছে বিচার, সহিংসতা, নির্যাতন প্রশ্নে নারী এখনও  অবহেলার শিকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশের ৫৪ শতাংশ নারী জীবনে একবার হলেও শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ তো গেল প্রকাশিত তথ্য। ধারণা করি অপ্রকাশিত নারী নির্যাতনের সংখ্যা আরো অনেক বেশি, যা আমাদের কোনো দিনই দৃষ্টিগোচর হবে না। আমরা জানি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও প্রো-ভিসি, রাষ্ট্রদূত, নির্বাচন কমিশনার, তথ্য কমিশনার, সচিব-যুগ্মসচিব, সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল, ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে, বৃহৎ রাজনৈতিক দলের প্রধানসহ বিভিন্ন স্তরে নারী দক্ষতার সঙ্গে তার অবস্থান তুলে ধরছে। কিন্তু দেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক যেখানে নারী, সেখানে কিছুসংখ্যক নারীর উজ্জ্বল অবস্থান গোটা নারীসমাজের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না।

একটা কঠিন সত্য হচ্ছে, আমাদের দেশে নারী এখনও দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবেই পরিগণিত, ক্ষেত্রবিশেষ তৃতীয় শ্রেণি। ৫২ বছরে কৃষিতে নারীর সংখ্যা কোটি ছাড়িয়েছে। তবে নারীর সংখ্যা বাড়লেও এখনও ভূমির মালিকানা নেই নারীর। নিজের জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা নারীদের এখনও খুব একটা অর্জিত হয়নি। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ঘর থেকে বাইরে বের হওয়ার ক্ষেত্রে আজও নারী পরিবার, সমাজ থেকে তীব্র বাধার সম্মুখীন হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোমানা মঞ্জুর তারই এক জলজ্যান্ত উদাহরণ। সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নারী হওয়ার কারনে ফুলবাড়িয়া পৌর এলাকার আয়েশা সিদ্দিকার ‘কাজি’ হওয়ায় বাধা দেওয়ার চেষ্টা কিংবা নারী ম্যাজিস্ট্রেট ফারজানা আলমের উপস্থিতিতে প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধাকে গার্ড অব অনার দিতে বাধা দেওয়া, অন্যদিকে বগুড়ার গাবতলী উপজেলায় সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় দিনমজুরের স্ত্রী রিমা বেগমকে বাঁশের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন, নারীর প্রতি সমাজের কোন কোন পর্যায়ে জিইয়ে থাকা নেতিবাচক মনোভাব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। শিক্ষা, গবেষণা, কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণ থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা আমাদের সমাজে তীব্রভাবেই বিদ্যমান। ফলে একটা বিষয়  পরিস্কার, নারীর শক্ত অবস্থানের জন্য যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন; যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় দৃশ্যমান নয়। নারী এ সমাজে এখনও যেন বা অবরোধবাসিনী! যদিও স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান নারীকে সব ক্ষেত্রে সমান অধিকার দিয়েছে। নারী-পুরুষ সমতার পক্ষে কথা বলে এমন অনেক আন্তর্জাতিক দলিলেও বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু সমতা এ দেশে এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। লৈঙ্গিক সমতা বলতে আমরা বুঝি সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারী এখনো  পিছিয়ে।

বাংলাদেশে নারীর অবস্থান প্রসঙ্গে একটা কথা খুব প্রচলিত। তা হচ্ছে, যে দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার নারী; সে দেশে নারীর ক্ষমতায়ন আটকায় কে! কিন্তু অপ্রিয় সত্য কথা হলো, নারীর ক্ষমতায়ন শুধু কয়েকজনের শীর্ষপদে আসীন থাকাকে বোঝায় না। ক্ষমতায়ন আসলে একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া। যে প্রক্রিয়ায় নারী তার জীবনের সব ক্ষেত্রে পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ পাবে। সামগ্রিক পরিস্থিতি যা দেখছি তাতে মনে হচ্ছে, নারী এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বৈষম্যওতবে আশার বিষয় হাজারো নিষেধের দেয়াল ভেঙে, অপমান ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, নিপীড়ন-নির্যাতন তুচ্ছ করে নারী অদম্য শক্তিতে বেরিয়ে আসছে। ৫২ বছর আগের সেই অক্ষম-অশিক্ষিত-পরনির্ভরশীল-লাজুকলতার তকমা ছুড়ে ফেলে নারী নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে মূলধারায়। সেসব তেজোদীপ্ত নারীর মুখ যেন বলছে, আমি একাই একশ। আগামীতে নিজ ঘরের চৌহদ্দি পেরিয়ে, ঝড়ঝঞ্ঝা পাড়ি দিয়ে আমাদের নারীরা এগিয়ে যাবে বহুদূর, নারীর সেই সামগ্রিক অগ্রযাত্রার সারথি হতে আমরা কি প্রস্তুত?


  • লেখক ও সাংবাদিক

 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা