স্মরণ
ছবি : সংগৃহীত
যশোরের প্রথিতযশা সাংবাদিক শামছুর রহমান তার অফিসে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন ২০০০ সালের এই দিনে। আজ তার ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। বিচারহীনতার যে অপসংস্কৃতি সমাজে বিরাজমান, সাংবাদিক শামছুর রহমানের হত্যাকাণ্ড এবং ২৩ বছর ধরে ঝুলে থাকা বিচার তারই এক জলজ্যান্ত উদাহরণ। অন্যায়, দুর্নীতি, অনাচার, সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে তার লেখনী ছিল সর্বদা সোচ্চার। চোরাচালান হুন্ডি ব্যবসা এসব প্রতিবেদনের কারণে নানা সময়ে দুর্বৃত্তরা তাকে বারবার জীবননাশের হুমকিও দিয়েছে, কিন্তু তার কলম থেমে থাকেনি। সমাজের ক্লেদ ধুয়েমুছে একটি সুন্দর সমাজ গঠনের ইচ্ছায় তার কলম ছিল বদ্ধপরিকর। কিন্তু তাকে থামিয়ে দেওয়া হয় চিরতরে। শামছুর রহমান হত্যা মামলাটির কার্যক্রম দীর্ঘসময় ধরে স্থবির। ফলে হত্যাকাণ্ডের ২৩ বছরেও ঘাতকদের দণ্ড নিশ্চিত হয়নি।
২০০০ সালের ১৬ জুলাই রাতে সাংবাদিক শামছুর রহমান খুন হওয়ার পর ২০০১ সালে সিআইডি পুলিশ এ মামলায় ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। সেই সময় চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আসামিদের প্রভাবে মামলার বর্ধিত তদন্ত করে শামছুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাংবাদিক নেতা ফারাজী আজমল হোসেনকে নতুন করে আসামি করা হয়। সেই সঙ্গে মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী বাদ দিয়ে সাক্ষী করা হয় আসামিদের ঘনিষ্ঠজনদের। এতে একদিকে মামলার বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়, অন্যদিকে দুর্বল হয়ে যায় চার্জশিট। বিতর্কিত ওই বর্ধিত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর ২০০৫ সালের জুন মাসে যশোরের স্পেশাল জজ আদালতে এ মামলার চার্জ গঠন হয়। ওই বছরের জুলাই বাদীর মতামত ছাড়াই মামলাটি খুলনার দ্রুত বিচার আদালতে স্থানান্তর করা হয়। এ অবস্থায় মামলার বাদী শহীদ শামছুর রহমানের সহধর্মিণী সেলিনা আক্তার লাকি বিচারিক আদালত পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে হাইকোর্টে আপিল করেন। বাদীর এ আপিল আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট মামলাটি কেন যশোরে ফিরিয়ে দেওয়া হবে না তার জন্য সরকারের ওপর রুলনিশি জারি করেন। এরপর মামলায় বর্ধিত তদন্তে সংযুক্ত আসামি ফারাজী আজমল হোসেন উচ্চ আদালতে একটি রিট করেন। সেই রিটের নিষ্পত্তি না হওয়ায় মামলার সমস্ত কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। চাঞ্চল্যকর এ মামলাটির বিচার না হওয়ায় নিহতের পরিবার ও সমাজের বিভিন্ন স্তরে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর নিহতের পরিবার ও সাংবাদিক সংগঠনগুলোর তরফে দাবি তোলা হয় পুরোনো বিতর্কিত তদন্ত বাতিলপূর্বক মামলাটি পুনঃতদন্তের। দীর্ঘদিনেও স্বামী হত্যার বিচার না পেয়ে স্কুলশিক্ষিকা সেলিনা আক্তার লাকিও হতাশ এবং ক্লান্ত। তিনি বলেছেন, এখন আর বিচারের আশা দেখছি না।
আমরা একটা কথা বরাবরই শুনে আসছি, বিলম্বিত বিচার ন্যায় বিচারকে পরাহত করে। বিচার প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়য় হলো। সুষ্ঠু তদন্ত কার্যক্রম, স্বচ্ছ অভিযোগত্র গঠন, নিরপেক্ষ সাক্ষ্য প্রদান ইত্যাদি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আমরা এসবের ঘাটতি দেখতে পাচ্ছি। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমার তারিখ এ পর্যন্ত ৯৮ বার অতিক্রান্ত হলো। বারবার বিচারপ্রক্রিয়া বিলম্বিত করা এবং বিচার না হওয়ার বিষয়গুলো অনেক প্রশ্ন দাঁড় করায়। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যুগে কোনো ঘটনাই আড়াল করে রাখা যায় না। প্রয়োজন সদিচ্ছা। ক্ষমতাবান খুনিদের দীর্ঘ অদৃশ্য হাত উন্মোচনের মাধ্যমে আইনের শাসন কায়েমের নজির পুষ্ট হোক। তা না হলে এই ব্যার্থতার গল্প আগামী প্রজন্মের মুখে মুখে উচ্চারিত হবে দীর্ঘশ্বাসে।
এ কথাটাও আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত, বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে। প্রশ্ন হচ্ছে- এই ক্রন্দন থামানোর দায় রাষ্ট্র শক্তি কী এড়াতে পারে? এমন একটি বেদনাজাগানিয়া প্রশ্ন রেখেই সাংবাদিক শামছুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিচারে কালক্ষেপণ না করে ন্যায়বিচারের পথ সুগম করার দাবির পাশাপাশি এই কলমযোদ্ধাকে বিনম্র শ্রদ্ধা।