স্মরণ
অলঙ্করন: সংগৃহীত
বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির
মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় যাঁরা অবদান রেখেছেন,
তাঁদের
মধ্যে ড.
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অন্যতম। তিনি একাধারে ভাষাবিজ্ঞানী, গবেষক, অনুবাদক, চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ হিসেবে সর্বস্তরে পরিচিত। তবে এতসব ছাপিয়ে তাঁর বড় পরিচয়
তিনি একজন খাঁটি উদার এবং অসাম্প্রদায়িক বাঙালি। জাতিসত্তা সম্পর্কে মুহম্মদ
শহীদুল্লাহর স্মরণীয় উক্তি ছিল, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার
চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি’। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই দেশের রাষ্ট্রভাষা
নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে যে কজন জোরালো বক্তব্য
উপস্থাপন করেছেন তাঁদের মধ্যে তিনি অন্যতম। প্রতিটি
ভাষার প্রতিই তাঁর ছিল অগাধ শ্রদ্ধা। এজন্যই তিনি বলেছিলেন, ‘ যে জাতি তার ভাষাকে শ্রদ্ধা করে না,
সে
জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়।’
তিনি ১০ জুলাই, ১৮৮৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের পরগনা জেলার পেয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ
করেন। বাবা মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন মধ্যযুগীয় পীর গোরাচাঁদের দরবার শরিফের খাদেম।
গৃহিণী মা হুরুন্নেসা। তার বাবা সন্তানের নাম প্রথমে
মোহাম্মদ ইব্রাহিম রেখেছিলেন। পরে বদলে রাখেন শহীদুল্লাহ। কারণ
তাঁর ধারণা, শহীদে কারবালার চাঁদে তাঁর ছেলে গর্ভে এসেছে, এজন্য
নাম শহীদুল্লাহ রাখলেই ভালো হবে।
ড. মুহম্মদ
শহীদুল্লাহ তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু করেন গ্রামের এক মক্তবে। মক্তবের পড়া শেষ করে হাওড়া জিলা স্কুলে ভর্তি হন। তখন
থেকেই তাঁর ভাষা শেখার আকাঙ্ক্ষা জন্মে। জীবদ্দশায় বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
রেখেছিলেন তিনি। তাঁকে বলা হতো ‘চলন্ত এনসাইক্লোপেডিয়া’। বিভিন্ন ভাষার প্রতি ছোটবেলা থেকেই ছিল তাঁর অদম্য আগ্রহ।তিনি প্রায় ২৪টি ভাষা
আয়ত্ত করেছিলেন। এর মধ্যে
১৮টি
ভাষার ওপর তাঁর ছিল উল্লেখযোগ্য পাণ্ডিত্য। বাংলাদেশের
আঞ্চলিক ভাষার অভিধান তৈরি করে অসামান্য অবদান রাখেন তিনি। এ ছাড়া
বাংলা একাডেমির পঞ্জিকার তারিখবিন্যাস কমিটির সভাপতি হিসেবে তাঁর নেতৃত্বে বাংলা
পঞ্জিকা একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত রূপ পায়।
তাঁর চতুর্থ ছেলে মুহম্মদ
তকিউল্লাহ বাবা সম্পর্কে বলেছিলেন, তৎকালীন
পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল ড. মুহম্মদ
শহীদুল্লাহর একটি লেখার মধ্য দিয়ে,
‘কমরেড’
পত্রিকায় একটি লেখা তিনি লেখেন, ‘দ্য ল্যাঙ্গোয়েজ প্রবলেম অব
পাকিস্তান’। এ নিবন্ধে যে
কথাগুলো
তিনি বলেন, সেগুলো হচ্ছে এই যে,
পাকিস্তান রাষ্ট্রের বাংলাভাষী অংশে যদি বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা রাষ্ট্রভাষা
হয়, তাহলে সেই স্বাধীনতা হবে পরাধীনতারই নামান্তর। এ কথা তিনি বলেন ১৯৪৭ সালের ৩ আগস্ট
অর্থাৎ ১৪ আগস্টের ১১ দিন আগে। এ কথাটাই দেশে তখনকার বাঙালি সুধীসমাজ লুফে
নেয় এবং এ কথাটার ওপরই শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। ড. মুহম্মদ
শহীদুল্লাহই ছিলেন ভাষা আন্দোলনের প্রধান উদ্যোক্তা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিষ্ঠার শুরুতেই তিনি এখানে সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের প্রভাষক পদে কাজ করেন। পাশাপাশি দুই বছর আইন বিভাগে খণ্ডকালীন
শিক্ষকতার দায়িত্বও পালন করেন। এখানে শিক্ষাদানকালে তিনি বাংলা ভাষার উৎপত্তি
নিয়ে মৌলিক গবেষণা করেন এবং ১৯২৫ সালেই সর্বালোচিত গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেন;
যেখানে আমরা দেখতে পাই বাংলা ভাষার উৎপত্তির ইতিহাস।
তিনি লিখেছেন অসংখ্য বই। গবেষণামূলক
গ্রন্থ, প্রবন্ধ গ্রন্থ, এ ছাড়া
তিনি পাঠ্যবইও
লিখেছেন। ভাষাতত্ত্বের ওপর তাঁর রয়েছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ রচনা। তা ছাড়া তিনি
ছোটগল্প এবং কবিতাও লিখেছেন। তাঁর আরও একটি বড় কাজ হচ্ছে প্রাচীন বাংলার যে প্রথম
নিদর্শন চর্যাপদ, সেই চর্যাপদ তিনি সম্পাদনা করেছিলেন।
১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পাশে সমাহিত করা হয়। ভাষাক্ষেত্রে তাঁর অবদানকে সম্মান জানাতে ওই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ঢাকা হলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘শহীদুল্লাহ হল’। ভাষার জন্য তাঁর যে মমতা, সাধনা তাতে সহজেই বলা যেতে পারে, বাংলা ভাষা যতদিন থাকবে, ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নাম ততদিন থাকবে। তাঁকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।