× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

মৎস্যসম্পদ

নদনদী ও জলাশয় সংরক্ষণ করতে হবে

ড. মনিরুল ইসলাম

প্রকাশ : ১২ জুলাই ২০২৩ ০৬:২৪ এএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

ইলিশের স্বাদ নিয়ে এই অঞ্চলে রয়েছে অসংখ্য কিংবদন্তি। অনেকটা রাজকীয় খাবার হিসেবেই একে গণ্য করা হয়। সেই ইলিশেরই স্বাদ-ঘ্রাণ বদলে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগটি অমূলক নয়। স্বাদ-ঘ্রাণ শুধু ইলিশেরই বদলে যাচ্ছে তা নয়। অন্যান্য মাছেরও স্বাদ কমছে। মৎস্যসম্পদের যে প্রাচুর্য এক সময় আমাদের আশা জাগিয়েছিল, তার অধিকাংশই আজ বিলুপ্তির পথে। পশ্চিমা বিশ্বে আমিষের চাহিদা পূরণের জন্য মূলত মাংস খাওয়া হয়। অন্যদিকে এশিয়ার অধিকাংশ অঞ্চলে আমিষের চাহিদা অধিকাংশে পূরণ হয় মাছের মাধ্যমে। দ্বীপাঞ্চলে সামুদ্রিক মাছ বা অন্যান্য প্রাণীর মাধ্যমে আমিষের চাহিদা পূরণ হয়। এক্ষেত্রে জাপান ও শ্রীলঙ্কার উল্লেখ করা যায়। বাংলাদেশের মতো বদ্বীপ অঞ্চলের মিঠা পানি বিপুল মাছের আধার হিসেবে গণ্য হয়। কিন্তু দখল-দূষণ এবং নদীরক্ষায় গাফিলতিতে আমাদের মৎস্যসম্পদ আজ হুমকির মুখে। গত ২০ মে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত ধারাবাহিক প্রতিবেদনে ইলিশের স্বাদ-ঘ্রাণ পাল্টে যাওয়ার খবরটি আবার সামনে এসেছে। ধারাবাহিক ওই প্রতিবেদনে এমন কিছু বিষয় উঠে এসেছে, যা নিয়ে মৎস্য বিশেষজ্ঞরা অনেকদিন ধরেই কথা বলছেন। কিন্তু বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে সতর্কীকরণের দায়িত্ব নেওয়া হয়েছে কম। তবে ইলিশ মাছের স্বাদ-ঘ্রাণ পাল্টে যাওয়ার প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে আছে আমাদের জলাশয়ের অবস্থা এবং মাছের বিচরণক্ষেত্র।

ইলিশের সঙ্গে ভোজনরসিক বাঙালির রয়েছে গভীর সম্পর্ক। বাঙালি সংস্কৃতির উৎসব-পার্বণের একটি বড় অংশের সঙ্গে জুড়ে আছে ইলিশ। পুষ্টিবিদরা ইলিশ মাছের চর্বিকে ভালো চর্বি হিসেবেই বিবেচনা করেন। ১০০ গ্রামের ইলিশ মাছে প্রায় ২১.৮ গ্রাম প্রোটিনের পাশাপাশি রয়েছে উচ্চ পরিমাণ ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, নায়সিন, ট্রিপ্টোফ্যান, ভিটামিন, বি ১২, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়ামসহ অন্যান্য ভিটামিন ও মিনারেলস। ইলিশের ডিমে থাকা ফ্যাটি অ্যাসিড হার্টের রোগপ্রতিরোধ করে। রক্ত জমাট বাঁধতে দেয় না, উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। পুষ্টিগুণের কারণেই নয় শুধু, ঐতিহ্যের অংশ হিসেবেও তাই ইলিশ আমাদের পছন্দের মাছ। সঙ্গত কারণেই ইলিশের বিষয়টি নিয়ে তাই আমরা আলোচনা করছি বেশি। ইলিশ মাছের স্বাদ পরিবর্তনের বিষয়টি সম্পূর্ণ মৎস্যসম্পদের নেতিবাচক পরিস্থিতির সম্পর্কেও ইঙ্গিত করে। প্রথমত, নদীতে এখন ইলিশ মাছ পাওয়া যায় কম। প্রজনন মৌসুমে নানাভাবে ডিমওয়ালা মাছ ধরা হয়। বাজারে অনেকেই ডিমওয়ালা মাছের সন্ধান করেন। এর চাহিদা থাকায় জেলেরাও নানাভাবে ডিমওয়ালা মাছ ধরেন। প্রজনন মৌসুমে অবাধে মাছ ধরায় নদীতে ইলিশ কম পাওয়া যায়। যদিও সরকার ইলিশের প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তবে শুধু অবাধে মাছ ধরাকেই ইলিশের প্রাপ্তি কম হওয়ার পেছনে দায়ী করা যায় না। নদীতে ইলিশের আকালের কথা বলা হয়। তার পেছনে আরও যেসব কারণ রয়েছে, তার মধ্যে নদী থেকে অবৈধ বালি উত্তোলন, লাগামছাড়া দূষণ অন্যতম। জেলেরা মেঘনা নদীতে দিনের পর দিন জাল ফেলে বসে থাকলেও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত রুপালি শস্য। নদীর ওপর দিয়ে প্রতিনিয়ত যাতায়াত করছে লঞ্চ, জাহাজ। ড্রেজিং, দূষণেও বিপদে মেঘনার ইলিশ। ফলে বাংলাদেশের জাতীয় মাছ আজ সংকটে। সমুদ্র থেকে ডিম পাড়ার জন্য ইলিশ আসে নদীতে। কিন্তু নদীতে তাদের বিচরণের উপযুক্ত ক্ষেত্র নেই। জেলেদের আক্ষেপ, ইলিশের ‘অভয়ারণ্য’খ্যাত মেঘনাতে ইলিশ আসার সংখ্যা খুবই কম। কারণ মেঘনায়ও বেড়েছে দূষণ। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবও ইতোমধ্যে দৃশ্যমান। তীব্র দাবদাহ, মধ্যমেয়াদি বন্যা আমাদের নানাভাবে ক্ষয়ক্ষতি বাড়াচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের মূল সমস্যা তাপমাত্রা বৃদ্ধি। তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সুপেয় পানির সংকট এবং খাদ্যশস্য উৎপাদনের উপযুক্ত পরিবেশ না থাকার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে আমরা নদীনির্ভর। তারপরও আমাদের সুপেয় পানির সংকটের পেছনে দায়ী মানবসৃষ্ট কারণগুলো। নগরে জলাশয় বিলুপ্ত হচ্ছে- এ কথা পরিকল্পনাবিদরা প্রায়ই বলেন। নদী, খাল-বিল দখল- দূষণের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে স্বাদু পানির মাছের ওপর। ২০১৯ সালে প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন বলেছিল, 'প্রায় বিলুপ্ত' হওয়ার পথে বাগাড়, পিপলা শোল বা বাক্কা মাছ, মহাশোল, নান্দিলা মাছ, চান্দা, ভাঙ্গান বাটা, খরকি মাছ, কালো পাবদা, চেনুয়া মাছসহ বেশকিছু মাছ রয়েছে। তা ছাড়া ওই বছর ১১৮ প্রজাতির দেশি মাছ বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে বলেও গবেষণার প্রতিবেদনে উঠে আসে। ২০০০ সালের পর থেকে শুরু হয় প্রথম দেশি প্রজাতির বিপন্ন মাছ চিহ্নিত করার জন্য জরিপ। এই দীর্ঘসময়ে যত জরিপ হয়েছে সবখানেই দেখা গেছে স্বাদু পানির মাছ বিপন্ন হচ্ছে বেশি। এখন পর্যন্ত আমরা মৎস্যসম্পদের আর্কাইভ করতে পারিনি। দেখা গেছে, স্বাদু পানির ৩০০ প্রজাতির মাছের মধ্যে অন্তত ৪০ প্রজাতির মাছের ব্যাপারে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থার কাছে হালনাগাদ তথ্য নেই। ফলে দেশীয় মাছ সংরক্ষণের জন্য সঠিক পরিকল্পনাও আমরা গড়তে পারি না। একটি মাছের বিচরণক্ষেত্রের অবস্থান ব্যাখ্যা করা গেলেই শুধু ওই প্রজাতি সংরক্ষণের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। আমরা সেটা করতে পারিনি। ইলিশ যেহেতু জনপ্রিয়, তাই এ মাছের বিষয়ে স্বভাবতই আমাদের মনোযোগ বেশি। কিন্তু এখানে একটি বিষয় আমাদের মনে রাখা জরুরি, ইলিশ মাছ যে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে- দেশি অন্যান্য প্রজাতির মাছের প্রতিবন্ধকতা কিন্তু তেমন নয়।

আমাদের সমস্যা কোনো প্রজাতি বিপন্ন হওয়ার কারণ চিহ্নিত না করে একটি সাধারণ প্রক্রিয়ায় এটিকে বিচার করি। স্বাদু পানির অনেক মাছ হারিয়ে যাচ্ছে জলাশয় বিলুপ্ত হওয়ায়। সব মাছ নদীতে বিচরণ করবে এমন নয়। আবার সব নদী সব ধরনের মাছের বিচরণের জন্য উপযুক্ত, তাও নয়। কিছু মাছ বিলে বিচরণ করে এবং কিছু মাছ পুকুরে থাকতে পারে। প্রকৃতপক্ষে মাছের বাস্তুসংস্থান নষ্ট হচ্ছে। আর এটিও একটি সমস্যা। কারণ যখন দেশি মাছের সংখ্যা কমবে, তখন চাহিদার ভিত্তিতে কিছু জনপ্রিয় মাছের ওপর চাপ পড়বে। ইলিশ, বোয়াল, কাতলা ইত্যাদি মাছের ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য। মাছের মাধ্যমে আমিষের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে আমাদের হাতে এখন সংখ্যা কম। জনসংখ্যাবহুল একটি দেশে আমিষের চাহিদা পূরণের প্রধান মাধ্যম সংরক্ষণের বিষয়ে মনোযোগী হতে হয় বেশি। ছোট আকৃতির অনেক মাছ নিম্নবিত্তের আমিষের চাহিদা পূরণ করতে পারত। অর্থাৎ এ দেশের মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণ করার ক্ষেত্রে ছোট-বড় মাছ নানাভাবে অবদান রেখেছিল বলেই আমরা বলতাম 'মাছে-ভাতে বাঙালি'। অথচ মানুষের সামনে এখন মাছের সংখ্যাই কম। এক্ষেত্রে মনুষ্যসৃষ্ট কারণ অনেকাংশেই দায়ী। অনেক জায়গায় বিলে বাঁধ তৈরি করে কেউ কেউ মাছ চাষ করেন। ফলে মাছের প্রাকৃতিক বিচরণক্ষেত্র নষ্ট হয়। শহর ও গ্রাম দুইখানেই নদী-খালসহ সব ধরনের জলাশয়ের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ কমার সঙ্গে দিন দিন কমছে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মাছের পরিমাণও। জলাশয় কমে যাওয়া মাছ বিপন্ন হওয়ার প্রথম কারণ। কিন্তু মাছ বিপন্ন হওয়ার পাশাপাশি আরেকটি সমস্যা আমাদের ভেবে দেখা জরুরি, প্রতিবছর খাদ্যশস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে পরিবেশগত নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মৎস্যসম্পদের ক্ষেত্রেও এমন নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায়। মাছের স্বাদ ও ঘ্রাণ বদলে যাচ্ছে। জমিতে সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি, যা বৃষ্টিতে ধুয়ে খাল-বিলসহ জলাশয়গুলোতে পড়ে। এর ফলে মাছের মৃত্যু ও প্রজনন হার মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। কলকারখানার বর্জ্য নিকটস্থ জলাশয়ে ফেলা হয়, তার ফলেও মাছ মরে যায়।

নদীভাঙন ও বন্যার কারণে প্রতিবছর পদ্মা ও মেঘনায় অসংখ্য চর সৃষ্টি হয়ে নদী ভরাট হচ্ছে। এতে পদ্মা মেঘনায় ইলিশের বিচরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এখন নদী আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি দূষণ হচ্ছে। তা ছাড়া জলাবদ্ধতা এবং মধ্যমেয়াদি বন্যার ফলে নানা ধরনের বর্জ্য, কৃষিজমির কীটনাশক নদীতে পতিত হচ্ছে। এসব কারণে নদীতে ইলিশ থাকার বা বিচরণের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। ইলিশ যেমন নদীতে বিচরণ করে, তেমনি তাকে ওই বিচরণক্ষেত্র থেকে খাবার সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু নদী ও জলাশয়ে যে হারে রাসায়নিক উপাদান মিশে যাচ্ছে, তা ইলিশের শরীরেও প্রবেশ করছে। শুধু ইলিশ নয়, নদীর অন্য প্রজাতির মাছের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। এক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ইলিশের পেটে ৩৬ শতাংশ কাদা-বালি পাওয়া যাচ্ছে। কারণ নদীতে বালি এবং কাদার পরিমাণ বেশি। এই মাত্রাতিরিক্ত দূষণে ইলিশের গঠন, স্বাদের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। অপরিকল্পিতভাবে বালি উত্তোলন, নদনদী দূষণ, মাছের বিচরণক্ষেত্র নষ্ট, নদী সংরক্ষণে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অবলম্বন না করায় আমাদের মৎস্যসম্পদ হুমকির পথে। এর সমাধান একটিই, তা হলো- নদনদী ও জলাশয় সংরক্ষণ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণে নদনদীর হুমকিগুলো তো অচিহ্নিত নয়। নদীরক্ষায় প্রতিদিনের বাংলাদেশ সব সময়ই সোচ্চার। এ বিষয়ে তাদের আন্তরিকতা এবং সোচ্চার বক্তব্য যদি কর্তৃপক্ষ এবং মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারে, তবে আমরা একটি ইতিবাচক ফল পাব।


  • অধ্যাপক, মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা