× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

নারী ও শিশু নির্যাতন

নারীর ক্ষমতায়নে অর্থনৈতিক মুক্তি জরুরি

এলিনা খান

প্রকাশ : ১১ জুলাই ২০২৩ ১৪:২১ পিএম

অলঙ্করন: জয়ন্ত জন

অলঙ্করন: জয়ন্ত জন

সম্প্রতি নারী ও শিশু নির্যাতনের খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশের পর নানা শঙ্কা দেখা দিয়েছে। নানা মহলে একই প্রশ্ন, ঈদের ছুটির সময়ে নারী ও শিশু নির্যাতন বাড়ার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে। নির্যাতন বেড়েছে বলে যে সংবাদ প্রকাশ পাচ্ছে, তার সঙ্গে আমি দ্বিমত পোষণ করি। কারণ আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে, ছুটির সময়গুলোতে নারী ও শিশু নির্যাতনের বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে তুলনামূলক বেশি নজর আকৃষ্ট করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন নতুন ঘটনা নয়। দেশে এটি একটি বড় সামাজিক সমস্যা এবং অপরাধে পরিণত হয়েছে। অতীতেও নারী ও শিশু নির্যাতনের খবর সংবাদমাধ্যমে পাওয়া গেছে। প্রতিবছর বিভিন্ন সমীক্ষায় নানা আঙ্গিকে এই নির্যাতনের দৃশ্যচিত্রও তুলে ধরা হচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই নির্যাতনের প্রতিকার, প্রতিরোধ বা আইনগত ব্যবস্থা কিন্তু এতদিনেও নিশ্চিত করা যায়নি। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতির প্রতিফলন নারী ও শিশু নির্যাতন বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। যখন কোনো অপরাধের দৃষ্টান্তযোগ্য শাস্তি নিশ্চিত করা হয় তখন মানুষ সতর্ক হয়ে ওঠে। কোনো অপরাধ বা কাউকে নির্যাতন করার মতো অপরাধের সঙ্গে মানুষ তখন যুক্ত হয় না, বরং ভয় পায়। অর্থাৎ আইনের যথাযথ প্রয়োগের ফলে মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা কমে আসে। নারী ও শিশু নির্যাতন, সামাজিক সমস্যাÑএ সমস্যার সমাধানে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি অনুষঙ্গ আইনের যথাযথ প্রয়োগ। আর সেটি না হলে মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ে। সহজে ছাড় পেয়ে যাওয়ার উদাহরণ থাকলে মানুষ আরও অপরাধ করায় উৎসাহী হয়ে ওঠে। আর সামাজিক পর্যায়ে নারী ও শিশুর অবস্থান এমন একটি পর্যায়ে যেখানে অধিকাংশ নির্যাতনের শিকার তাদেরই হতে হয়। সামাজিক এই সমস্যাটি আজ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেও পরিণত হয়েছে।

নারী ও শিশু নির্যাতন বাড়ার পেছনে মূল্যবোধের অবক্ষয়ও একটি বড় কারণ। সামাজিক পর্যায়ে বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ কমে গেছে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যোগাযোগের অভাব রয়েছে। কথাবার্তার ক্ষেত্রে অনেকেই এখন অসংযত এবং খুব সহজেই উত্তেজিত হয়ে পড়ি। পরমতসহিষ্ণুতা ও নৈতিক মূল্যবোধের অভাব সামাজিক পর্যায়ে সংঘাত সৃষ্টি করে। এই সংঘাতকে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে বিচার করতে হবে। আমরা মূলত পারিবারিক ও গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের সংঘাতের দিকে নজর ফেরাতে চাই। একটি পরিবারের ভেতর সম্পর্কের ঘাটতি, পারস্পরিক সহমর্মিতার অভাব, পরমতসহিষ্ণুতা না থাকায় পরিবারের সদস্যদের প্রতি ক্ষোভ জমা অস্বাভাবিক নয়। এই ক্ষোভ থেকেই পারিবারিক পর্যায়ে সহিংসতা, নারী ও শিশু নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটে। এই সমস্যা এবং ক্রমেই অপরাধপ্রবণতা দূর করতে প্রথমেই সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। স্কুল-কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও আমরা দেখছি মূল্যবোধের চর্চা কমে যাচ্ছে। তবে সম্প্রতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম শুরু হচ্ছে, এটি আশার কথা। কিন্তু শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মূল্যবোধের চর্চা করলেই আমরা কোনো সমাধানে পৌঁছুতে পারব না। আমাদের সামাজিক পর্যায়ে মূল্যবোধ সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করে তুলতে হবে। এটি অত্যন্ত জরুরি। সুন্দর জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই মূল্যবোধের চর্চা জরুরি। এর প্রধান কারণ সম্পর্কোন্নয়নের পথ সুগম হবে যখন মূল্যবোধের চর্চা হবে। সবকিছুকে কাঠামোবদ্ধ কিংবা আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার করতে গেলে হবে না। এর বাইরে এসে আমাদের বিচার করতে হবে।

আমাদের দেশে অনেক সময় ধর্মীয় অনুশাসনের অপব্যাখ্যা করে নারী ও শিশু নির্যাতন করা হয়। মনে রাখতে হবে, ধর্ম কখনও গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় দেয় না। বরং মানুষ ধর্মকে ব্যবহার করে সমাজে কিছু গোঁড়ামি গড়ে তোলে। বিষয়টি বিভিন্ন দেশের ধর্মীয় সংস্কৃতির দিকে তাকালেও স্পষ্ট হবে। একই ধর্ম বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সংস্কৃতির জন্ম দেয়। ধর্ম মূলত জীবনযাপনের সঠিক পদ্ধতির দিকনির্দেশনা দেয়। সমাজে মানুষ অনেক সময় ধর্মকে ব্যবহার করে ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে কিছু অনুশাসন গড়ে তোলে। এটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। তাই ধর্ম যে অনুশাসন দিয়েছে তা যথাযথভাবে অনুসরণ করা উচিত। ধর্ম স্পষ্ট ও সহজভাবেই জীবনযাপনের দিকনির্দেশনা দিয়ে রেখেছে। কিন্তু নানামুখী গোঁড়ামি আমাদের মাঝে বিভেদের রেখাই বাড়িয়ে তুলছে। বিশ্বায়নের যুগে আমাদের জীবন মাল্টিকালচারের দিকে এগিয়ে চলেছে। একাধিক সংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বেড়েছে। কিন্তু প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্য কোনো অংশের সঙ্গেই আমরা মানিয়ে নিতে পারিনি। এবার আসা যাক শিক্ষার কথায়। মূল্যবোধের গঠনে শিক্ষার যে মাণদণ্ড থাকা উচিত তা আমাদের প্রায় নেই-ই। বিশ্বের অন্যান্য দেশে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য যে পদক্ষেপ নেওয়া হয় আমাদের এখনও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে তা করা সম্ভব হয়নি। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে এ বিষয়ে নানাভাবে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করতে হবে। মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়ার কাজটি কঠিন হওয়ার কথা নয়।

নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে দেশে কঠোর আইন হয়েছে। আইন কঠোর হওয়ার পরও নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হচ্ছে না। অতীতে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ আমার লেখায় আমি বলেছি, নারী ও শিশুর অধিকার সংরক্ষণে আমাদের এমন অনেক আইন রয়েছে, যা বিশ্বের আর কোথাও নেই। বলা যায়, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমাদের নীতিনির্ধারকরা যথেষ্ট আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন। অন্যান্য দেশে এসব বিষয়ে আইন অনেক কম। কিন্তু তাদের সঙ্গে আমাদের বড় পার্থক্য, তারা আইনের প্রতিপালনে যথেষ্ট আন্তরিক। শুধু তা-ই নয়, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারী নির্যাতনের বিচার নিশ্চিত হয়। অন্যদিকে আমাদের দেশে কঠোর ও যুগোপযোগী আইন থাকার পরও তা প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে গাফিলতি রয়েছে। আইনের প্রতি সামাজিক পর্যায়ে শ্রদ্ধাশীল না থাকাও একটি বড় সমস্যা। তা ছাড়া সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের গাফিলতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব থাকায় অধিকাংশ সময় অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যান। তাই আইন করলেই বিদ্যমান সংকট মোকাবিলা করা যাবে না। আইনের প্রয়োগ করতে হবে এবং তা করার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলদের আন্তরিক হতে হবে। আইন রয়েছে এ কথা সত্য। কিন্তু অনেক সময় এই আইনের অপপ্রয়োগও ঘটে। অনেক সময় দায়িত্বশীল অসাধুদের অপতৎপরতায় ভুক্তভোগীদেরই জিম্মি হতে হয়। স্বচ্ছতা-জবাবদিহি-দায়বদ্ধতা নিশ্চিত না করায় আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে অনেক অপরাধী পার পেয়ে যান। এমনটি মোটেও কাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি হতে পারে না।

শহরাঞ্চলে নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠছেন। বেশ কয়েকটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে নারীরা ৯৯৯-এ যোগাযোগ করে অভিযোগ করছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ক্ষেত্রে আস্থা অর্জন করতে পেরেছে বলেই নারীরা অভিযোগ জানাতে এগিয়ে আসতে পারছেন। কিন্তু গ্রামীণ অঞ্চলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীরা নিজেদের আইনি অধিকার সম্পর্কে সচেতন নন। পারিবারিক বন্ধনের আবেগগত জায়গা থেকেই তারা ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না। তারা একে ভবিতব্য বলে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে গ্রামীণ অঞ্চলে এই সমস্যা শুধু আবেগীয় পরিস্থিতিতে সীমাবদ্ধ নয়। দেখা যায়, অনেক সময় স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে অনেক নারী মিথ্যে অভিযোগ করেন। এর একটি নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। কারণ যারা সত্য সত্যই নির্যাতনের শিকার হন, তারা ন্যায়বিচার পান না। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা তখন বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন না। সামাজিক কাঠামোতে কিছু বিষয় সংস্কৃতিতে রূপ নেয়। সংস্কৃতির এই রূপায়ণের সঙ্গে আইনি কাঠামোর সমন্বয় করা জরুরি। কারণ দেশের গ্রামীণ বা প্রান্তিক অঞ্চলের নারীরা কতটা সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, তা আমরা এখনও পুরোপুরি জানতে পারছি না। এই সমস্যাটি নিয়ে আমাদের দ্রুত ভাবতে হবে।

প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। কিন্তু নারী ও শিশুর প্রতি এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। একসময় নারী ঘরের ভেতর কাঁথা সেলাই করতেন। এখনও তিনি তা করেন। কিন্তু আগে তিনি ঘরের প্রয়োজনে করতেন। আর আজ তিনি উদ্যোক্তা হয়ে উঠছেন। ব্যাপক পরিসরে নিজের এই দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে পারিবারিক অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছেন। কিন্তু গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তারা পিছিয়ে রয়েছেন, কারণ তাদের উৎপাদিত সামগ্রী মধ্যস্বত্বভোগীরা শহরে এনে বিক্রি করেন। অর্থাৎ নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও তার অধিকারের জায়গা সম্পর্কে তারা এখনও সচেতন নন। তাকে এখনও নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হচ্ছে। এই নির্ভরশীলতার বৃত্ত থেকে বের হতে গেলেই সামাজিক পর্যায়ের নেতিবাচক ভাবনা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে। গ্রামীণ অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি কেমন হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণের প্রাপ্ত অর্থ কিন্তু তিনি নিজে ভোগ করতে পারেন না। নারীর ক্ষমতায়নের মূল বিষয় অর্থনৈতিক মুক্তি। নারীরা যখন এই মুক্তি পাবেন তখন নারীর প্রতি সহিংসতা কমবে।


  • আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা