× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সমাজ

মূল সমস্যা যেন চাপা না পড়ে

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ : ০৮ জুলাই ২০২৩ ১৪:০০ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

বন্যার অভিশাপ মুক্তির পরিকল্পনা কার্যকর হয়নি বন্যা ফি বছর হয়, সমাধানের দাবি ওঠে, কিন্তু তারপর যে কে সেই চাপা পড়ে যায় এটাই বাস্তবতা বছরেও বড় রকমের বন্যা হয়েছে এবং মধ্য জুলাইয়ের পর আরও বড় বন্যা হতে পারে-এমনটিই বিশেষজ্ঞদের অভিমত বন্যার কথা খুব করে বলতেন মওলানা ভাসানী তিনি কৃষকদের দুর্দশা জানতেন ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে নম্বরটি ছিল, ‘খাল খনন সেচের ব্যবস্থা করিয়া দেশকে বন্যা এবং দুর্ভিক্ষের কবল হইতে রক্ষা করিবার ব্যবস্থা করা হইবে১৯৬৫ সালে ঘোষিত ন্যাপের ১৪ দফা ছিল সারা পাকিস্তানের কর্মসূচি, সেখানেও ১৩ নম্বর দফায় বলা হয়েছে, ‘পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা প্রতিরোধ করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবেবহু কষ্টে পাকিস্তানকে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বিদায় করা গেছে, কিন্তু গত অর্ধশতাব্দীর বেশি সময়েও বন্যার অভিশাপ আমাদের কাঁধ থেকে নামেনি প্রধান কারণ সমস্যাটা বিত্তবানদের স্পর্শ করে না

পাকিস্তান আমলেই এটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়া উচিত ছিল এবং গিয়েছিলও, যে বন্যা সমস্যার সমাধান মূলত নদীর সমস্যা যে জন্য ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের সময়ে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আপত্তি তোলা হয়েছিল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর সেই ফারাক্কা কার্যকর করা হয়েছে এবং বাংলাদেশের জন্য শুকনার সময়ে কম পানি এবং বর্ষায় প্লাবনের দুর্ভোগ সহ্য করতে হচ্ছে মওলানা ভাসানী সমস্যাটির গুরুত্ব কখনও ভোলেননি তাই জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এবং অসুস্থ অবস্থাতেও ফারাক্কা লংমার্চের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ইতোমধ্যে তিস্তাসহ অন্য নদী নিয়েও মস্ত মস্ত সমস্যা দেখা দিয়েছে আমরা ভুক্তভোগী কিন্তু নিয়ে আলাপ-আলোচনা ভিন্ন দৃশ্যত অগ্রগতি বলতে তেমন কিছু নেই ওদিকে বর্ষা এলেই নদীর ভাঙন শুরু হয়ে যায় শত শত মানুষ গৃহহীন হয় জমি কমে আসে আবার গ্রীষ্মের সময় অনেক এলাকায় দেখা দেয় নিদারুণ খরা খাবার পানির আকাল পড়ে উন্নতির উৎসবের নিচে হারিয়ে যায় বিপন্ন মানুষের উদ্বেগ আর্তনাদ

১৯৮৮ সালের বন্যাপরবর্তী শহর রক্ষাবাঁধ নির্মাণের ফলে বুড়িগঙ্গার শাখা নদীটিকে বিনাশ বা হত্যা করা হয়েছে গাবতলী হতে বাবুবাজারস্থ দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু পর্যন্ত বেড়িবাঁধ নির্মাণের কারণে বুড়িগঙ্গার শাখা নদীটিতেও ওই অঞ্চলের পয়ঃনিষ্কাশন, বৃষ্টির পানি নির্গতের পথ সংকুচিত হয়ে পড়েছে বাঁধ নির্মাণের পরপরই বেড়িবাঁধের উত্তর দক্ষিণের শাখা নদীর বিস্তীর্ণ জায়গায় মাটি ভরাট করে অবৈধ দখল এবং স্থাপনা নির্মাণের হিড়িক পড়ে যায় ফলে সেখানে গড়ে উঠেছে বিশাল জনবসতি, ব্যক্তিগত শিল্প-কারখানা, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং লালবাগ থানার নতুন ভবন, বিজেবির মার্কেটসহ অজস্র স্থাপনা নদী কীভাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়ে পড়ে, তার নজরকাড়া দৃষ্টান্ত বুড়িগঙ্গার শাখা নদীটি বিলীন হয়ে যাওয়া অথচ এক সময় এই নদীর বুক চিড়ে শ্যামবাজার, বাদামতলী, সদরঘাট, চকবাজার, সোয়ারীঘাট হতে পণ্যবাহী নৌকা চলাচল করত মিরপুর, গাবতলী, সাভার মানিকগঞ্জ পর্যন্ত এখন তো ডিঙ্গি নৌকা চলার পথও রুদ্ধ কেবল কয়েক গজের সরু খালটি টিকে আছে অঞ্চলসমূহের ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে নদীনির্ভর যাতায়াতের পুরো ব্যবস্থারও পরিসমাপ্তি ঘটেছে

অথচ এক সময়ে এই শাখা নদীটিকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলে অবস্থিত আড়ত, পাইকারি বাজারের পণ্য পরিবহন হতো বর্ষাকালে নদীটির প্রস্থ হয়ে যেত প্রায় দুই কিলোমিটার সাঁতার কাটা, নৌ-ভ্রমণ, নৌকাবাইচ ইত্যাদি ছিল জনজীবনের অনুষঙ্গ অথচ বেড়িবাঁধ নির্মাণের পর সবই সোনালি অতীতে পরিণত বর্তমানে শাখা নদীটি ময়লা, আবর্জনা, বৃষ্টির পানি বহনের বড় আয়তনের এক ড্রেন ভিন্ন অন্যকিছু নয় বুড়িগঙ্গা নদীর বুকে কামরাঙ্গীরচর ছিল এক বিস্ময়ের দ্বীপ, যার দক্ষিণে আদি বুড়িগঙ্গা আর উত্তরে বুড়িগঙ্গার শাখা নদী এই শাখা নদীটি বর্ষা মৌসুমে আয়তনে আদি বুড়িগঙ্গা নদীর সমান হয়ে যেত কামরাঙ্গীরচরের উত্তরের শাখা নদীটি নৌকায় পেরিয়ে পুরান ঢাকায় আসা-যাওয়ার একমাত্র ব্যবস্থা ছিল আজকে যার কোনো অস্তিত্ব নেই বেড়িবাঁধের দক্ষিণের সংকীর্ণ ছোট খালটির পর থেকে মাটি ভরাট করে শাখা নদীটি কামরাঙ্গীরচর পর্যন্ত অবিচ্ছেদ্য জনপদে পরিণত

প্রতি শীত মৌসুমে শাখা নদীটির বুকে চর জেগে উঠত পুরান ঢাকার নদীতীর হতে নৌকাযোগে বিশাল সেই চরে স্থানীয় কিশোর-যুবকরা খেলাধুলা করত কামরাঙ্গীরচরের কৃষকরা জেগে ওঠা চরে পাট-ধানসহ রবিশস্য চাষাবাদ করত বর্ষা মৌসুম না-আসা পর্যন্ত চরটি ফসল উৎপাদনে এবং খেলাধুলার মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হতো যেন এক হারানো পৃথিবীর হারানো সময়ের স্মৃতি সামরিক শাসক এরশাদের শাসনামলে নির্মিত এই বেড়িবাঁধ এবং ঢাকা শহরের অভ্যন্তরে অজস্র বুড়িগঙ্গার সংযোগ খাল ভরাট করে কালভার্টে রূপান্তরের ফলে ভারী বর্ষণে ঢাকা শহরের অনেক অঞ্চল পানিতে ডুবে যায় প্রতি বর্ষা মৌসুমে আমরা তার কুফল ভোগ করছি

জীবন কি বৃক্ষের মতো নাকি নদীর? এই প্রশ্নের মুখোমুখি হলে মাঝামাঝি পথ নেওয়াটা নিরাপদ, আবার দুটোই সত্য জীবনের সঙ্গে বৃক্ষের মিল আছে তার খাড়াখাড়ি ওপরে উঠে যাওয়াতে, নদীর মিল আছে তার আড়াআড়ি প্রবহমানতায় প্রশ্নটা দাঁড়াবে কোন তুলনাটা ঠিকÑ গাছের, নদীর, নাকি যন্ত্রের? এককালে মানুষ গাছে থাকত, নেমে এসে হাত হাতিয়ার ব্যবহার করেছে অসংখ্য যন্ত্র, অজস্র উদ্ভাবনা এখন তার হাতের মুঠোয় সে নদীর মতো যতটা না প্রবহমান, যন্ত্র নিয়ে তার চেয়ে অধিক ব্যস্ত জগৎটা এখন ছোট হয়ে গেছে বড় হতে গিয়ে তা গাছ বলি আর নদীই বলি, উভয়েই খুব বিপদে আছে কাঠুরেরা এখন অনেক বেশি তৎপর বৃক্ষনিধনে দখলদাররা সারাক্ষণ ব্যস্ত নদী দখলে দূষণে প্রকৃতি নিজেই তো এখন বিপন্ন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা গবেষণার বড় বড় দায়িত্বের ভেতরে থেকে মাঝেমধ্যে আমাদের জানাচ্ছেন, সৌরজাগতিক এমন একটা বিস্ফোরণ ঘটতে পারে যাতে শুধু পৃথিবী নয়, পরিচিত মহাবিশ্বই ধ্বংস হয়ে যাবে ভাবলে হাত-পা শীতল হয়ে আসে কিন্তু তবু একেবারে যে শীতল হয় না, তার কারণ ঠিক আগামীকালই যে ঘটনাটা ঘটতে যাচ্ছে এমন নয় কিন্তু যা প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে টের পাওয়া যাচ্ছে, সেটা হলো পৃথিবীটা ক্রমেই মনুষ্য বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে প্রকৃতি ইতোমধ্যেই অত্যন্ত বিরূপ হয়ে পড়েছে ঝড় জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা বেড়েছে আগের তুলনায় ঘন ঘন হচ্ছে বাংলাদেশে আমরা শরৎকালকে এখন পাচ্ছি বর্ষা গ্রীষ্ম হিসেবে সমুদ্রের পানি উঁচু হয়ে উঠছে, নিচু এলাকা বিলীন হয়ে যাবে প্রকৃতি ক্ষেপে গেছে এমনই এমনই ক্ষেপেনি তাকে উত্ত্যক্ত করা হয়েছে সে এখন প্রতিশোধ নেবে কারা উত্ত্যক্ত করল? উত্ত্যক্ত করল পুঁজিপতিরা সৌরজাগতিক মহাপ্রলয়ের আগে মনে হয় ধরিত্রীই ধ্বংস হয়ে যাবে, ওই পুঁজিপতিদের কারণে

দরকার হলো নদী, প্রকৃতি পরিবেশকে উন্নতির একেবারে কেন্দ্রে স্থাপন করা কাজটা সহজ নয়, কিন্তু অসম্ভব না তাও বলা যাবে না তবে এর জন্য প্রয়োজন হবে দৃষ্টিভঙ্গির বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সেটি গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক শেষ পর্যন্ত প্রয়োজন হবে একটি সামাজিক বিপ্লবের গ্রামকে ঢাকায় টেনে আনার দরকার নেই, দূষিত ঢাকাকেও ঠেলে ধাক্কিয়ে আমরা গ্রামে নিয়ে যেতে চাওয়াও ভুল ছিল; আমাদের আকাঙ্ক্ষা উন্নতি হোক মানবিক সর্বত্রগামী দৈত্যের মতো নয়, নদীর মতো একাত্তরে ভোটের নয়, আমাদের সামনে ছিল সংগ্রামের রাজনৈতিক সংহতি কিন্তু খুব বেশি দিন সংহতিটা টেকেনি, বদলে যেতে থাকে দৃশ্যপট স্টিমারটি ঘাটে ভিড়লে যেমনটা ঘটে, ঠিক তেমনটি ওপরতলার যাত্রীরা, যাদের সংখ্যা অল্প, তারাই প্রথমে এবং দ্রুতগতিতে নেমে যায় নিচের ডেকে অনেক মানুষের ভিড়, তাদের নামতে হয় পরে এবং ধীরে ধীরে তারা নেমে দেখে যানবাহন বলতে কিছু আর অবশিষ্ট নেই, ওপরতলার মানুষরা সব দখল করে নিয়ে নিজেদের গন্তব্যে চলে গেছে গন্তব্য একটাই যেখানে যা পাওয়া যায় দখল করা

একাত্তরের ওই রাজনৈতিক শক্তি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং তার লক্ষ্যও সুনির্দিষ্ট হানাদারদের তাড়িয়ে দেওয়া আমরা সংকল্প  জয়ী হয়েছিলাম একাত্তরে সংহতির কারণে ওই শক্তিটা হারিয়ে যায়নি, জনগণের মধ্যে সুপ্ত আছে, তাকে সংগঠিত করা দরকার সুস্পষ্ট গন্তব্যের দিকে এগোনোর জন্য বলা বাহুল্য, লক্ষ্যটি একুশ দফা কিংবা এগারো দফার নয়, এক দফার সমাজ পরিবর্তনের সমাজ তো নানা ধরনের সম্পর্ক বৈ অন্যকিছু নয় ওই সম্পর্কগুলোকে বদলানো চাই সম্পর্কগুলোর ভেতরে একপক্ষে রয়েছে মালিক, অপরপক্ষে প্রজা এতে চলবে না, চলছে না সব সম্পর্কের মূলনীতি হওয়া চাই বন্ধুত্ব তার জন্য ব্যবস্থাটাকে বদলাতে হবে ব্যবস্থা ভালো করতে পারলে অবস্থার উন্নতি হবেই

 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা