ভূ-রাজনীতি
ইমতিয়ার শামীম
প্রকাশ : ০৭ জুলাই ২০২৩ ০৬:১২ এএম
আশি-নব্বইয়ের দশকে
রাজনৈতিক অঙ্গনে দু-চারটে প্রবাদতুল্য
উক্তি নিয়ে প্রায়ই
তুমুল তর্ক-বিতর্ক হতো। চীনের
বহুল আলোচিত নেতা
দেং জিয়াও পিংয়ের
বলা এ রকম একটি উক্তি
ছিল, ‘বিড়াল সাদা
কি কালো,
সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, বিড়ালটা ইঁদুর
মারে কি না।’
চীন, সোভিয়েত রাশিয়া
আর যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরের
দ্বন্দ্ব-বন্ধুত্বের সূত্রে
আরও একটি উক্তিও
ব্যাপক প্রচার পেয়েছিল
ওই সময়। সেটি
হলো, ‘শত্রুর শত্রু, আমার বন্ধু’। স্নায়ুযুদ্ধের
কাল চলছে তখন। দুই পরাশক্তি সোভিয়েত
রাশিয়া আর মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক হয়ে উঠেছে ভীষণ
শীতল। অন্যদিকে মার্কসবাদী
সমাজতান্ত্রিক ধারণার পথিক
হওয়ার পরও ব্যাপক
দূরত্ব দেখা দিয়েছে
সোভিয়েত ইউনিয়ন আর জনগণতান্ত্রিক চীনের
ভেতর। এমন শীতল
সম্পর্ক আর দূরত্বের
মধ্যেও ‘শত্রুর শত্রু, আমার বন্ধু’র মতো ‘সুবচনের’
পথ বেয়ে নিবিড়
বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের
মধ্যে, ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের
মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী
কদর্যতার সাংস্কৃতিক প্রকাশ
ঘটেছে, মার্কিন আদিবাসীদের
সূত্রে ছড়িয়ে পড়া এমন একটি
উক্তিও তখন বামপন্থিরা
প্রায়ই বলতেন। বলতেন, ‘আমেরিকা যার বন্ধু,
তার কোনো শত্রুর
দরকার নেই।’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের
পরিচালক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন
আহমদও বোধকরি ওই কথাটি মনেপ্রাণেই
বিশ্বাস করতেন। না, মার্কসবাদী ছিলেন
না তিনি,
বামপন্থিও না;
তবে আস্থা ছিল তার সমাজতান্ত্রিক
অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ওপর। বিশ্বব্যাংকের
সাবেক প্রধান রবার্ট
ম্যাকনেমারার সঙ্গে তার বৈঠকে কী ঘটেছিল,
সেটা কম-বেশি সবাই
জানেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের
সময় আগস্ট মাসে
যা ঘটেছিল,
তার তাৎপর্য আরও গভীর। ওই সময় ভারত
সফরে এসে যুক্তরাষ্ট্রের
সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের
সঙ্গে সাক্ষাৎ করার
আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর
ব্যক্তিগত সচিব ফারুক
আজিজ খানও তাকে
এ বৈঠকে বসতে
রাজি করানোর চেষ্টা
চালিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী
তাতে রাজি হননি, বরং বলেছিলেন, ‘আপনি সমাজতন্ত্র
চাইবেন, আবার মার্কিন
সাহায্য-সমর্থন চাইবেনÑ দুটো একসঙ্গে
হতে পারে না।’
ফারুক আজিজ খান বলেছেন,
দুই দশক পর কেউ কেউ এই সাক্ষাৎকার
হয়েছিল বলে জানালেও, তার জানামতে, এ সাক্ষাৎ
হয়নি। এ বৈঠকে
রাজি না হওয়ার
ব্যাপারে তাজউদ্দীন তাকে
বলেছিলেন, ‘নিক্সন যা করছেন,
সিনেটর কেনেডি যদি আজ আমেরিকার
প্রেসিডেন্ট থাকতেন,
তাহলে তিনিও তা-ই করতেন।’
তা সত্যতা
আছে বৈকি তাজউদ্দীনের
ওই কথার : যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি
বদলায়, শাসক দল পাল্টায়,
কিন্তু বৈদেশিক নীতির
পরিবর্তন খুব সহজে
ঘটে কী?
খুব সহজে পরিবর্তন
ঘটে না দেশটির
পররাষ্ট্রনীতির। কেননা যুক্তরাষ্ট্রকে
শেষ পর্যন্ত পরিচালনা
করেন এমন একদল
রাজনীতিক, যারা দাবার
গুটি চালেন বোর্ডের
দুই প্রান্ত থেকেই। বাংলাদেশকে
ঘিরেও যুক্তরাষ্ট্র এখন খেলছে ওই ছন্দে। এ দেশ সম্পর্কে
যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক অবস্থান
তাই রাজনৈতিক অঙ্গনের
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা
হয়ে উঠেছে। সত্যি
বলতে গেলে,
১৯৭১ সালের পর যুক্তরাষ্ট্র এ দেশের চায়ের
কাপে বোধকরি আর কখনোই এত ঝড় তোলেনি। মানবাধিকার
ইস্যুকে গুরুত্ব দিয়ে
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে পুলিশের
বিশেষ বাহিনী র্যাব এবং এর কয়েকজন
কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা
নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। লেখা
বাহুল্য, র্যাব গঠনের
শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রও গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা রেখেছে এবং এ নিয়ে
তখন সমালোচনাও হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র
বলছে, গণতন্ত্রের স্বার্থে
বাংলাদেশে তারা একটি
অবাধ, সুষ্ঠু ও অর্থবহ নির্বাচন
দেখতে চায়।
বাংলাদেশকে দীর্ঘ
দেড় যুগের মতো সময় ধরে পরিচালনা করছে
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন
সরকার। অন্যদিকে দেশের
অন্যতম বিরোধী দল বিএনপি ও দলটির নেতৃত্বাধীন
জোট এবং সমমনা
দলগুলো একই সময় ধরে ক্ষমতায়
যাওয়ার জন্যে
‘আন্দোলন’ করে আসছে। শুধু
বিএনপি নয়,
গণতন্ত্রমনা উল্লেখযোগ্য নাগরিকেরই
বিশেষত সর্বশেষ ২০১৮
সালের সংসদ নির্বাচন
নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে। কেননা
এ রকম মূল্যায়ন
ও বিশ্বাস করার
যথেষ্ট যুক্তি ও ভিত্তি রয়েছে
যে, এ নির্বাচনের
ফল ছিল পূর্বনির্ধারিত,
ভোট দেওয়া হয়ে গেছে আগের
দিন রাতের বেলাতেই; এ নির্বাচন
অংশগ্রহণমূলক হয়নি,
স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ
হয়নি। বিশেষত এর পর থেকেই
বিএনপি নিরপেক্ষ,
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে
নির্বাচনের পক্ষে শক্ত
অবস্থান নিয়েছে। দেশে
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার
লক্ষ্যেই বিএনপি আন্দোলন
করছে, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের
দাবি করছে,
এ রকম ভাবলে
অবশ্য ভুলই হবে। আওয়ামী
লীগের মূল লক্ষ্য
যেমন ক্ষমতায় থাকা, বিএনপির লক্ষ্য
তেমনই ক্ষমতায় যাওয়া। এইখানে
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কিংবা
গণতন্ত্র রক্ষার কোনো
ব্যাপারস্যাপার নেই।
বিএনপির পালে
পর্যাপ্ত হাওয়া লেগেছে
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কারণে। যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কথা বলছে,
মানবাধিকারের কথা বলছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের
কথা বলছে। সে জন্যে তারা
বাংলাদেশ বিষয়ে নতুন
ভিসানীতি আরোপ করেছে, নিষেধাজ্ঞাও আরোপ
করা হয়েছে অনেকের
যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ওপর, যাদের সঠিক
নামধাম আমাদের কাছে
নেই। বাম রাজনীতির
সুদিন থাকলে মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের এ হেন পদক্ষেপে সমালোচনার
ঝড় বয়ে যেত। তারা
তো বটেই,
উদারপন্থি অনেকেও বলতেন, সাম্রাজ্যবাদ এ দেশের ওপর থাবা বসাতে
চাইছে। কিন্তু মনে হচ্ছে,
বামপন্থিদের অনেকের কাছেই
এখন সাম্রাজ্যবাদের সংজ্ঞা
পাল্টে গেছে। কারণ
বিএনপি নেতাদের মতো তারাও মনে করছেন,
আমেরিকার গৃহীত পদক্ষেপের
মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ও সুষ্ঠু নির্বাচন
হওয়ার পথ খুলে
যাবে! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক
দীর্ঘদিনের, বাণিজ্যিক সম্পর্কও
এখন অনেক নিবিড়। কিন্তু
তার পরও যুক্তরাষ্ট্রের
গত কয়েক দশকের
রাজনৈতিক ইতিহাস এমন নয় যে, তাদের এই ‘সদিচ্ছা’কে এ দেশের জনগণ
সোজাসাপ্টাভাবে নেবে। লোকজন
যে বলে,
‘কুমিরের কান্না’Ñ
বাংলাদেশের মতো বিভিন্ন
রাষ্ট্রের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের
কান্না আসলে অনেকটা
সে রকম। আর সেজন্যেই যুক্তরাষ্ট্রের
গৃহীত পদক্ষেপের নেপথ্য
লক্ষ্য আসলে কী, সেটি বরং গভীরভাবে খতিয়ে
দেখা প্রয়োজন। কারণ
যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক
শুরু থেকেই নিছক
অর্থনৈতিক কিংবা বাণিজ্যিক
কূটনীতির নয়,
বরং বরাবরই ভূ-রাজনৈতিক। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের
পরিপ্রেক্ষিতে এই ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনা
অতীতের যেকোনো সময়ের
চেয়ে অনেক বেশি
গুরুত্ববহ।
যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিন
দ্বীপে সামরিক ঘাঁটি
স্থাপন করতে চাইছে
কি না,
তা নিয়ে অস্পষ্টতা
থাকতে পারে;
কিন্তু এতে তো কোনো অস্পষ্টতা
নেই যে,
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে আইপিএস-এ তার সঙ্গে পেতে
চায়, ব্রিকস-এ অংশগ্রহণ
থেকে বিরত রাখতে
চায়। চীনের সঙ্গে
বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ঘনিষ্ঠতাও
তার অত পছন্দের
নয়। যেমন পছন্দের
নয় রাশিয়ার সঙ্গে
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিকাশ। ভারতের
সঙ্গে সম্পর্কের নিবিড়তা
থেকে যুক্তরাষ্ট্র এতদিন
দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক
রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ
করার প্রয়োজন বোধ করেনি। কিন্তু
সময় পাল্টেছে। তাই ভারতের প্রতিবেশী
দেশ নিয়েও তাদের
আগ্রহ বেড়েছে। কেননা
গেল শতাব্দীর আশির
দশকেও আমেরিকা ও চীনের যে দর্শনীয় নৈকট্য
ছিল, এখন তা ঢের ম্রিয়মাণ। চীন তখন সোভিয়েত
ইউনিয়নকে মনে করত ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ’। কিন্তু
ভেঙে পড়া সেই ইউনিয়নের ধ্বংসস্তূপের
মধ্যে থেকে মাথা
তোলা রাশিয়াকে হয়তো
চীন আর সাম্রাজ্যবাদ
মনে করে না। যদিও
ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার
যে যুদ্ধ,
তা একদিকে যেমন
ইউক্রেনের উগ্র জাতীয়তাবাদিতার
আস্ফালন, অন্যদিকে আবার
রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রেরই
প্রকাশ।
বাংলাদেশ একটি
গণতান্ত্রিক ও শোষণমুক্ত
রাষ্ট্র হিসেবে বিকশিত
হোক, এটি নিশ্চয়ই
সবারই প্রত্যাশা। আওয়ামী
লীগের এই শাসনামল
যে সে ক্ষেত্রে
কোনো কার্যকর দৃষ্টান্ত
রাখতে পারেনি,
বরং ২০১৮ সালের
নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে
পরিস্থিতিকে আরও জটিল
করে তুলেছে,
তা লেখাই বাহুল্য। কিন্তু
তার পরও বিএনপি
যে কার্যকর কোনো
আন্দোলন গড়ে তোলার
চেষ্টা চালিয়েও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ
হয়েছে, তার প্রধান
একটি কারণ,
এ দলটির কাছে
জনগণের কোনো গণতান্ত্রিক
প্রত্যাশা নেই। এটি সুস্পষ্টÑ
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নয়, বরং ক্ষমতায়
যাওয়াই বিএনপির মূল এজেন্ডা। আর সে কারণেই
যুক্তরাষ্ট্রের এসব পদক্ষেপকে
বিএনপি কিংবা
‘গণতন্ত্র মঞ্চ’
সমালোচনার চোখে ক্রিটিক্যালি
বিবেচনা করতে ব্যর্থ
হয়েছে। তারা মনে করছে,
এতে তাদের ক্ষমতায়
যাওয়ার পথ কুসুমাস্তীর্ণ
হচ্ছে। শত্রুর শত্রু
কতখানি বন্ধু হতে পারে,
সে সমীকরণ মেলাতে
তারা ব্যর্থ হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র,
যে রাষ্ট্রটি কি না ততটুকু
গণতন্ত্রই অনুমোদন করে, যতটুকু তার সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রকে
বাঁচিয়ে রাখার কাজে
লাগে। সেই রাষ্ট্রের
বদান্যতায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা
আসলে খোয়াব দেখারই
নামান্তর। সরকারি দল আওয়ামী লীগ ভারত ও চীনকে ক্রিটিক্যালি
সঙ্গে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের
এই ভূ-রাজনৈতিক চাপ সামলানোর চেষ্টা
করছে। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে একটি
সরকার কেবল তখনই
পুরো রাজনৈতিক সক্ষমতা
দেখাতে পারে,
যখন তার গণতান্ত্রিক
ভিত্তি থাকে,
গণভিত্তি থাকে,
যখন সেই সরকার
একটি স্বচ্ছ নির্বাচনী
প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে
গঠিত হয়ে থাকে। একাত্তরের
বাংলাদেশ সরকারের সেই গণতান্ত্রিক গণভিত্তি
ছিল; কেবল বিপ্লবাত্মক
নয়, শাসনতান্ত্রিক ভিত্তিও
ছিল। যে কারণে
তাজউদ্দিন সরকারের পক্ষে
সম্ভব হয়েছিল নিক্সন
সরকারকে তো বটেই, ডেমোক্র্যাট কেনেডিকেও
উপেক্ষা করা। একাত্তরের
পর বাংলাদেশ এই দুই হাজার
তেইশ সালে এসে আবারও যুক্তরাষ্ট্রের
সঙ্গে কঠিন এক কূটনৈতিক পরীক্ষার
মুখোমুখি। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মুখোশের নিচে থাকা সাম্রাজ্যবাদী মুখশ্রীকে সামলাতে হলে যে দল বা যারাই রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকুন না কেন,
যে দলই ক্ষমতায় যেতে চান না কেন,
তাদেরকে জনগণের কাছেই ফিরতে হবে,
জনতার কাছ থেকেই মাথা নত না করার শক্তি নিতে হবে।