পদ্মা সেতুর এক বছর
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রাপ্ত সূত্রে দেশ-বিশ্ববাসী সম্যক অবগত আছেন স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলের ২১ জেলায় শুধু নয়; পুরো দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে নবতর দিগন্ত উন্মোচন করেছে। শুভ উদ্বোধনের পর থেকে এক বছরের মধ্যেই সেতুর অভাবনীয় উপযোগিতা অতিশয় দৃশ্যমান। অবকাঠামো-শিল্পকারখানা-ব্যবসাবাণিজ্য-কর্মসংস্থান ও রাজস্ব আদায়ে পদ্মা সেতুর বিস্ময়কর অধ্যায় রচনা সত্যিই অসাধারণ। সর্বমোট ব্যয়িত ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা আগামী ৩৫ বছরে অর্থাৎ ২০৫৭ সাল পর্যন্ত এক শতাংশ সুদসহ ১৪০টি ত্রৈমাসিক কিস্তিতে ঋণ শোধের পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ পরিশোধ কার্যক্রম অভূতপূর্ব আশাজাগানিয়া। চলতি বছরের ৫ এপ্রিল ও ১৯ জুন ঋণের প্রথম-দ্বিতীয় ও তৃতীয়-চতুর্থ কিস্তির অর্থ যথাক্রমে ৩১৬ কোটি ৯০ লাখ ৯৭ ও ৩১৬ কোটি ২ লাখ ৬৯ হাজার ৯৩ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। টোল আদায়ের ক্ষেত্রেও পদ্মা সেতু প্রায়শ নতুন নতুন রেকর্ড গড়ে যাচ্ছে। জাতীয় সংসদে সেতুমন্ত্রী কর্তৃক উপস্থাপিত তথ্যমতে, ৭ জুন পর্যন্ত ৭৫৮ কোটি ৮ লাখ ৭৫০ টাকার টোল আদায় হয়েছে, যা অনন্য মাইলফলক হিসেবে প্রতিভাত।
দেশের সামগ্রিক অবস্থানকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অনন্য উচ্চতায় সমাসীন করার অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতির যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত হিসেবে সেতু নির্মাণ অগ্রগণ্য। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতু ঘিরে নতুন এক শিল্পবিপ্লবের সূচনা প্রবল অনুভূত।দক্ষিণাঞ্চলের বিনিয়োগ ব্যবস্থার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। এ অঞ্চলের মৎস্য-কৃষি-পর্যটন-অবকাঠামো-ব্লু ইকোনমিসহ
সব খাতের প্রসার
ঘটছে। দেশের দ্বিতীয়
অর্থনৈতিক করিডোর হিসেবে
গড়ে উঠেছে ঢাকা-দক্ষিণ পশ্চিামাঞ্চল। মোংলা
বন্দর দিয়ে বিদেশে
রপ্তানি শুরু হয়েছে
ঢাকার গার্মেন্টস পণ্য। বেড়েছে
পায়রা বন্দরে আমদানি-রপ্তানি,
যার প্রভাব পড়েছে
বরিশাল বিভাগের জনজীবনে। পায়রা
বন্দর, কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতসহ
দুই তীরে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক
জোনগুলোকে কেন্দ্র করে দেশের পর্যটন
খাত নতুন মাত্রা
পেয়েছে। ফলে কর্মসংস্থান
বেড়েছে বহুগুণ। চলমান
উন্নয়ন এবং গৃহীত
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার যথার্থ
বাস্তবায়নে এই করিডোর
দেশের বৃহত্তম করিডোরে
পরিণত হওয়ার সমূহ
সম্ভাবনাও প্রকট। বিশ্বব্যাংকসহ
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা
সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী, পদ্মা সেতুর
কারণে দক্ষিণাঞ্চলের এক ভাগ প্রবৃদ্ধি
বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের প্রবৃদ্ধি
বাড়বে শূন্য দশমিক
৬ ভাগ। পাশাপাশি
দেশে প্রতিবছর ১ দশমিক ৯ শতাংশ হারে
দারিদ্র্য হ্রাসে সহায়ক
হবে।
দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্স
অব বাংলাদেশ
(আইসিএবি) ও ইকোনমিক
রিপোর্টার্স ফোরাম
(আইআরএফ) আয়োজিত এক আলোচনা সভায়
সেন্টার ফর পলিসি
ডায়ালগের (সিপিডি)
সম্মানিত একজন ফেলো
বলেন, ‘পদ্মা সেতু
আমাদের আকাঙ্ক্ষা-আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। আমরা
নিজস্ব অর্থায়নে করেছি। কিন্তু
আমাদের এখন সমান্তরাল
উদ্যোগগুলো নিতে হবে। কারণ
পদ্মা সেতু শুধু
ট্রান্সপোর্ট করিডোর নয়। আমরা
এটিকে অর্থনৈতিক করিডোর
করতে চাই।’
ওই আলোচনা সভায়
অর্থনীতিবিদরা পদ্মা সেতুকে
ঘিরে অর্থনৈতিক করিডোর
গড়তে বিনিয়োগ বাড়ানোর
দূরদর্শী উদ্যোগ নেওয়ার
পরামর্শ দিয়েছেন। পদ্মা
সেতু প্রকল্পকে ঘিরে
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড উৎসাহিত
করতে সরকারিভাবে নেওয়া
উদ্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ এতদঞ্চলের বিভিন্ন
জেলায় বিশেষ করে মহাসড়কের পাশে
শিল্পকারখানা গড়ে তোলার
ব্যবস্থা, সেতুর উভয় পাশে গ্যাস
সংযোগ, দক্ষিণে বিসিক
শিল্পনগরীগুলো চালু ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক
অঞ্চলের (বেজা)
মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড
সম্প্রসারণসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্প
স্থাপনের সহায়ক নীতি
গ্রহণ, মাশুল আদায়ে
স্বয়ংক্রিয় ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রবাহে ফাইবার
অপটিক ক্যাবল স্থাপন, মাস্টার প্ল্যানের
আওতায় সেতুর উভয় পাশে উন্নয়নের
ব্যবস্থা, পৃথক উন্নয়ন
কর্তৃপক্ষ গঠন,
নদীর উভয় পাশে
ইকোপার্ক স্থাপন এবং পদ্মার পাড়ে
শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের
একটি অংশ নিয়ে
প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে ‘শেখ হাসিনা
তাঁতপল্লী’।
আমরা
জানি, ২০০৮ সালের
ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে ২০০৯ সালের
৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা সরকার
গঠনের ১৩তম দিবসে
পদ্মা সেতু নির্মাণে
পরামর্শক নিয়োগের সিদ্ধান্ত
গ্রহণ করেন। এর নির্মাণকাজ সমাপ্তির
অনুমিত সময়কাল ছিল ডিসেম্বর ২০১৩। উঁচুমার্গের
সুশাসন ও জবাবদিহি
নিশ্চিতকল্পে অর্থ উপদেষ্টা
ড. মশিউর রহমান
উপদেষ্টা এবং মোশাররফ
হোসেন ভূঁইয়া সেতু
বিভাগের সচিব নিয়োগপ্রাপ্ত
হন। প্রকল্পের কারিগরি
প্রস্তাব মূল্যায়নের দায়িত্বে
ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক
ড. জামিলুর রেজা
চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই
অনুধাবন করতে পেরেছিলেন; কী কারণে
বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ
তুলে দেশ-সরকার ও অত্যন্ত সৎ-যোগ্য-গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের
বিতর্কিত করার অশুভ
চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিল।
দাতাগোষ্ঠীর
পক্ষ থেকে সমন্বয়ক
হিসেবে বিশ্বব্যাংক পদ্মা
সেতুর প্রস্তুতি কাজ-পরামর্শক ও ঠিকাদার নিয়োগের
প্রতিটি পর্যায়ে তাদের
তদারকি ও অনুমোদনসাপেক্ষে
কার্যক্রম অগ্রসরমাণ ছিল। মূলত
সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ
আবুল হোসেনের ভাষ্যমতে, ঠিকাদার নিয়োগের
ক্ষেত্রে একজন যোগ্য
ঠিকাদার বিশ্বব্যাংকের কালো
তালিকাভুক্তির কারণে তাকে
বাদ দিয়ে অন্য
একটি অযোগ্য ঠিকাদারকে
নিয়োগ দিতে সুপারিশ
করে। কারিগরি কমিটি
তাদের পরামর্শ অনুযায়ী
ঠিকাদারকে বাদ দিলেও
অন্য অযোগ্য দরদাতাকে
যোগ্যতর করতে কারিগরি
কমিটি সম্মত না হওয়ায় পদ্মা
সেতুর বাস্তবায়ন বিলম্বিত
করার উদ্দেশ্যেই নানা
প্রতিবন্ধকতা ও মিথ্যা
অভিযোগ উপস্থাপন করে। সাবেক
মন্ত্রীর বক্তব্য হচ্ছে, অযোগ্য দরদাতা
প্রতিষ্ঠানে স্থানীয় এজেন্ট
এবং কতিপয় দেশীয়
পত্রিকাকে প্রভাবিত করে মন্ত্রীর পদ এবং কর্মকাণ্ডকে
প্রশ্নবিদ্ধ করে তার সততা নিয়ে
প্রশ্ন তোলা হয়।
প্রচণ্ড
প্রভাব বিস্তার করে দুদকের সত্যনিষ্ঠ
ও নিরপেক্ষ তদন্তে
অভিযোগের সপক্ষে কোনো
কিছু প্রমাণিত না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট
বিশিষ্ট জনরা গ্রেপ্তার
এড়াতে সক্ষম হন। এমনকি
মন্ত্রী মন্ত্রিসভা থেকে
পদত্যাগ করেও পদ্মা
সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন
স্থগিত করার সিদ্ধান্ত
থেকে সরে আসেনি। বিশ্বব্যাংকের
মাধ্যমে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রের
ষড়যন্ত্র ও অর্থায়ন
প্রত্যাখ্যান করে
‘আমরাও পারি’
আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা নিজস্ব
অর্থায়নে ২০১৪ সালের
ডিসেম্বর মাসে পদ্মা
সেতুর নির্মাণকাজ শুরু
করেন। দীর্ঘ পাঁচ
বছর পর ২০১৭
সালের ৬ জানুয়ারি
কানাডায় টরেন্টোর উচ্চতর
আদালত দুর্নীতির এই মামলা খারিজ
করে দেন। প্রধানমন্ত্রী
বলেছিলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের
কোনো ভিত্তি নেই। আমি তাদের চ্যালেঞ্জ
দিলাম, কোথায় দুর্নীতি
হয়েছে সেটা প্রমাণ
করতে হবে। আপনারা
শুনলে একটু অবাক
হবেন, সাদা কাগজে
একটা চিরকুট। এখান
থেকে অমুক পাবে
এত পারসেন্ট,
অমুক এত পারসেন্ট। এভাবে
নানা অপপ্রচার শুরু
হয়। বিশ্বব্যাংকের কাছে
দুর্নীতির কোনো প্রমাণ
নেই। বিশ্বব্যাংক যখন দুর্নীতির অভিযোগ
আনল, তখন আমি চ্যালেঞ্জ দিলামÑ আমরা দুর্নীতি
করিনি, পারলে প্রমাণ
করো। আল্লাহর রহমতে
প্রমাণ করতে পারেনি। কানাডার
ফেডারেল কোর্ট যেখানে
মামলা করেছিল,
তারা বলে দিয়েছে, এখানে কোনো
দুর্নীতি হয়নি। আমি কথা দিয়েছিলাম, নিজেদের টাকায়
পদ্মা সেতু বানাব। আপনাদের
দোয়ায় সেই পদ্মা
সেতু নিজেদের অর্থায়নে
করে যাচ্ছি।’
অবিচল
আত্মবিশ্বাস ও আস্থার
সঙ্গে দেশীয়-আন্তর্জাতিক কথিত
উন্নয়ন সহযোগীদের বহুবিধ
চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রকে পরাস্ত
করে ২৫ জুন ২০২২ বহুল
প্রতীক্ষিত ৬.১৫ কিলোমিটার
দীর্ঘ দেশের ১৮ কোটি মানুষের
স্বপ্নের পদ্মা সেতুর
শুভ উদ্বোধন হয়। এই গৌরবগাঁথায় প্রতিহিংসাপরায়ণ
পরাজিত কুচক্রী মহল নতুন করে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত
হয়েছিল। মূল্যস্ফীতিসহ বহুলাংশে
সেতু নির্মাণশৈলীতে প্রযুক্তি-সুবিধা সংযোজনের
যৌক্তিক কারণে ব্যয়ের
পরিমাণ কিছুটা বেশি
হওয়ায় জনগণকে বিভ্রান্ত
করার জন্য দেশের
উন্নয়ন বিরোধীচক্র পদ্মা
সেতুতে অনেক বেশি
অর্থ খরচ হওয়ার
তকমা লাগানোর অপকৌশলে
ব্যতিব্যস্ত ছিল। গণমাধ্যমে
প্রকাশিত তথ্যমতে,
প্রাথমিক পর্যায়ে যে ১০ হাজার
কোটি টাকার পদ্মা
সেতুর প্ল্যান করা হয়েছিল,
তাতে ভূমি অধিগ্রহণের
পরিমাণ ছিল মোট ২ হাজার
২৬৭ একর। কিন্তু
বাস্তবে অধিগ্রহণ করতে
হয়েছে ৬ হাজার
২৪১ একর। ফলে জমি অধিগ্রহণ
তিনগুণ বেড়ে যায়। এ ছাড়াও ভূমি
অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ
জনগণকে উপকৃত করার
উদ্দেশ্যে ক্ষতিপূরণ বাবদ
বরাদ্দ প্রধানমন্ত্রী আইন পরিবর্তন করে তা তিনগুণ
বাড়িয়ে দেন।
প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী সেতুর নিচ দিয়ে বড় জাহাজ চলাচলের সুবিধার্থে ৪১টি স্প্যানের মধ্যে মাত্র ৩টি স্প্যান উঁচু করে বসানোর পরিকল্পনা নেওয়া হলেও পরবর্তীতে ৪১টি স্প্যানই সমউচ্চতায় বসানো হয়েছে। সেতুর দৈর্ঘ্যও ৫ দশমিক ৮ কিলোমিটার থেকে বেড়ে হয়েছে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। করতে হয়েছে খরস্রোতা নদী পদ্মার দীর্ঘ ১৬ কিলোমিটার পাড় নিয়ে নদীশাসন। প্রাথমিক ডিজাইনে গ্যাস-বিদ্যুৎ লাইন নেওয়ার পরিকল্পনা না থাকলেও পরে এ দুটি লাইন সংযুক্ত হয়। সর্বোপরি ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান কমে যাওয়া প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। সার্বিক বিবেচনায় পদ্মা সেতু নির্মাণব্যয় বৃদ্ধির মিথ্যা অভিযোগ নিতান্তই অযৌক্তিক বা অমূলক। সব অপপ্রচার ও দেশের বিরুদ্ধে দেশীয়-বৈশ্বিক চলমান কদর্য চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রকে পরাভূত করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সত্যের কাঠিন্যে আপামর জনগণের সুদৃঢ় ঐক্যবদ্ধতায় পদ্মা সেতুর মতো সব উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ অধিকতর অত্যুজ্জ্বল হবেই।