× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

জন্মদিন

কর্ম ও সৃষ্টির বিস্তৃত সীমানায়

সৈয়দ জিয়াউল হক

প্রকাশ : ২৩ জুন ২০২৩ ০০:১৫ এএম

আপডেট : ২৩ জুন ২০২৩ ১১:৫৩ এএম

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। প্রবা ফটো

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। প্রবা ফটো

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আমাদের আলোকবর্তিকা। আমাদের কাছে তাঁর অপরিহার্যতা কতটা এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নতুন করে নিষ্প্রয়োজন। ২৩ জুন আমাদের জাতীয় জীবন দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ১৭৫৭ সালের এই দিনে পলাশীর প্রান্তরে মীর জাফর, জগৎ শেঠ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ প্রমুখের বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। আবার ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী লীগের জন্ম হয়, যে দলের নেতৃত্বে বাংলা আবার তার হারানো স্বাধীনতা ফিরে পায়।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী নামটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে জ্ঞান, পাণ্ডিত্য আর প্রজ্ঞামিশ্রিত একজন আদর্শ শিক্ষকের মুখচ্ছবি। তাঁর বিচরণ তাঁর মূল পেশা শিক্ষকতাকে ছাড়িয়ে অনেক দূর বিস্তৃত। শিক্ষা, সাহিত্য, রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন- এমন কোনো দিক নেই যা সম্পর্কে তিনি লেখনী ধারণ করেননি। এখানেই আর দশজন শিক্ষক থেকে তিনি স্বতন্ত্র। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসময় সত্যেন বসু, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ডব্লিউ এ জেনকিনস, রমেশচন্দ্র মজুমদার, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, এএফ রহমান, এসি টার্নার, জেসি ঘোষ, জিএইচ ল্যাংলি, মোকাররম হোসেন খন্দকার, এএম হারুন অর রশীদ, আবদুর রাজ্জাক, সরদার ফজলুল করিম, মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রাধাগোবিন্দ বসাক, এসি সরকার, প্রফুল্ল কুমার গুহ, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ শিক্ষক ছিলেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতো শিক্ষকের উপস্থিতি এখনও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কাছে আমাদের ঋণ অপরিসীম।

অনেকেই শিক্ষা বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান অনেক নিম্নগামী হয়েছে। এর প্রধান কারণ জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার অভাব। এ কথা সর্বজনবিদিত, শুধু বিদ্যমান জ্ঞান বিতরণ করা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি। আর এ জ্ঞান সৃষ্টির মূল কারিগর শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী। আর নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতো শিক্ষক। কারণ শিক্ষকের কাজ ছাত্রছাত্রীদের মনে জ্ঞানের স্পৃহা তৈরি, শুধু তথ্য দিয়ে ভারাক্রান্ত করা নয়। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি বিজ্ঞানী এপিজে আবদুল কালাম একবার বলেছিলেন, ‘দ্য মাইন্ড ইজ নট আ ভেসেল টু ফিলড ইন, ইট ইজ আ ফ্লেইম টু বি ইগনাইটেড।’ একবার শিক্ষার্থীদের মনে জ্ঞানের শিখা প্রজ্বালিত করতে পারলে তাকে আর থামানো যায় না। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ছাত্রছাত্রীদের মনে জ্ঞানের এ আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলার কাজে আজীবন নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তবে আদর্শ শিক্ষকের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যটি দিয়েছেন মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন। তাঁর মতে, ‘এ সাকসেসফুল টিচার ইজ ওয়ান হু গ্র্যাজুয়ালি মেকস হিমসেলফ আননেসেসারি ফর দ্য স্টুডেন্টস।’ নিঃসন্দেহে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এই শ্রেণির একজন সার্থক শিক্ষক।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৬ সালে। জীবনের কিছু সময় কেটেছে কলকাতায়। গান্ধী, জিন্নাহ, নেহরু, প্যাটেল, লিয়াকত আলি খান, সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ ‘বুড়োখোকা’দের আত্মঘাতী রাজনীতির ফলে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়, যা কোটি কোটি মানুষের দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বয়স তখন ১১ বছর। কোটি কোটি শরণার্থীর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও অবর্ণনীয় দুঃখ তাঁর কিশোর মনে গভীর রেখাপাত করে। তাই ভারত বিভাগের ফলে কোটি কোটি ছিন্নমূল মানুষের কান্না তাঁর লেখনীতে অত্যন্ত মূর্ত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। ভারত বিভাগ নিয়ে দুই বাংলায় অনেক পুস্তক রচিত হয়েছে, এবং এর অনেকটিই আমার পড়ার সুযোগ হয়েছে। তবে এ বিষয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখা ‘জাতীয়তাবাদ সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি’ নিঃসন্দেহে অন্যতম শ্রেষ্ঠ আকরগ্রন্থ, এ কথা অনায়াসে বলতে পারি।

জিন্নাহ মনে করেছিলেন, ব্রিটিশমুক্ত স্বাধীন ভারতে মুসলমানরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে, যদিও তিনি প্রথমে ভারত বিভাগের বিপক্ষেই ছিলেন। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ স্ব-স্ব সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষার দাবি তুলেছিল। কিন্তু তাদের এ দাবির অসারতা সম্পর্কে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর পরিষ্কার উপলব্ধি হচ্ছে, ‘দুই পক্ষই সংখ্যালঘুকে নিরাপদ করতে চাইছে বলে দাবি করেছে, কিন্তু সেটা করতে গিয়ে যে ঘটনা ঘটিয়েছে তাতে বিপদ যা হয়েছে সেটা ওই সংখ্যালঘুদেরই। ভারতে মুসলমানদের, পাকিস্তানে হিন্দুদের।’ ভারত থেকে যেসব ছিন্নমূল মুসলমান পাকিস্তানে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের দুরবস্থা দেখে জিন্নাহ বিচলিত হয়ে অশ্রুপাত করেছিলেন। এ বিষয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মন্তব্য, ‘বিজয়ীদেরই যদি অমন কষ্ট হয়, তবে যারা পাকিস্তানে হতভাগ্য সংখ্যালঘু তাদের মানসিক অবস্থাটা সে সময় কেমন দাঁড়িয়েছিল, সেটা আমরা ধারণার মধ্যে আনতে চাইনি, আনতে পারলে স্বাধীনতাকে ঠিক পূর্ণিমার চাঁদ বলে ভাবতে পারতাম না।’

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর আরেকটি বড় সাফল্য ও বৈশিষ্ট্য, তিনি বাংলা গদ্যে নিজের একটি স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করতে পেরেছেন। দর্শন ও ইতিহাসের অনেক জটিল বিষয় তিনি অত্যন্ত সুখপাঠ্য করে তুলতে পারেন। তাঁর কাজের ক্ষেত্র বিস্তৃত। তাঁর যেকোনো লেখার শিরোনাম ও লেখকের নাম না দেখেও অনায়াসে বলে দেওয়া যায় এটির লেখক তিনি। একজন লেখকের জন্য এটা অনেক বড় কৃতিত্ব। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর চিন্তা ও লেখার কেন্দ্রবিন্দুতে সমাজের সাধারণ মানুষ। তিনি শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখেন। তাঁর দৃষ্টিতে স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ মানুষের জীবনমানের উন্নতি। আর তা অবশ্যই সমষ্টিগত উন্নয়ন। যে উন্নয়ন মানুষের সমষ্টিগত সুখের দিকে মুখ তুলে তাকায় না, অস্থিরভাবে কেবলই ব্যক্তিকে উত্তেজিত করে তুলে উচ্ছৃঙ্খলরূপে বড় করে, যেখানে সমষ্টিকে পদদলিত করে ব্যক্তি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, সেই উন্নতি বা উন্নয়ন তাঁর প্রত্যাশা নয়। বর্তমান সময়ের কিংবদন্তিতুল্য শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘজীবন কামনা করি। তাঁর ৮৮তম জন্মদিনে নিবেদন করি শ্রদ্ধাঞ্জলি।


লেখক, গবেষক, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা