× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

মুদ্রানীতি

মূল্যস্ফীতি কমানোই মূল লক্ষ্য

ড. আতিউর রহমান

প্রকাশ : ২২ জুন ২০২৩ ০০:৫৮ এএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্য নিয়ে কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে চলতি অর্থবছরজুড়েই মূল্যস্ফীতির দাপট ছিল অভাবনীয় মে মাসের মূল্যস্ফীতি ছিল প্রায় দশ শতাংশের কাছাকাছি আর গত এগারো মাস ধরেই ক্রমাগত বাড়ছিল মূল্যস্ফীতি স্বল্পমেয়াদি মূল্যস্ফীতি যদি অনেকদিন ধরে চেপে বসে থাকে, তা হলেই বিপদ তাতে করে মানুষের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হতে পারে যে, জিনিসপত্রের দামের এই ঊর্ধ্বগতি সহজে থামবে না তাই মূল্যস্ফীতিকে বাগে আনাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পয়লা নম্বর লক্ষ্য হওয়ার কথা এবারের মুদ্রানীতিতে সে বিষয়টিই আমরা লক্ষ্য করলাম মূল্যস্ফীতি শেষ পর্যন্ত মুদ্রাজনিত একটি বিষয় তাই তাকে বাগে আনতে হলে প্রথমেই নজর দিতে হবে বাড়তি মুদ্রার সরবরাহ কমানোর দিকে বাজার থেকে বাড়তি মুদ্রার সরবরাহ না কমিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর উপায় নেই সার্বিক মুদ্রা সরবরাহ কমানো, ব্যক্তি খাতের ঋণকে কমানোর জন্য বেশি দামি করে ফেলা এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকের নেওয়া ঋণের নীতি সুদ বাড়ানোর মতো উদ্যোগ নিয়ে এবারে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে এই ঘোষণা অনেকটাই বাস্তবানুগ

মুদ্রানীতি প্রসঙ্গে প্রথমেই আলোচনা করা দরকার বাজেটে মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রসঙ্গটিতে সত্যি বলতে আসছে অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার কত হবে বা না হবে তার চেয়ে মূল্যস্ফীতি কতটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবেÑ সেদিকেই বেশি নীতি-মনোযোগ কাম্য তবে বাজেট প্রস্তাবনায় যেমন দাবি করা হয়েছে সেভাবে মূল্যস্ফীতি শতাংশে ধরে রাখার লক্ষ্য অর্জন আদৌ সম্ভব কি না তা নিয়েও ভাবার সুযোগ আছে কারণ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জানাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম এগারোটি মাসে কখনোই মূল্যস্ফীতি শতাংশের নিচে ছিল না আর মে মাসে মূল্যস্ফীতি তো প্রায় দুই অঙ্কের কাছে ঠেকেছে (.৯৪ শতাংশ) উল্লেখ্য, গত এপ্রিল পর্যন্ত গড় মূল্যস্ফীতি ছিল .৬৪ শতাংশ নিঃসন্দেহে এই অর্থবছরের মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্যমাত্রা (. শতাংশ), তার থেকে তা বেশ খানিকটা বেশি আর পাশের দেশ ভারতের চেয়ে তা প্রায় দ্বিগুণ বাংলাদেশের বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ওপরে ছিল সর্বশেষ ২০১০-১১ অর্থবছরে (১০.৯২ শতাংশ)

অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিবৃতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেমধ্যমেয়াদে সতর্ক রাজস্বনীতিঅনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে একই সঙ্গে মুদ্রানীতিকেও সঙ্কোচনমূলক রাখার কথাটি কিন্তু বাজেট বক্তৃতায় আসেনি তবে আগামী অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে এই কথাটি থাকছে বলে জানা গেছে আরও জানা গেছে যে, এরই অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় রেপো বা নীতি সুদহার বাড়ানো হবে [কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থের প্রয়োজন হলে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে পুনরায় ক্রয় করা হবে, এমন নিশ্চয়তার ভিত্তিতে ট্রেজারি বিল বা বন্ড বা অন্য কোনো বন্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক হতে অর্থ সংগ্রহ করাকে রেপো বলে] একই সঙ্গে বাড়ানো হচ্ছে বিশেষ রেপো এবং রিভার্স রেপোর সুদ হারও জানা যাচ্ছে, এবারে ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহারের সঙ্গে আড়াই থেকে তিন শতাংশ মার্জিন যোগ করে সুদহারের করিডোর তৈরির উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে তা যদি হয় তাতে কলমানি রেটের সঙ্গে রেপো রেট ওঠানামা করবে এখন থেকেই সেক্ষেত্রে শতাংশের বেড়াজাল উঠে যাবে তাতে করে পুরোপুরি না হলেও এই ব্যবস্থাকেমন্দের ভালোবলা যায় এতে করে বাজারেরও ইঙ্গিত তবে একই সঙ্গে আমাদের ধীরে ধীরে আরও বাজারনির্ভরতার দিকে এগোতে হবে

সর্বোপরি, মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা আনতে একক মুদ্রা বিনিময় হার চালু করার প্রস্তাব করা হয়েছে বাজারভিত্তিক এই প্রস্তাবনাগুলো যদি বাস্তবায়ন করা যায়, তাতে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন নিশ্চয়ই আশা করা যায় কেননা টাকার অবমূল্যায়নের সঙ্গে মূল্যস্ফীতির রয়েছে সরাসরি সম্পর্ক ছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য কমে আসতে শুরু করেছে (যেমনÑ জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৭০-৭৫ ডলারে নেমে এসেছে, যা প্রায় করোনা মহামারি আসার আগের দামের সমান) তবে এর প্রভাবেই যদি আমরা রাতারাতি বাংলাদেশে পণ্যমূল্য পরিস্থিতির উন্নতি আশা করি, তবে তা ঠিক হবে না কেননা ডলারের বিপরীতে টাকার যে অবমূল্যায়ন হয়েছে (প্রায় ২৫ শতাংশ) তার জেরে আমাদের খরচ আগের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া আপাতত অসম্ভবই মনে হচ্ছে এসবের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারি ঋণের কারণেও মূল্যস্ফীতির চাপ বহাল থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে

দেশের ৫২তম বাজেটের আকার লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকারউন্নয়ন অগ্রযাত্রায় দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখেশিরোনামে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা এই ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক উৎস থেকে লাখ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা সংগ্রহের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী অর্থাৎ বাজেট ঘাটতি মেটাতে তার ৫১ শতাংশই অভ্যন্তরীণ ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ করার কথা সরকার যদি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে নেয়, তাতেও বাজারে টাকার সরবরাহ বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ অব্যাহত থাকতে পারে তবে কথাও মনে রাখা চাই যে, প্রচুর ডলার বিক্রি করেছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অনেক টাকা বাজার থেকে ফিরেও এসেছে ফলে ব্রড মানির পরিমাণও কমে এসেছে এতে করে মুদ্রানীতিকে সংযত রাখা সহজ হতে পারে

মূল্যস্ফীতি যাতে দীর্ঘমেয়াদে চেপে না বসে, সে জন্য মূল্যস্ফীতির আশঙ্কাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মুদ্রানীতিকে যথার্থ সিগনাল বা ইঙ্গিত দেওয়ারও কোনো বিকল্প নেই মুদ্রাবাজারকে এই সিগনাল দিয়েই প্রভাবান্বিত করা সঙ্গত সে জন্য নীতি সুদহার বাজারনির্ভর সুদের হারের দিকেই বাংলাদেশ ব্যাংককে হাঁটতে হচ্ছে মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য আরও কিছু উদ্যোগের কথা ভাবা যায় যেমনÑ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে অনেক ভোগ্যপণ্য ইনপুট আমদানির খরচ এমনিতেই বেড়ে গেছে এই বাড়তি খরচের চাপ সামাল দিতে বিদ্যমান রেগুলেটরি শুল্কসহ কিছু কিছু আমদানি শুল্ক আরও কমানোর কথা ভেবে দেখা প্রয়োজন আশার কথা এই যে, এবারে মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিবৃতিতে আমদানির ওপর কড়াকড়ি কমিয়ে আনার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে নিঃসন্দেহে নিত্যপণ্য এবং দেশজ শিল্পের কাঁচামাল যন্ত্রপাতি আমদানি ব্যাপক হারে কমে গেলে উৎপাদন ভোগ দুই- ব্যাহত হয় তাতে সরবরাহ কমে আসে তখন মূল্যস্ফীতি বরং বাড়ে আর রপ্তানি শিল্পের ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সে কারণেই ক্ষুদ্র আমদানিকারকদের (ধরুন পাঁচ লাখ ডলারেরও কম যারা আমদানি করেন) নির্ঝঞ্ঝাট এলসি খোলা ডলারপ্রাপ্তির বিশেষ সুযোগ তৈরি করা যায় কি না তা ভেবে দেখা যেতে পারে কথাও ঠিক মুদ্রানীতি রাজস্ব মধ্যে গভীর সম্পর্ক আছে সে জন্য রাজস্বনীতিকেও বাস্তবানুগ রাখা চাই সেদিক থেকে বিচার করলে যদিও আপাতদৃষ্টিতে বাজেট সম্প্রসারণমূলক মনে হলেও শেষ পর্যন্ত পুরো বাজেট বাস্তবায়নের সম্ভাবনা খুবই কম তাই কার্যত এটি সংকোচনমূলক বাজেটই রয়ে যাবে তবে খেয়াল রাখতে হবে যে যেসব প্রকল্প দ্রুত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে, মানুষের জীবন চলায় সহযোগিতা করবেÑ সেগুলো যেন সময়মতো বাস্তবায়ন করা হয় সেগুলোর জন্য সরকারি ঋণ দিতেও বাংলাদেশ বাংক উৎসাহী থাকবার কথা

দেখা যাচ্ছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং রাজস্ব আহরণ বলশালী করাÑ এই দুই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্যই সরকার সাহসী পরিকল্পনা নিয়েছে আসছে অর্থবছরের জন্য বিদ্যমান বাস্তবতায় এমন সাহসী পদক্ষেপের খুব বিকল্প ছিল না তাই মোটা দাগেই গৃহীত মুদ্রানীতির বিষয়গুলোকে সময়োচিত পদক্ষেপ বলা যায় তবে এটাও মানতে হবে যে, এই বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে আমাদের গতানুগতিকতা থেকে বের হয়ে আসতেই হবে তাই বাজেট বাস্তবায়নে যুক্ত অংশীজনদের সাম্প্রতিক যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি সংবেদনশীলতারও পরিচয় দিতে হবে


  • অর্থনীতিবিদ  বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা