চাই সচেতনতা
ফজিলাতুন নেসা শাপলা
প্রকাশ : ২২ জুন ২০২৩ ০০:৫১ এএম
আপডেট : ২২ জুন ২০২৩ ১২:৩১ পিএম
অলঙ্করন: জয়ন্ত জন
আত্মহত্যাকে
বলা হয় প্রতিরোধযোগ্য
মৃত্যু। অথচ দিন দিন বেড়েই
চলেছে এ স্বেচ্ছামৃত্যু। তবু আমরা ঠেকাতে
পারছি কই?
সব বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষের
মধ্যে এ প্রবণতা
থাকলেও তরুণদের মাঝেই
আত্মহত্যার হার বেশি। বিশ্বজুড়েই
১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সিদের
মৃত্যুর চতুর্থ সর্বোচ্চ
কারণ আত্মহত্যা। ডব্লিউএইচওর
তথ্যমতে, বিশ্বে মোট আত্মহত্যার ৭৭ শতাংশ ঘটছে
স্বল্প ও মধ্যম
আয়ের দেশগুলোয়। অর্থনৈতিক, সামাজিক,
রাজনৈতিক, ধর্মীয়,
অশিক্ষা, কুসংস্কারসহ নানা
কারণ রয়েছে আত্মহত্যা
পেছনে। দুঃখজনক হলেও
সত্য, বাংলাদেশেও অল্পবয়সিদের
মাঝে আত্মহত্যার হার বেশি। গবেষণা
সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের
তথ্যমতে, সব শ্রেণি-পেশার মানুষের
মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই
বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ। করোনা-পরবর্তী বাংলাদেশে
৫৩২জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা
করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে
পড়ুয়া তরুণদের কাছে
সবার প্রত্যাশা অনেক
বেশি অথচ তারা
কেন এ পথ বেছে নিচ্ছেন? কেনইবা এত হতাশা বা বিষণ্নতায় ভুগছেন? যা তাদেকে
ঠেলে দিচ্ছে আত্মহননের
দিকে? প্রশ্নের উত্তর
নেই কারো কাছেই। তবে প্রশ্নের উত্তর
খুঁজতে গিয়ে যে কারণগুলো উঠে আসে,
সেগুলো হলো-
নিজেদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ
করতে না পারা, প্রেমে ব্যর্থতা, পরিবারের সঙ্গে
ভালো সম্পর্ক না থাকা,
পরিবারের অস্বাভাবিক প্রত্যাশা
ও চাপ,
পারিবারিক কলহ,
প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে
মানিয়ে নিতে না পারা,
বুলিং ও সাইবার
ক্রাইমের শিকার হওয়া, সামাজিক যোগাযোগের
মাধ্যম ও মিডিয়ার
প্রভাব, দরিদ্রতা,
বেকারত্ব, মাদকাসক্তি ইত্যাদি। এ কারণগুলোর পাশাপাশি
আরও দুটি বিষয়ের
ওপর গুরুত্ব দেওয়ার
সময় এসে গেছে। সেগুলো
হলো- প্যারেন্টিং বা অভিভাবকত্ব অর্থাৎ
সন্তান লালনপালন পদ্ধতিকেও
সন্তানের এমন ঝুঁকিপূর্ণ
মানসিকতা এবং তার করুণ পরিণতির
জন্য অনেকখানি দায়ী
করা হচ্ছে। আর দ্বিতীয়টি হলো- ব্যক্তির মানসিক
স্বাস্থ্য। মানসিক স্বাস্থ্য
নিয়ে কথা বলা আমাদের দেশে
ট্যাবু হওয়ার কারণে
এ বিষয়ে চিকিৎসকের
কাছে যাওয়ার বিষয়টি
ভাবতেই পারেননা অনেকে। বাবা-মা বা অভিভাবকরাও এ বিষয়ে
সচেতনতা না থাকায়
তারা কখনই সন্তানের
মানসিক অবস্থা বুঝতে
চান না। অথচ গবেষণা বলছে, আত্মহত্যাপ্রবণতার অন্যতম
কারণ বিষণ্নতা,
ইনসমনিয়া ও সিজোফ্রেনিয়ার
মতো মানসিক অসুস্থতা। বঞ্চনা, ক্ষোভ,
একাকিত্ব, সামাজিক বিচ্ছিন্নতাও
আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ায়।
গবেষণায়
প্রমাণিত, যারা দীর্ঘদিন
ধরে নিজেদের দুঃখদুর্দশা
ও হতাশায় ভুগছেন
তারা কিন্তু সবাই
আত্মহত্যা করার কথা ভাবছেন না বা চেষ্টা
করছেন না। কিন্তু
যারা আত্মহত্যা করার
বারবার চেষ্টা করছেন, তাদের ৯৫ ভাগই দীর্ঘদিন
ধরে কোনো না কোনো মানসিক
অসুস্থতার মধ্য দিয়ে
গেছেন এবং যাদের
বেশির ভাগকে কখনোই
চিকিৎসার আওতায় আনা হয়নি। চিকিৎসারত
অবস্থায়ও অনেকে আত্মহননের
পথ বেছে নিয়েছেন
তার বড় কারণ
চিকিৎসা গ্রহণ ও মানসিক পরিচর্যার
অভাব। যেখানে মানসিকভাবে
অসুস্থদের বিশেষ পরিচর্যার
প্রয়োজন রয়েছে সেখানে
একজন ছাত্র বা ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে
ভর্তি হওয়ার পর অনেক বাবা-মাই আছেন
যারা অর্থনৈতিক দায়দায়িত্ব
নিলেও সন্তানের মানসিক
অবস্থার কোনো দায়িত্ব
নিতে চান না। একজন
সন্তান মানসিকভাবে পিছিয়ে
পড়লে বা রোগগ্রস্ত
হলে তার পরিচর্যার
জন্য পারিবারিক সহায়তা
খুব কম পাওয়া
যায় এবং বেশিরভাগ
ক্ষেত্রেই অল্পবয়সিরা মন খুলে তার বাবা-মার কাছে
তাদের নিজের সমস্যার
কথা বলতে পারে
না। অভিভাবক বা প্রিয়জনকে পাশে
না পাওয়ার কারণে
তারা খুব একা হয়ে যায়, ফলে বেছে
নেয় স্বেচ্ছামৃত্যু। স্বেচ্ছামৃত্যু
দুই ধরনের-একটি হলো হঠাৎ আত্মহত্যা
করে ফেলা,
যাকে বলা হয় ইমপালসিভ সুইসাইড। যেমন
মা-বাবা কোনো
কারণে সন্তানকে বকাঝকা
করলেন, অমনি ক্ষোভে-দুঃখে-হতাশায় সন্তান
আত্মহত্যা করল। আরেক
ধরনের আত্মহত্যাকে বলে পরিকল্পনা করে আত্মহত্যা। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি
মনে মনে অনেক
দিন থেকেই আত্মহত্যার
প্ল্যান করে এবং আত্মহননের চেষ্টা
করে। এ চেষ্টার
মাধ্যমে কেউ এক প্রচেষ্টাতেই সফল হয়,
কেউ ব্যর্থ হয়।
একবার
যারা আত্মহত্যার কথা চিন্তা করে তারা তাদের
আচরণে কিছু লক্ষণ
প্রকাশ হয় যে বিষয়গুলোকে শুরু
থেকে আমলে নিলে
ঠেকানো সম্ভব প্রতিশ্রুতিশীল
যেকোনো তরুণ প্রাণ। সতর্ক
সংকেত হিসেবে কিছু
লক্ষণের কথা উল্লেখ
করা যেতে পরে। যেমন
ব্যক্তি তার যেকোনো
কাজে (অঙ্কন,
লেখা, ফেসবুক পোস্ট) মৃত্যুর সংকেত
দিতে থাকে। যেমন
নিজের প্রিয় জিনিস
অন্যের মাঝে বিলিয়ে
দেয়। সবার কাছে
ক্ষমা চায়। কারও
সঙ্গে কোনো ঝামেলা
থাকলে মিটিয়ে ফেলার
চেষ্টা করে। কথায়
কথায় হতাশা প্রকাশ
করা যেমন আমি চলে গেলে
কেউ আমাকে মিস করবে না, আমি যদি মরে যেতে
পারতাম, আমি চলে গেলে সবাই
ভালো থাকবে ইত্যাদি। অন্যদিকে
খুব দ্রুত ওজন বেড়ে যাওয়া
বা কমে যাওয়া। শরীরের
বিভিন্ন জায়গায় কাটা
কিংবা ইনজেকশনের সুচের
দাগ অথবা হাত-পা কাটা
বা নিজেকে আঘাত
করা। নিজেকে সবকিছু
থেকে গুটিয়ে নেওয়া
অর্থাৎ সামাজিক অনুষ্ঠানে
যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া,
বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সবার
কাছ থেকে নিজেকে
গুটিয়ে রাখা। হঠাৎই
নিজের যত্ন নেওয়া
বন্ধ করে দেওয়া। যে কাজগুলো করতে
একসময় খুব আনন্দ
পেত সেগুলোও বন্ধ
করে দেওয়া। হঠাৎই
ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করা, আচমকা অ্যালকোহল
বা নেশা নেওয়া
শুরু করা ইত্যাদি।
ইমপালসিভ সুইসাইড ছাড়া একটু সতর্ক হলেই যেকোনো স্বেচ্ছামৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। সে ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজেকে সতর্ক হতে হবে বেশি। আত্মহত্যার চিন্তা এড়ানোর জন্য বা সেরকম পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার জন্য তার একটি নিরাপত্তা পরিকল্পনা থাকতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নের পাশাপাশি প্রিয়জন, অভিভাবক, শিক্ষক ও সহপাঠীর সহযোগিতা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, গণমাধ্যম ও প্রফেশনালদের যথাযথ ভূমিকা পালনের মাধ্যমেই কেবল এ অকালমৃত্যু রোধ করা সম্ভব।