পুঁজিবাজার
আবু আহমেদ
প্রকাশ : ২১ জুন ২০২৩ ১৪:১২ পিএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
২০২০ সালে বীমা
খাতের প্রায় সব শেয়ারের দাম বেড়ে যায় অস্বাভাবিক হারে। তখন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড
এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) তদন্ত করে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে শাস্তির আওতায়
নিয়ে আসে। স্মরণে আছে, ২০২২ সালে ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স নামে একটি বীমা কোম্পানিকে
শেয়ার কারসাজির দায়ে একজন বিনিয়োগকারীকে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, শেয়ার কারসাজির
দায়ে কয়েকজনকে অর্থদণ্ড দেওয়ার জন্য নির্দেশনা স্মারক পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে একাধিক
প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় ব্যক্তির নাম উল্লেখ ছিল। বিস্ময়কর হলো, বিএসইসির ওয়েবসাইটে ডিসেম্বরভিত্তিক
এনফোর্সমেন্ট অ্যাকশন তালিকায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তার তথ্য
গোপন করা হয়েছে। বিষয়টি অস্বাভাবিক। কারণ ওই মাসে অন্য আরও ৯৬ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের
বিরুদ্ধে অ্যাকশন রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছিল। অথচ এনফোর্সমেন্ট অ্যাকশন তালিকায় শেয়ার
কারসাজিদের তথ্য গোপন করা হয়েছে।
এই তথ্য কেন গোপন
করা হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। যদি নীতিমালা সম্পর্কিত বিষয় থাকে তা হলে আলাদা কথা। আবার
এমন হতে পারে শাস্তির বিরুদ্ধে দায়ী ব্যক্তিরা আপিল করেছেন। আপিল করলে বিষয়টি বিচারাধীন
হয়ে যায়। হয়তো এ জন্য আর ওয়েবসাইটে এমন তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না। তার পরও বিষয়টি স্পষ্ট
নয়। যদিও তা স্পষ্ট করা প্রয়োজন। বিশেষত আমাদের স্মরণে আছে, ২০২০ সালে বীমা খাতের প্রায়
সব শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছিল। বিষয়টি আলোচনায় আসার পর বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ
অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) তদন্ত করে এর সত্যতা পায় এবং পরবর্তী সময়ে তারা
বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসে। বিএসইসি শেয়ার কারসাজির দায়ে
কয়েকজনকে অর্থদণ্ডও দেয়। এক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষণীয়, বিএসইসি কয়েকজনকে শাস্তি দিলেও,
আরও আরও অনেকে থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের বিষয়ে তথ্যও গোপন করা হয়। কিন্তু বিষয়টি
তো এমন হওয়ার কথা ছিল না। প্রচলিত নিয়মানুযায়ী, তদন্তের মাধ্যমে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ
প্রমাণিত হবে, যারাই দোষী প্রমাণিত হবেÑ তাদের সবাইকে যথোপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। একই
পাপে কারও লঘুদণ্ড, কারও গুরুদণ্ডÑ বিষয়টি একেবারেই অনুচিত এবং সমর্থনযোগ্য নয়। সুশাসন
নিশ্চিত করার দায়িত্ব যাদের ওপর, তারাই যদি তা লঙ্ঘন করে বা যথাযথভাবে নিজেদের দায়িত্ব
পালন না করে তা বড় বেদনার এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায়।
শেয়ারবাজার এখন
সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। কথাটিকে আরেকটু বাড়িয়ে বলা যায়, এই সংকটাপন্ন অবস্থা দীর্ঘদিনের।
বিষয়টিকে আজকের প্রেক্ষাপটে বলা হয়, শেয়ারবাজারের এখন স্বাভাবিক গতি নেই। এই গতি না
থাকার কারণ ফ্লোর প্রাইস। মূলত বাজারে ফ্লোর প্রাইস দেওয়ার কারণেই শেয়ারবাজারের গতি
মন্থর হয়ে পড়েছে। আমরা জানি, বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশে শেয়ারদর যখন একেবারে তলানিতে
এবং শেয়ারবাজারের সূত্রমতে, বাজারের নিজস্ব শক্তিতে ঘুরে না দাঁড়িয়ে উল্টো আচরণ
করে অর্থাৎ সূচক যখন বারবার সূচনালগ্নের অবস্থানে ফিরে যায়Ñ তখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা
নিরুপায় হয়ে ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে। আমাদের শেয়ারবাজারের অবস্থাও আজ এতটাই রুগ্ন
যে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যাতে করে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে ফ্লোর প্রাইস। তবে
এই ‘ফ্লোর প্রাইস’ নির্ধারণও কিন্তু আমাদের পুঁজিবাজারের ঘুরে দাঁড়ানোর পথে অন্তরায়।
কারণ ‘ফ্লোর প্রাইস’ নির্ধারণ করে দেওয়া বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি কাজ করে।
আর সেই ভীতি থেকে স্বাভাবিকভাবেই লেনদেন কমে আসে। যার ফল, শেয়ারবাজারের পতন।
প্রকৃত প্রস্তাবে
পুঁজিবাজারে ‘ফ্লোর প্রাইস’ দেওয়ার পক্ষে কোনোই যুক্তি নেই, থাকতে পারে না। আমাদের
পুঁজিবাজারের জন্য এটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের কোথাও এমন নজির নেই।
যেখানে ফ্লোর প্রাইসের নামে আটকে রাখা হয়েছে শেয়ারবাজারে মূল্য। আসলে যে বাজারে কেনা-বেচা
করা যায় না, সেটা কি কোনো বাজার? না, তা কোনো বাজার হতে পারে? আমাদের বাজারে যেখানে
লেনদেন হওয়ার কথা দুই, আড়াই হাজার কোটি টাকা, সেখানে লেনদেন হচ্ছে মাত্র ৪-৫শ কোটি
টাকা। আমাদের বাজারে এমন অবস্থা বিরাজ করছেÑ যেখানে কেউ তার জরুরি প্রয়োজনেও শেয়ার
বিক্রি করতে পারছেন না। এক্ষেত্রে ফ্লোর প্রাইস যত দ্রুত সম্ভব তুলে নেওয়া যাবে, ততই
মঙ্গল। আবার এই ফ্লোর প্রাইসের মধ্যেও কিন্তু কারসাজি হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে বলা যায়,
সত্যিকার অর্থেই শেয়ারবাজার প্রশ্নে আমরা এখন নিরুপায়। এ ব্যাপারে বিএসইসির কাজ সুশাসন
প্রতিষ্ঠা করা এবং শেয়ারবাজারের স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনা। কিন্তু সেখানে তারা বরাবরই
ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।
নানা সময়ে শেয়ারবাজারের
কারসাজির প্রসঙ্গ সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। এ নিয়ে কথাবার্তাও কম হয়নি। তার মানে শেয়ারবাজারে
কারসাজির বিষয়টি বর্তমান প্রেক্ষাপটে একেবারে নতুন নয়। এক্ষেত্রে বাজারে কারসাজির বিরুদ্ধে
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের অনীহার বিষয়টি আমাদের সামনে বড় প্রশ্ন দাঁড় করায়। যখনই কোনো
অভিযোগ ওঠে তখন সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা কারসাজির ক্ষেত্র নিয়ে পালটা প্রশ্ন তোলেন।
ফলে কারসাজির প্রশ্নে তদন্ত বা তা চিহ্নিত করার প্রক্রিয়াটি বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
তারা জিজ্ঞেস করে, কোথায় কারসাজি হয়েছে তা দাখিল করা হোক। কেউ যদি কারসাজি হয়েছে প্রমাণ
করে দেখাতে পারে তখন অবশ্য ভিন্নচিত্র দেখা যায়। এই পুরো বিষয়টিই দায়িত্বশীলদের অনীহা।
এই অনীহা থাকা উচিত নয়। অন্তত শেয়ারবাজারের স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনার স্বার্থ বিবেচনা
করে অনীহা রাখা যাবে না। বরং কারসাজি কিংবা অসাধুতার যেকোনো অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে
বিবেচনা করতে হবে। সেগুলো খতিয়ে দেখে অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে
হবে। বিএসইসি তো এজন্যই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যাতে তারা শেয়ারবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা
করে। দায়িত্বের ক্ষেত্রে তাদের অনীহা একেবারেই প্রত্যাশিত নয়।
শেয়ারবাজারে কারসাজি
করলে সাধারণত অভিযুক্তদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়। অন্তত এতদিন তাই দেখে আসছি।
কারসাজির বিষয়টি খতিয়ে দেখার বিষয়ে ভাবতে হবে, এ কথা সত্য। কিন্তু শেয়ারবাজারে এমন
অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে ফ্লোর প্রাইসের কারণে। ৭০ শতাংশ কোম্পানির বাণিজ্য হয় না। বাকি
৩০ শতাংশ কোম্পানি কোনোমতে টিকে আছে। এর মধ্যে গুটিকয়েক কোম্পানি প্রতিবছর নিজেদের
শীর্ষ অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে। আচমকা প্রতিষ্ঠানগুলো আবার বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। শেয়ারবাজারে
যারা বিনিয়োগ করেন বা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেন, তারা সহজেই বুঝতে পারেন কোথায় কারসাজি
হয়। যারা শেয়ারবাজারের অবস্থা অস্থিতিশীল করে তোলে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার
কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না।
২০২০ সালে যখন
বীমা খাতের প্রায় সব শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয় তখন আমরা এর কড়া সমালোচনা
করেছিলাম। শেয়ারবাজারে কারসাজির পুরোনো ঘটনা নিয়ে মাথা ঘামানোর তুলনায় বর্তমানে বাজারের
অবস্থা নিয়ে ভাবাটা বেশি জরুরি। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীরা প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
আস্তে আস্তে তারা বিনিয়োগের আগ্রহও হারিয়ে ফেলছেন। এক সময় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের পর
পঞ্চাশ হাজার মুনাফা আয়ে কোনো কর দিতে হতো না। এখন এই সুবিধা তুলে নেওয়া হচ্ছে। নতুন
কর আইন বিনিয়োগকারীদের কোনো সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করছে না শেয়ারবাজারে। প্রশ্ন হচ্ছে,
শেয়ারবাজার তা হলে ঘুরে দাঁড়াবে কীভাবে? বিদ্যমান বাস্তবতা শেয়ারবাজারের ঘুরে দাঁড়ানোর
কোনো ইঙ্গিত দেয় না। বরং সামনে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে। বিএসইসি তাদের ওয়েবসাইটে
শুধু সতর্কীকরণ নির্দেশনা দিচ্ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অর্থদণ্ডের বিষয়টি আর ওয়েবসাইটে
দেওয়া হচ্ছে না।
পুঁজিবাজার আমাদের জন্য আশার আলো হয়ে এসেছিল। কিন্তু আমরা যথাযথভাবে এই বাজারকে কাজে লাগাতে পারিনি। এর পেছনে যে কারণগুলো রয়েছে, তা আমাদের সবারই জানা। এখন সেই জানা বিষয়গুলোর সমাধান যত তাড়াতাড়ি করা সম্ভব হবে, ততই মঙ্গল। আর তাতেই গতি ফিরবে পুঁজিবাজারে। সেই সঙ্গে আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে, যারা কারসাজির সঙ্গে জড়িত, যাদের কারসাজিতে বাজারে ধ্স নেমেছে, যাদের কারণে ও ব্যর্থতায় বাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারছে নাÑ তাদের সবার নাম প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণও জরুরি। এক্ষেত্রে কারা প্রভাবশালী আর কারা নয়, তা বিবেচনা করা অনুচিত নয়। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে হলে এর বিকল্প নেই। আর এ তো সত্যি যে, বিনিয়োগকারীরা আস্থা ফিরে পেলেই গতি পাবে পুঁজিবাজার।