× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

রাজনীতি

অর্থ উপার্জনের প্রশ্নবিদ্ধ মাধ্যম

মহিউদ্দিন খান মোহন

প্রকাশ : ২১ জুন ২০২৩ ১৪:০৮ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এবং বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমান ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলার রায় দিতে গিয়ে হাইকোর্ট মন্তব্য করেছেন, ‘রাজনীতিবিদরা জনগণ ও দেশের কল্যাণে নিজেদের উৎসর্গ করার লক্ষ্যে রাজনীতিতে জড়িত হন। রাজনীতি জনগণ ও দেশের কল্যাণে এক ধরনের মহান ত্যাগ ও নিষ্ঠার কাজ। তাই রাজনীতিবিদরা জনগণের সম্পদের রক্ষক হবেন, তারা ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন না।’ হাইকোর্ট আরও মন্তব্য করেছেন, ‘অর্থ উপার্জনের জন্য রাজনীতি কোনো পেশার আওতায় আসতে পারে না’ (প্রতিদিনের বাংলাদেশ, ৩১ মে, ২০২৩)।

হাইকোর্টের মন্তব্যের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। রাজনীতি একটি মহৎ কর্ম এবং জনসেবার ব্রতÑ এ কথা আমরা সবাই জানি। এমনকি রাজনীতিকদের মধ্যেও যারা দুর্নীতিতে লিপ্ত, তারাও এ সত্যটি জানেন। তবে মানেন না। মানেন না কারণ তারা রাজনীতির মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছেন। তারা মনে করেন রাজনীতি হচ্ছে বিত্তবৈভব গড়ার সহজ মাধ্যম। আজ যারা আমাদের দেশে রাজনীতি করছেন, তাদের ক’জন সত্যিকার অর্থেই দেশ ও জনগণের কল্যাণে রাজনীতি করছেন, তা খুঁজে বের করতে রীতিমতো জরিপ চালানোর দরকার হবে। অবস্থাটা হতে পারে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হওয়ার মতো।

অথচ এক সময় এমনটা ছিল না। আমাদের যারা প্রাতঃস্মরণীয় রাজনীতিবিদ, তারা সৃষ্টি করে গেছেন দেশ ও জনগণের সেবায় জীবন উৎসর্গ করার দৃষ্টান্ত। শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেদের বিত্ত-বেসাত বৃদ্ধির জন্য রাজনীতিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেননি। এমনকি বিরুদ্ধবাদীরা যাকে অহরহ সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করেন, সেই জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ কেউ উত্থাপন করতে পারেনি। তাঁরা কীভাবে নিজেদের দুর্নীতির ঊর্ধ্বে রাখতে পেরেছিলেন? সে সময় কি সমাজে দুর্নীতি-অসততা ছিল না? অবশ্যই ছিল। কিন্তু তাঁরা ছিলেন প্রকৃত অর্থেই দেশ ও জনগণের সেবক।

ভারত ভাগের পর ১৯৪৯ সালে মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে ও নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ (বর্তমান আওয়ামী লীগ)। সে সময় পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় মুসলিম লীগ সরকার। এক সময় উপমহাদেশের তাবৎ মুসলমানের দল ছিল মুসলিম লীগ। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার পর শাসকচক্র জনগণের মুখের ওপর সে দলের দরজা বন্ধ করে দিয়ে সেটাকে কতিপয় অভিজাত ব্যক্তির দলে পরিণত করে। নতুন দলের নাম কী হবে, এ নিয়ে আলোচনার সময় মওোনা ভাসানী বললেন, এটা হবে জনগণের মুসলিম লীগ। জনগণের উর্দু প্রতিশব্দ ‘আওয়াম’ যোগ করে নাম হলো আওয়ামী মুসলিম লীগ। এ দলকে গণভিত্তি দিতে মওলানা ভাসানী, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, তা রাজনৈতিক কর্মীদের জন্য অনন্য দৃষ্টান্ত। আওয়ামী মুসলিম লীগের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন সে সময় ঢাকায় কয়েকটি বাড়ির মালিক ইয়ার মোহাম্মদ খান; যার কারকুনবাড়ি লেনের বাড়িতে দলের প্রথম অফিস স্থাপন করা হয়। প্রতিষ্ঠার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় ১৯৪৯ সালে দলটি সরকারে আসে। নিজ বাড়িতে অফিস করতে দেওয়ার কথা বলে ইয়ার মোহাম্মদ খান সরকারের কাছ থেকে কোনো ফায়দা নেওয়ার চিন্তাও করেননি। এমনকি যার বাড়িতে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম কাউন্সিল হয়েছিল, টিকাটুলীর সেই রোজ গার্ডেনের মালিক কাজী হুমায়ন বশীরও কোনো সুবিধা নেওয়ার কথা ভাবেননি। কেন তারা এমন ত্যাগ স্বীকার করতে পেরেছিলেন? কারণ তারা সবাই একটি লক্ষ্য নিয়ে দলটি গঠন করেছিলেন। আর সে লক্ষ্য ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অধিকার আদায়, নিজেদের স্বার্থ হাসিল নয়।

আজ আমরা দেখি সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র। এখন সবাই দল করে কিছু পাওয়ার আশায়। কেউ দল ক্ষমতায় আছে এ সুবাদে হাতিয়ে নেয়, আবার কেউ দল ক্ষমতায় এলে হাতাবেÑ এ আশায় ছুরিতে শান দেয়। কিছুদিন আগেও লোকজন বলাবলি করতÑ রাজনীতি হলো পুঁজিহীন ব্যবসা। মানে এখানে অর্থিক বিনিয়োগ না করেই ফায়দা হাসিল করা যায়। কিন্তু এখন পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। এখানেও এখন পুঁজি লাগে। তাও যে সে পু৭জি নয়Ñ একবারে কোটি টাকার অংকের। আমাদের রাজনীতির পরিভাষায় ইদানীং দুটি শব্দ বেশ প্রচলিতÑ ‘মনোনয়ন বাণিজ্য’ ও ‘কমিটি বাণিজ্য’। শোনা যায়, বড় দলগুলোর মনোনয়ন পেতে কেউ কেউ নাকি পাঁচ-দশ কোটি টাকাও বিনিয়োগ করে থাকেন। কেন করেন এই বিনিয়োগ? করেন এ জন্য যে, দল ক্ষমতায় গেলে এর দুই-তিনগুণ তিনি উসুল করে নেবেন সে আশায়। আমাদের দেশের অতীত এবং বর্তমানের সরকারে থাকা দলগুলোর কতিপয় এমপি-মন্ত্রীর আমলনামার দিকে তাকালে এই কথার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকবে না। অন্যদিকে একই পদ্ধতিতে চলে কমিটি এবং পদ-বাণিজ্য। লাখ লাখ টাকা খরচ করে কমিটিতে একটু জায়গা চান অনেকেই। নেতারাও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা বা অবদানের মূল্যায়ন করেন না। তারা নগদে বিশ্বাসী। কোনো কোনো দলে তো এটা চলে এমএলএম (মাল্টি লেভেল মার্কেটিং) পদ্ধতিতে। একজন হয়তো কেন্দ্রীয় দরবারে শিরনি দিয়ে একটি জেলা কমিটির খাদেম হলেন। তিনি তখন ওই কমিটিতে স্থান দেওয়ার জন্য নজরানা নেন পদপ্রত্যাশীদের কাছ থকে। আবার উপজেলা কমিটির সভাপতি-সম্পাদকের কাছ থেকেও তিনি আদায় করেন সম্মানী। তারা আবার ইউিনিয়ন কমিটির কাছ থেকে তাদের খরচ উঠিয়ে নেন। এর ফলে আর্থিকভাবে দুর্বল কিন্তু দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ যোগ্য কর্মীরা থেকে যায় বঞ্চিত।

আমাদের দেশে যেসব বড় বড় দুর্নীতির ঘটনা উদঘাটিত হয়, সেগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করা যাবে না। রাজনৈতিক নেতাদের মদদে সরকারি প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা নিজেদের আখের গোছানোর মওকা পায়। দেশ থেকে অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করার ক্ষেত্রে রাজনীতিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা অস্বীকার করা যাবে না। তারা যদি দুর্নীতিমুক্ত থাকেন, তা হলে প্রশাসন দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব। কিন্তু ভূত তাড়ানোর শর্ষেতে ভূতের বাসার মতো মন্ত্রী-এমপিরাই অবগাহন করেন দুর্নীতির সাগরে। ফলে যা ঘটার তাই ঘটছে।

বাল্যকালে আমরা সীতানাথ বসাকের ‘আদর্শ লিপি’তে পড়েছি ‘সততা সুখের মূল’। এখন সততাকে কেউ কেউ বোকামি মনে করেন। ‘লোকটা সৎ’ বলার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পাওয়া যায়Ñ ‘তবে কি সুযোগের অভাবে’? মানে এই সমাজে কেউ সৎ থাকতে পারেন এটা যেন বিশ্বাসযোগ্য নয়। বলা বাহুল্য, অসততা আর শঠতার মহামারির কারণেই এমন জনধারণার সৃষ্টি। এ ধারণা বদলাবে সেদিন, যেদিন আমাদের রাজনীতিকরা দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকবেন, সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে সচেষ্ট হবেন। 


  • সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা