সম্পাদকীয়
সম্পাদক
প্রকাশ : ১৮ জুন ২০২৩ ০০:৫৫ এএম
অলঙ্করন : প্রবা
ক্লান্ত মানুষের শ্বাস ফেলার জায়গা কমতে কমতে এসে ঠেকছে তলানিতে। হাতের আঙুলে গোনা রাজধানীর উন্মুক্ত প্রান্তরের মাঝে হাতিরঝিল অল্প দিনেই ‘রাজধানীর ফুসফুস’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। ভাওয়াল রাজ্যের তেজগাঁও এলাকায় অনেক ভূসম্পত্তি ছিল, যার অন্যতম হাতিরঝিল। এস্টেটের হাতির পাল এখানের পানিতে স্নান করায় কালের পরিক্রমায় এর নাম হাতিরঝিল হয়। অযত্ন-অবহেলায় ঝিলটি একসময় পরিণত হয়েছিল ভাগাড়ে। সেই ভাগাড়কেই সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সাজিয়ে তোলা হয়। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, জলাবদ্ধতা ও বন্যা প্রতিরোধ, ময়লা পানি নিষ্কাশনব্যবস্থার উন্নয়ন, রাজধানীর যানজট নিরসন এবং শ্রীবৃদ্ধির মাধ্যমে জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি। সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার সময়ের মধ্যেই হাতিরঝিল পরিণত হয় রাজধানীবাসীর অন্যতম বিনোদনকেন্দ্রে। হাতিরঝিল শুধু সৌন্দর্যপিপাসু মানুষের মনের খোরাকই নয়, খোলা হাওয়ায় জলের এই বিস্তার শুধু ইট-কাঠের নগরে সৌন্দর্যের আধারই নয়, প্রতীক হয়ে ওঠে প্রকৃতির সুস্থতারও। মহানগরীর যোগাযোগব্যবস্থায়ও পায় নতুন মাত্রা, যার সুফল ভোগ করছেন নগরবাসী।
অথচ সেই হাতিরঝিলই আজ নগরবাসীর আগ্রহ হারাচ্ছে। কারণ এর পানির দুর্গন্ধ। খবরটি প্রকাশ পেয়েছে ১৭ জুন প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর শীর্ষস্থানে ‘হাতিরঝিলের জলে ৫৬ কোটি টাকা’ শিরোনামে। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঝিলের একটি অংশে ভেসে থাকা মরা মাছ রাজউক কর্মীরা মাটিচাপা দিলেও, পানির দুর্গন্ধ যায়নি; যা প্রতিনিয়ত ভোগাচ্ছে স্থানীয় অধিবাসী, দর্শনার্থী ও পথচারীদের। পানির দুর্গন্ধ দূর করতে কলাবতীসহ বিভিন্ন ঘাসজাতীয় ভাসমান গাছ লাগানো হলেও সুফল মেলেনি। পরবর্তী সময়ে ঝিলের পানি শোধন করার জন্য নেওয়া হয় ৫৬ কোটি টাকার প্রকল্প। কিন্তু কোটি কোটি টাকার প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলেও ঝিলের পানি জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের জন্য সুফল বয়ে আনেনি। হাতিরঝিলের পানিতে উৎকট দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়া, চলাচলের সময় মানুষের নাক-মুখ চেপে রাখার খবর রীতিমতো উদ্বেগজনক। প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনে সঙ্গতই প্রশ্ন তোলা হয়েছে, ঝিলে যদি মাছ বাঁচতে না পারে, যদি দুর্গন্ধ দূরই না হয় আর পানির স্বাভাবিক রঙ ফিরে না আসে, তাহলে অর্ধশত কোটি টাকা কোথায় খরচ করা হলো? প্রশ্নের যথার্থতা উপলব্ধি করে আমরা এর জবাব প্রত্যাশা করি।
এমনিতেই দখল-দূষণে আমাদের নদী-নালা, খাল-জলাশয়ের ত্রাহী ত্রাহী অবস্থা। সেখানে যদি পরিকল্পনার নামে বিপুল বরাদ্দ নিয়েও তার কোনো সুফল না মেলে তবে তা মেনে নেওয়া যায় না। হাতিরঝিলের পানি দূষণই শুধু নয়, এই ঝিলকে কেন্দ্র করে যে অসংখ্য খাবারের দোকান গড়ে উঠেছে তাদের ফেলে দেওয়া বর্জ্য, হাতিরঝিলে বেড়াতে আসা সৌন্দর্যপিপাসু মানুষের অসতর্কতায় ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের প্যাকেট, কোমল পানীয়ের বোতল, টিস্যুও ঝিলকে ক্রমশ মুমূর্ষু অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে। বায়ুদূষণে বারবার প্রথম সারিতে নাম উঠে আসা শহরে ‘ফুসফুস’ খ্যাত স্থানেই যদি এমন অবস্থা হয়, তবে অন্যান্য স্থানের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। আমরা হাতিরঝিলের সুস্থতার দাবি জানাই। হাতিরঝিলের যথাযথ চিকিৎসা দাবি করি। সেই সঙ্গে অযথা ও অপরিকল্পিত ব্যয়ের বিপক্ষেও আমাদের অবস্থান জানিয়ে বলি, নির্ধারিত সময়েই শুধু নয়, সারা বছরই হাতিরঝিলের পরিচর্যা করা হোক। বিশেষজ্ঞরা পানি শোধনের সঙ্গে হাতিরঝিলের প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন।
ঝিলের আশপাশের এলাকায় পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট গড়ে তোলার কথা তারা বলছেন। আমরাও বিষয়গুলো সংশ্লিষ্টদের ভাবতে বলি। হাতিরঝিল প্রকল্প যুক্তরাষ্ট্রের এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশনের (এডরা) ‘পরিসর পরিকল্পনা’ক্যাটাগরিতে ২০২০ সালে ‘গ্রেট প্লেস অ্যাওয়ার্ড ২০২০’ লাভ করেছিল। এক হাজার ৯৭১ কোটি টাকা ব্যয়ে মোট ৩০২ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই প্রকল্পটি কেন তার সুনাম ধরে রাখতে পারছে না, তাও ভাবার সময় এসেছে। সুস্থ নগর পরিবেশের প্রয়োজন থেকে তৈরি হাতিরঝিলের সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হোক তা আমরা চাই না। হাতিরঝিলকে যথাযথ পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে আমরা প্রকৃতিরই অংশ করে তোলার দাবি জানাই, যাতে সারা বছরই মানুষের আনাগোনায় রাজধানীর ‘ফুসফুস’ নগরবাসীর ফুসফুসকেও ভালো রাখে। পরিবেশ রক্ষা করতে হলে হাতিরঝিলকে বাঁচাতে হবে। এরও শুশ্রূষা করতে হবে। আমরা যদি পরিবেশের যত্ন করি, তবে পরিবেশও আমাদের যত্ন করবে। হাতিরঝিলের সঙ্গে সংযোগ থাকা যেসব এলাকা থেকে বৃষ্টির পানিসহ ময়লা পানি, পয়োবর্জ্য ও শিল্পবর্জ্য এসে ঝিলে পড়ে ঝিলের পানির মান নষ্ট করছে, সেই সীমাবদ্ধতা দূর করার ওপরও গুরুত্ব দেই।