ডেঙ্গু
ডা. মুশতাক হোসেন
প্রকাশ : ১৩ জুন ২০২৩ ১৫:০৯ পিএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
অকালে চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু, ইতোমধ্যে এমন শিরোনাম হয়েছে সংবাদমাধ্যমে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রাণহানিও ঘটেছে। মনে রাখা জরুরি, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রথম ও প্রধান পদক্ষেপ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া। এজন্য ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার বিস্তার রোধ করতে হবে। এডিস মশা যেন মানুষকে দংশন করতে না পারে, সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। যদি মশার দংশনে কারও সন্দেহ হয় তিনি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন, তবে দ্রুত রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে। হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসকরা ডেঙ্গু রোগীদের সেবা-শুশ্রূষার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু মূল সমস্যা হলো, আমরা এডিস মশা প্রতিহত করতে পারছি না। এডিস মশা যদি মানুষকে দংশন না করত তাহলে ডেঙ্গু প্রকটতার দিকে ধাবিত হতো না। এ ব্যাপারে একটি সামাজিক প্রতিরোধের ঘাটতি রয়েছে। কারণ মশক নিয়ন্ত্রণের জন্য যা যা করা দরকার, তা আমরা কেউ করছি না।
এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট
দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের তৎপরতার ঘাটতি যেমন রয়েছে তেমনি ব্যক্তি পরিসরেও এ ব্যাপারে
সচেতনতার অভাব আছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধকে যদি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত না করা যায় তাহলে
এর রাশ টানার সম্ভাবনা নেই। এডিস মশার বিস্তার ঠেকাতে শুধু কিছু কিছু জায়গায় কীটনাশক
ছড়িয়ে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যাবে না। সারা দেশেই এডিস মশার বিচরণক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।
শুধু শহর নয়, উপজেলা পর্যায়েও অনেক জায়গায় পানি জমে এডিস মশা জন্ম নেওয়ার ক্ষেত্র তৈরি
হচ্ছে। এ কথা সত্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করার জন্য সিটি করপোরেশন, ওয়ার্ড
কমিশনারসহ স্থানীয় সরকারের একাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু স্থানীয় মানুষ যদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার
বিষয়ে সচেতন না হন, তাহলে শুধু প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ডেঙ্গু বা সংক্রামক রোগ ঠেকানো কঠিন।
এক্ষেত্রে নেতৃত্বের মাধ্যমে মানুষকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
এভাবে আস্তে আস্তে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এবং কাজটি দীর্ঘমেয়াদি হতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদি করার জন্য এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখা অত্যন্ত জরুরি। সমস্যা হলো, নীতিনির্ধারকরা
ডেঙ্গু কিংবা অন্যান্য সংক্রামক রোগকে স্বাস্থ্য খাতের অস্থায়ী এবং জরুরি একটি অবস্থা
বলে মনে করেন। এমনটি না ভেবে সময় নিয়ে সামাজিকভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে সচেতনতা
তৈরি করতে হবে।
ডেঙ্গু বা অন্যান্য
সংক্রামক রোগ প্রতিবছরই আমাদের জন্য একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ ব্যাপারে নজর গভীর
করা চাই। ঢাকা তো বটেই, অন্য জেলা শহর এমনকি পার্বত্য অঞ্চলেও ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা
দিচ্ছে। অতীতে দেখা গেছে, আগের বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লেও পরের বছর তা অত বড় ঝুঁকি
হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে কারণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবে এডিস
মশা জন্ম নেওয়ার পরিসর বেড়েছে। শুধু তাই নয়, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা না থাকায় পানিবাহিত
অনেক সংক্রামক রোগও ছড়াচ্ছে দ্রুত, পরিবেশও পড়ছে হুমকির মুখে। এখানে জলবায়ু পরিবর্তন
একটি বড় কারণ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শীতকালে এডিস মশার ডিম ফোটার উপযুক্ত তাপমাত্রা
থাকে না। কিন্তু আবহাওয়া পরিবর্তন ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে শীতকালেও এডিস মশার ডিম
ফোটার উপযুক্ত তাপমাত্রা থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানবসৃষ্ট সমস্যা।
অতীতে দেখেছি
ডেঙ্গুর প্রকোপ যখন প্রথম ভয়াবহ রূপ নেয় তখন দেশে সমন্বিত উদ্যোগ দেখা গিয়েছিল। এর
ধারাবাহিকতা ধরে রাখা গেলে হয়তো এখন এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না। এমন উদ্যোগ
আবার শুরু করা গেলে এর সুফলভোগী হব আমরাই।
সরকার, সংশ্লিষ্ট
মন্ত্রণালয়, নীতিনির্ধারক, জনপ্রতিনিধিরা এবং মানুষের সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা
নিশ্চিত করতে পারলে আমরা ডেঙ্গু বা অন্য যেকোনো সংক্রামক রোগের ঝুঁকি থেকে দূরে থাকতে
পারব। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিলে উপযুক্ত তাপমাত্রা থাকলেও এডিস
মশার ডিম ফুটবে না। এখন সবাই প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করে। প্লাস্টিক বোতলজাত পানি পান
করে যেখানে সেখানে ফেলে দেওয়া হয়। প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার শহরেই হচ্ছে এমন নয়। এখন
পার্বত্য অঞ্চলেও অনেকে প্লাস্টিক বোতল যেখানে-সেখানে ছুড়ে ফেলছেন ব্যবহার শেষে। এর
ফলে এডিস মশা ডিম ফোটানোর উপযুক্ত পরিবেশ পাচ্ছে। ফলে ডেঙ্গু বিস্তারের পরিধিও বাড়ছে।
এ বিষয়ে আমাদের নিজেদের সচেতন হতে হবে এবং এডিস মশা ডিম ফোটানোর উপযুক্ত পরিবেশ যেন
না পায় তা দেখতে হবে।
ইতোমধ্যে করোনার
সংক্রমণও বাড়ছে। করোনার ক্ষেত্রে ঋতু পরিবর্তনের একটা প্রভাব দেখা যাচ্ছে। গ্রীষ্ম
আর বর্ষাকালে এই অঞ্চলে ইনফ্লুয়েঞ্জা বেড়ে যায়। এ সময় করোনার প্রকোপও বাড়তে দেখা যাচ্ছে।
ধারণা করা যায়Ñ জুন, জুলাই ও আগস্টে করোনা বাড়তির দিকেই থাকবে। করোনা প্রতিরোধে আমাদের
কী করণীয় তা সচেতন প্রত্যেকেরই জানা। এ বিষয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। তবে হাসপাতালগুলোকে
আরও সতর্ক অবস্থানে যেতে হবে। প্রথমত, মাস্ক না পরে কেউ হাসপাতালে ঢুকতে পারবে না।
এমনকি হাসপাতালে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সবাই যেন স্বাস্থ্যবিধি
অনুসরণ করে, তা নিশ্চিত করতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলো এ বিষয়ে যথেষ্ট তৎপর। সরকারি
হাসপাতালকেও এক্ষেত্রে বাড়তি গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের ফিরে যেতে হবে পুরোনো অভ্যাসে।
স্বাস্থ্য খাতে
ডেঙ্গু ও অন্যান্য সংক্রামক রোগ যখন চোখ রাঙাচ্ছে তখন আরেকটি বিষয় সঙ্গত কারণেই সামনে
উঠে আসে। প্রতিবছর স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের বিরাট একটি অংশ ফেরত পাঠানো হয়।
স্বাস্থ্য খাতে পরিচালন ব্যয় ও উন্নয়ন ব্যয়Ñ এই দুই ধরনের ব্যয় রয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের
সার্বিক চাহিদা বিবেচনায় বরাদ্দকৃত অর্থ ফেরত পাঠানোর বিষয়টি একটু অস্বাভাবিক। ২০২৩-২৪
অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাস্থ্য খাতে কি তবে
বরাদ্দের সুষম বণ্টন হচ্ছে না। স্বাস্থ্য খাতের চাহিদা বিবেচনায় বরাদ্দকৃত অর্থ আনুপাতিক
হারে বরং কম। কিন্তু যতটুকু বরাদ্দই দেওয়া হয়েছে এর সুষ্ঠু বণ্টন হয় নাÑ এ অভিযোগ নতুন
নয়। এখানে এক ধরনের শুভঙ্করের ফাঁকি রয়ে গেছে। বিষয়টা অনেকটা সারস পাখি ও শেয়ালের দাওয়াত
খাওয়ার মতো। সারস পাখিকে শেয়াল দাওয়াত দিয়ে খেতে দেয় প্লেটে। আর পরবর্তী সময়ে সারস
পাখি শেয়ালকে দাওয়াত দিয়ে ঝোল খেতে দেয় চোঙায়। বিষয়টি হলো, যাদের স্বাস্থ্য খাতে দায়িত্ব
দেওয়ার কথা তারা এখানে কাজ করার সুযোগ কোনো কোনো ক্ষেত্রে পান না। এমন একজনকে দায়িত্ব
দেওয়া হয় যিনি স্বাস্থ্য খাতের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত থাকেন না বিধায় ভয়ে খরচ করতে
পারেন না।
যারা স্বাস্থ্য
খাতের দায়িত্ব পালন করবেন তারা যেন বরাদ্দকৃত অর্থ সুষ্ঠুভাবে খরচ করতে পারেন সেজন্য
তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং কারিগরিভাবে তাদের দক্ষ করে তোলা জরুরি। এও তো অভিযোগ
রয়েছেÑ বছরের পর বছর অনভিজ্ঞ লোকদের এখানে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। কেউ যদি স্বাস্থ্য
খাতে বরাদ্দ ব্যবহারের সদিচ্ছা নিয়ে কর্মপরিকল্পনা করেন তাহলে তাকে অন্য জায়গায় বদলি
করে দেওয়ার একটি অপতৎপরতা দেখা যায়। একটি দুষ্টচক্রের কারণে স্বাস্থ্য খাতের দায়িত্বশীলরা
সঠিকভাবে কাজ পরিচালনা করতে পারছেন না। স্বাস্থ্য খাতে আরও অনেক বরাদ্দ প্রয়োজন, কিন্তু
তা দেওয়া হচ্ছে না। বরং যতটুকুই দেওয়া হচ্ছে তা যেন খরচ না করা যায়, তার জন্য দুষ্টচক্র
সক্রিয়Ñ এমন অভিযোগও উড়িয়ে দেওয়া যাবে কি না, তাও প্রশ্নের বিষয়। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের
সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে হলে অভিজ্ঞ ও যোগ্য লোকদের দায়িত্ব দেওয়া ছাড়া উপায়ান্তর নেই।
অন্য মন্ত্রণালয়ও খরচ করে। তারা কীভাবে করে? তাদের ব্যবস্থাপনা দক্ষ বলেই খরচ করতে
পারে। স্বাস্থ্য খাতের মতো জরুরি একটি খাতে বরাদ্দের সুষম বণ্টন ও ব্যবস্থাপনার অভাব
সত্যিই দুঃখজনক।
স্বাস্থ্য খাত
বরাদ্দের ওপর নির্ভর না করে স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়া
দরকার। হাসপাতালগুলো যদি নিজেরাই খরচ করতে পারে তাহলে কর্তৃপক্ষ দ্রুত যেকোনো সমস্যার
সমাধান করতে পারবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলো তো তাদের প্রয়োজন দ্রুত মিটিয়ে ফেলছে। কিন্তু
সরকারের প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কেন তা সম্ভব হবে না? সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান এখনও
নির্ভর করছে বরাদ্দের ওপর। চলতি বছর কোনো সমস্যা দেখা দিলে তাদের নির্ভর করতে হয় পরের
বছরের বাজেটের জন্য। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক
স্বায়ত্তশাসন দিলে এসব অনেকাংশেই সমস্যা থাকত না। শুধু তাই নয়, স্থানীয় প্রশাসন তদারকি
করলে সহজেই সুশাসন নিশ্চিত করা যাবে। স্বাস্থ্য খাতে ইতিবাচক ব্যবস্থাপনাগত পরিবর্তন
প্রয়োজন। আর সংক্রামক ব্যধি বা ডেঙ্গু প্রতিরোধের বিষয়টিকে নিয়ে যেতে হবে সামাজিক আন্দোলনের
পর্যায়ে। সমস্যার কারণগুলো চিহ্নিত, কিন্তু প্রতিকারের চিত্র প্রশ্নবিদ্ধ। জবাবদিহি
ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত হলেই অনেক নেতিবাচকতার নিরসন ঘটবে।