বিশ্ব নিরাপদ খাদ্য দিবস
স্মৃতি চক্রবর্ত্তী
প্রকাশ : ০৭ জুন ২০২৩ ০০:১৫ এএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
আজ ৭ জুন বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে নিরাপদ খাদ্য দিবস। প্রতিটি দিবস পালনের কিছু উদ্দেশ্য বা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে। সাধারণত মানুষকে সচেতন করা এর অন্যতম লক্ষ্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খাদ্যদ্রব্য নিয়ে অসাধুতা হয়ে থাকে। এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে বিশ্বব্যাপী নিরাপদ খাদ্য দিবস উদযাপন করা হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নিরাপদ খাদ্যদ্রব্য কিংবা ঝুঁকিমুক্ত খাদ্যপণ্যপ্রাপ্তি কতটা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে এর অনেক নজির আমাদের সামনে রয়েছে। জীবনধারণের জন্যই শুধু নয়, সুস্থতার জন্যও সুষম খাদ্য প্রয়োজন। কিন্তু ভেজালের রাজত্বে তা কঠিন। খাদ্যে ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করুনÑ এমন অনুরোধ সরকারকে হাইকোর্ট জানিয়েছিলেন ২০১৯ সালের মে মাসে। আদালত বলেন, ‘সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যেমন যুদ্ধ পরিচালনা করছে, তেমনি খাদ্যে ভেজালকারীদের বিরুদ্ধেও অভিযান পরিচালনা করতে সরকারের কাছে অনুরোধ রাখছি।’ আদালত আরও বলেন, ‘সরকারের নির্বাহী বিভাগের অগ্রাধিকার কাজ কী হবে তা হাইকোর্ট নির্ধারণ করে দিতে পারে না। তার পরও বলব, খাদ্যে ভেজাল রোধের বিষয়টিকে এক নম্বর অগ্রাধিকার দিয়েই কাজে নামা উচিত।’
এরপর কেটে গেছে প্রায় কয়েক বছর। কিন্তু
পরিস্থিতির
কি
কোনো
হেরফের
হয়েছে? এ যেন
অন্তহীন
প্রশ্ন। আমাদের আরও স্মরণে আছে, ওই বছরই হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ দুধ, দই ও দুগ্ধজাত খাদ্যপণ্যে ভেজাল মেশানোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামের তালিকা প্রকাশ করতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সময় বাড়ানোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলেন, ‘মানুষের
জীবন
নিয়ে
জুয়া
খেলতে
দেওয়া
হবে
না।’ মহামান্য আদালতের ওই পর্যবেক্ষণই স্পষ্ট করে দেয়Ñ খাদ্যপণ্য নিয়ে দেশে কী ভয়াবহ তুঘলকি কাণ্ড চলছে! অনিরাপদ খাদ্যদ্রব্য নিয়ে দেশে অনেকদিন ধরেই জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা চলছে। আমাদের
এও
মনে
আছে, খুব
দূর
অতীতের
ঘটনা
নয়; সংবাদমাধ্যমে
ভেজালের
ছড়াছড়ি
নিয়ে
যখন
ঝড়
উঠেছিল, তখন
একজন
ম্যাজিস্ট্রেট রোকনউদ্দৌলা
ভেজালের
বিরুদ্ধে
অভিযান
চালিয়ে
জনআস্থা
অর্জনের
পাশাপাশি
খাদ্যে
ভেজালকারীদের
অপতৎপরতা
অনেকটাই
বন্ধ
করতে
সক্ষম
হয়েছিলেন। শুধু খাদ্যপণ্যই নয়, জীবন রক্ষাকারী গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নকল ওষুধেরও ছড়াছড়ি জনমনে আতঙ্কের ছাপ ফেলেছিল। আমরা
সেই
দুর্বৃত্তায়নের
বৃত্ত
থেকে
মুক্ত
হয়েছি
কিংবা
জনস্বাস্থ্যের
জন্য
হুমকি
নয়, এমন
খাদ্যদ্রব্য
পাচ্ছি
তা
বলা
যাবে
না।
কারখানায়
উৎপাদিত, হাতে উৎপাদিত, কৃষিজ কিংবা
আমিষজাতীয় খাদ্যদ্রব্য কোনো
কিছুই ভেজালের বাইরে
নয়। সেই কবে ডিএল রায় (দ্বিজেন্দ্রলাল রায়) লিখেছিলেন,
‘কত কিছু খাই, ভস্ম আর ছাই।’
তাঁর বিখ্যাত এই গানের সঙ্গে
আমাদের বিদ্যমান বাস্তবতার
অমিল খুঁজে পাওয়া
ভার। খ্যাতিমান কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরও সেই কবে লিখেছিলেন, ‘আমার সন্তান
যেন থাকে দুধে
ভাতে।’ প্রযুক্তিগত প্রক্রিয়ার
উৎকর্ষের কারণে এখন দুধের উৎপাদন
ও সরবরাহে সনাতন
ব্যবস্থা পাল্টে আধুনিকায়নের
ছোঁয়া লেগেছে। কিন্তু
বিস্ময়কর হলেও সত্য, একই সঙ্গে
পাল্লা দিয়ে নিত্যনতুন
অপকৌশলে বেড়েছে অসাধুদের
লোভাতুর কর্মকাণ্ডও। অতি মুনাফার লোভে
জীবনকে ঝুঁকির মুখে
ঠেলে দিয়ে ব্যবসায়ী
নামক একশ্রেণির দুর্বৃত্তের
পকেট স্ফীত করার
অপ-প্রক্রিয়া কোন সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত
হতে পারে?
আমাদের
অজানা নয়,
জনস্বার্থে আদালতের অনেক
আদেশ কিংবা নির্দেশ
হেলাফেলায় পড়ে থাকে। নিশ্চয়ই
এর দায় দায়িত্বশীলরা
এড়াতে পারেন না। শর্ষের
মধ্যে যেমন ভূতের
আছরের প্রবাদটি আমাদের
সমাজে বহুল প্রচারিত, তেমনি দায়িত্বশীল
অনেকেরই অনিয়ম-অস্বচ্ছতা ও স্বেচ্ছাচারিতার নজিরও
আমাদের সামনে কম নেই। এমতাবস্থায়
সুফলের আশা দূরাশারই
নামান্তর। নিরাপদ খাদ্যদ্রব্যপ্রাপ্তির
নিশ্চয়তাকল্পে অনেক আগেই
দেশে আইন প্রণীত
হয়েছে। এই দণ্ডের
বিধানও আছে। ২০১৫
সালে গঠন করা হয় নিরাপদ
খাদ্য কর্তৃপক্ষ। এর সবকিছুরই উদ্দেশ্য, ভেজালকারীদের অপতৎপরতা
বন্ধ করা এবং একই সঙ্গে
নিরাপদ খাদ্যদ্রব্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত
করা। কিন্তু দুঃখজনক
হলেও সত্য,
এসবই যেন আটকে
আছে কিংবা আটকে
যায় দায়িত্বশীলদের যথাযথভাবে
দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার
কারণে। কিছুদিন আগে এক সমীক্ষায়
জানা যায়,
দেশে নানা ধরনের
রোগব্যাধি অনেক বেড়েছে
এবং এর পেছনে
অন্যতম কারণ ভেজাল
খাদ্যদ্রব্য।
সুশাসন, ন্যায়বিচার,
আইনের শাসন ইত্যাদি
সচেতন মানুষমাত্রই প্রত্যাশা
করেন। কিন্তু দুঃখজনক
হলেও সত্য,
স্বাধীনতা অর্জনের পর বায়ান্ন বছরেরও
বেশি সময় অতিক্রান্ত
হওয়ার পরও রক্তস্নাত
এই দেশে এগুলো
এখনও নড়বড়ে অবস্থায়
আছে। আস্থার জায়গা
যেন ক্রমেই সংকুচিত
হয়ে আসছে। নিরাপদ
খাদ্যদ্রব্য প্রাপ্তির বিষয়ে
আস্থার পারদ যেন নিম্নমুখী। মানুষের
জীবন নিয়ে যে অপতৎপরতা কিংবা
অতি মুনাফার লোভে
অনৈতিক কর্মকাণ্ড যেভাবে
চলছে, তা বন্ধ
করতে না পারলে
আমাদের ভবিষ্যৎচিত্র আরও কতটা ভয়ংকর
হয়ে উঠতে পারে
এর ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। সচেতন
মানুষ মাত্রই প্রত্যাশা
করেন, উচ্চারণসর্বস্ব প্রতিশ্রুতি
বর্জন করে দায়িত্বশীলরা
কাজে অধিক মনোযোগী
হবেন। সংবাদমাধ্যমেই জানা
গিয়েছিল, প্রাণঘাতী বিষেও
নাকি রয়েছে বিস্তর
ভেজাল।
খাদ্যদ্রব্যে
ভেজাল রোধ ও ভোক্তা অধিকার
রক্ষায় দিতে হবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব। আইন এবং দায়িত্বশীল
প্রতিষ্ঠান থাকার পরও ভেজাল ও মানহীন পণ্য
তৈরী ও বিক্রি
বন্ধ না হওয়ার
সংবাদ এগুলোর অস্তিত্বকেই
প্রশ্নবিদ্ধ করে। অসাধু
ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার
লোভে একদিকে খাদ্যপণ্যে
প্রাণঘাতী ভেজাল দিচ্ছেন, অন্যদিকে বিভিন্ন
সেবা প্রদানের ক্ষেত্রেও
অবাধে আশ্রয় নিচ্ছেন
প্রতারণার। দেশের বিপুল
সংখ্যক মানুষ রয়েছে
স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। এর দায় সংশ্লিষ্ট
দায়িত্বশীল কোনো পক্ষই
এড়াতে পারে না। বিশ্ব
খাদ্য সংস্থার তথ্য
অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বে
অন্তত ৬০ কোটি
মানুষ ভেজাল ও দূষিত খাদ্যদ্রব্যের
কারণে অসুস্থ হয়। আমাদের
দেশে তো প্রায়
সবকিছুই ভেজালে সয়লাব। এমন প্রেক্ষাপটে আমাদের
দেশে অসুস্থতার হার কত হতে পারে?
খাদ্যদ্রব্য নিয়ে ভেজালকারীদের অপতৎপরতার পথ যদি রুদ্ধ করা না যায়, তা হলে দেশ-জাতির সর্বনাশের পথ আরও বিস্তৃত হবে এবং স্বাস্থ্য খাত নিয়ে সরকারের সব প্রচেষ্টা ভেস্তে যাবে। খাদ্য-সন্ত্রাসীদের কিংবা অসাধু অর্থ উপার্জনকারীদের উৎসে নজর দিতে হব। অতি মুনাফাখোরদের হাত কোনোভাবেই আইনের হাতের চেয়ে লম্বা হতে পারে না। যারা সচেতনভাবে জীবনবিনাশী এমন অপকাণ্ডে লিপ্ত, তাদের জনশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। জীবনবিনাশী যে অপকাণ্ড দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে এর স্থায়ী প্রতিকার কিংবা প্রতিবিধান কেন নিশ্চিত করা যাচ্ছে নাÑ এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায়ও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কোনো পক্ষই এড়াতে পারে না। কঠোর প্রতিকারই একমাত্র প্রতিবিধান। খাদ্যে ভেজাল রোধ করে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার মাধ্যমে সুস্থ-সবল-কর্মঠ পরিশ্রমী প্রজন্ম গড়ে তোলার পথ মসৃণ করতেই হবে। এই দায় রাষ্ট্রের। সুস্থ-সবল প্রজন্মই জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে উড়াবে গাণ্ডিব, পাহাড় নামাবে পায়ের কাছে।