× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বানিয়াচংয়ে সালিশে জুলুম

এখনো রয়ে গেল আঁধার

লোপা মমতাজ

প্রকাশ : ০৬ জুন ২০২৩ ১২:৩৮ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

কৈশোরে গ্রামীণ আবহভিত্তিক সিনেমায় প্রায়শই কিছু দৃশ্য চোখে পড়ত। তার মধ্যে একটি হলোÑ গঞ্জের একটি বটগাছের নিচে গ্রামের কতিপয় ময়মুরব্বি মাতব্বরকে সঙ্গে নিয়ে কোনো একটি বিচারকার্য সম্পাদন করছেন। আগে গ্রামগুলোতে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে কিংবা দুই পরিবারের মধ্যে কোনো বিষয়ে বিবাদ বা ঝগড়া হলে কোট-কাছারি না করে আপসে মীমাংসা করাই ছিল রেওয়াজ। এই কাজটি করত গ্রাম পঞ্চায়েত কমিটি। গ্রামবাংলার বিরোধ-মীমাংসার এটি একটি প্রাচীনতম পদ্ধতি। তবে এখন আর এমন দৃশ্য খুব একটা চোখে পড়ে না। সময় পরিবর্তিত হয়েছে। অনুন্নত দেশ থেকে স্বল্পোন্নত, স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হচ্ছে এ দেশ। আমাদের শৈশবের গ্রামগুলোতেও পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। গ্রামের সঙ্গে গ্রামীণ সালিশির ধরনও পাল্টেছে। এখন কথায় কথায় মানুষকে কোট-কাছারির দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। গ্রাম পঞ্চায়েতের মাধ্যমে আর সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। এসব নেতিবাচক খবর পড়তে পড়তে তখন হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়।

গ্রাম্য সালিশি বিচারব্যবস্থা আমাদের পূর্বপুরুষের আমলেও ছিল, বর্তমানেও আছে। তবে কিছু ভিন্নতা স্পষ্ট। তখন বিচারকার্যে যথেষ্ট সততা ছিল। তাই অধিকাংশ মানুষই ন্যায়বিচার পেত। বিচারকরা এখান এক কথা, আবার একটু পরে আরেক রকম কথা বলতেন না। কারও মুখের দিকে চেয়ে তাদের বিচারকার্য পরিচালনা করতে হতো না। কোনো ক্ষমতার দাপটকেও ভয় পেতেন না। আবার অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে বিক্রিও হয়ে যেতেন না তারা। দিনে দিনে সেই গ্রাম্য সালিশি ব্যবস্থায় এখন ঢুকে পড়েছে পক্ষপাতিত্ব, রাজনীতি ও অবৈধ অর্থের লেনদেন। কিছু ক্ষেত্রে গ্রাম আদালতেও চলছে বিচারের নামে প্রহসন। ধর্ষণের মতো ঘটনাও ভিন্ন খাতে নেওয়া হচ্ছে। ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে ফৌজদারি অপরাধও। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারন মানুষ। বেড়ে যাচ্ছে অপরাধের মাত্রা।

২ জুন প্রতিদিনের বাংলাদেশের দেশজুড়ে পাতায় একটা প্রতিবেদন দৃষ্টি কেড়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, হবিগঞ্জের বানিয়াচং গ্রামে ৪টি পরিবারকে আড়াই বছর ধরে সমাজচ্যুত করে রাখা হয়েছে। ওই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এলাকার কেউ কথা বলছে না। কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণও করছে না। ভুক্তভোগী আলফুজুর রহমান বলছেন, একটি বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণকালে জোরপূর্বক ভূমিদখলে বাধা দেওয়ায় তাদের সমাজচ্যুত করা হয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, ২০২১ সালে নতুন ভবন নির্মাণ করার প্রয়োজনে আরও কিছু ভূমির প্রয়োজন হলে তিনি ১ হাত পরিমাণ জমি দিতে চান; তবে বিদ্যালয় কমিটি আরও বেশি পরিমাণ জমি নিতে চাইলে তিনি বাধা দেন। এ নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হলে সালিশ বসে। সেখানে পঞ্চায়েত কমিটি থেকে তাকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয় এবং তার তিন ভাইয়ের পরিবারকে একঘরে করার রায় দেওয়া হয়।

অনেক আগের একটা গ্রাম সালিশির কথা মনে পড়ল। ঘটনাটা এ রকমÑ দিন আনে দিন খায় এমন একটি পরিবার এক গ্রামে থাকত। সেখানে তার প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে ২৫ হাজার টাকা চুরি হয়। সেই টাকা উদ্ধারের জন্য আরেক গ্রাম থেকে এক কবিরাজকে এই গ্রামে নিয়ে আসা হয়। তিন দফায় বাটি চালান দিয়ে সেই কবিরাজ বাটিসমেত ওই দরিদ্র পরিবারে উঠানে ওঠে। এ নিয়ে সালিশ বসে। এই সালিশে কবিরাজের কথামতো ওই পরিবারের কিশোর ছেলেটাকে চোর সাব্যস্ত করে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানার টাকা তিন দিনের মধ্যে পরিশোধের নির্দেশ দেন গ্রাম পঞ্চায়েতরা। পরিবারটি এতই দরিদ্র ছিল যে, জরিমানা করা ৫০ হাজার টাকা তারা দিতে পারেনি। তার ফলস্বরূপ একঘরে করা দেওয়া হয় পরিবারটিকে। সেই সঙ্গে সামাজিক লাঞ্ছনা তো ছিলই। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, এই সময়ে দাঁড়িয়ে বাটি চালানের মতো একটা ধোঁকাবাজিকে বিশ্বাস করে কিছু মানুষ কূপমণ্ডূকতায় ডুবে আছে!

১৯৯২ সালের ১০ জানুয়ারি কমলগঞ্জের  পাহাড় ঘেরা ছাতকছড়ায় গ্রাম্য সালিশে নুরজাহানের উদ্দেশ্যে অবৈধ ফতোয়ার কথা আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাই নি।  নূরজাহানকে কোমর সমান মাটির গর্তে পুঁতে ১০১টি পাথর ছুড়ে মারা মারা হয়েছিল। এ অপমান সইতে না পেরে শেষমেষ মেয়েটি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। আরও একটি দৈনিকে পড়লাম, একটি গ্রাম্য সালিশি বৈঠকে ধর্ষিতার সঙ্গে ধর্ষকের বিয়ে পড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। ওদিকে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও ভিডিওধারণের পর ইউপি সদস্যের কাছে বিচার চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিচার না পেয়ে উল্টো ভয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন সেই নারী। অবশেষে ৩২ দিন পর নির্যাতনের ভিডিও প্রকাশের পর বিক্ষোভে ফেটে পড়ে দেশবাসী। গ্রেপ্তার হয় অভিযুক্তরা। লালমনিরহাটের কালীগঞ্জে কিশোরীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তের কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে স্থানীয় মাতবরদের বিরুদ্ধে। এ রকম বহু ঘটনা সমাজপতিরা ঘটিয়ে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। তারা নির্যাতনকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

দেখা যাচ্ছে গ্রাম্য সালিশি ব্যবস্থায় পক্ষপাতিত্ব, রাজনীতি ও অবৈধ অর্থের লেনদেন ঢুকে পড়েছে। যার ফলে অপরাধ করেও অর্থের প্রভাবে ক্ষমা পেয়ে যাচ্ছেন অপরাধীরা। বর্তমান সময়ে গ্রাম্য রাজনীতির ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকে। আবার অনেককে গ্রাম পর্যন্ত ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। ক্ষমতার দাপটে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন এলাকার গণ্যমান্য প্রবীণরাও। কেউ প্রতিবাদ করতে গেলেই উল্টো বিপদে পড়ছেন। নিরীহ মানুষ শিকার হন ভোগান্তির। গ্রাম্য সালিশচক্রে এলাকার ক্ষমতাসীনরা প্রভাব বিস্তার করে। অনেক ক্ষেত্রে সালিশের নামে ফতোয়া প্রদানের কারণে নতুন করে সামাজিক বিবাদ সৃষ্টি হচ্ছে। এমনকি নির্যাতনের ঘটনাও ঘটছে।

এই সালিশ ব্যবস্থাকে যথাযথভাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারলে সামাজিক দুর্বৃত্তায়ন নির্মূল ও শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। গ্রামের মানুষের আদালতে যাওয়ার বিকল্প হচ্ছে এই সালিশ। কিন্তু এখানেও শোনা যাচ্ছে দুর্নীতির কথা। তা হলে সমাধান কোথায়? সুশাসনের জন্য প্রয়োজন সচেতনতা, প্রয়োজন নিরপেক্ষতা এবং সততা। প্রবীণ ব্যক্তিদের পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত যুবকদেরও এখানে সম্পৃক্ত করতে হবে। ন্যায়বিচার হচ্ছে কি না তার জন্য জেলা পর্যায়েও কাউন্সিল থাকা দরকার। এ ছাড়া গ্রাম আদালত পর্যবেক্ষণের জন্য বিচার বিভাগের একটি শাখা থাকা প্রয়োজন। এসব বিচারকার্য যারা পরিচালনা করেন, তাদের এ বিষয়ে যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করতে হবে। সাধারন মানুষ ন্যায়বিচার পেলে গ্রাম আদালতের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়বে। স্থানীয় বিরোধ মেটাতে গ্রাম আদালত কার্যকর ভূমিকা পালন করলে এবং নিষ্ক্রিয় আদালতগুলো সম্পূর্নরুপে সক্রিয় হলে মামলাজট কিছুটা হলেও কমবে। ফলে গ্রামের মানুষ বিচারের নামে দুর্ভোগ থেকে রেহাই পাবে এবং সমাজ থেকে অপরাধ প্রবনতাও কমবে। তবে গ্রাম আদালতের সিদ্ধান্তগুলো নিরপেক্ষ ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে  হবে।

 

§ লেখক ও সাংবাদিক

 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা