সম্পাদকীয়
সম্পাদক
প্রকাশ : ০৩ জুন ২০২৩ ১৪:০৫ পিএম
অলঙ্করন: জয়ন্ত জন
বিদ্যমান বৈশ্বিক
বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে নানামুখী সংকটের ছায়া, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট প্রায়
সর্বব্যাপী দৃশ্যমান। আমরাও এর বাইরে নই। এমন বাস্তবতায় ১ জুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয়
বাজেট অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে পেশ করেছেন। ‘উন্নয়নের অভিযাত্রার দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট
বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা’ শিরোনামে নতুন অর্থবছরের যে বাজেট উপস্থাপিত হয়েছে, তাকে অনেকেই
উচ্চাভিলাষী, স্বপ্নে মোড়া শর্তে ভরা শঙ্কা ঘেরা, কঠিন সময়ে আরও অস্বস্তি, বিশেষ সময়ে
সাধারণ বাজেট ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত করেছেন। বড় আশা, বাস্তবায়ন কঠিনÑ শিরোনামে প্রতিদিনের
বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত শীর্ষ প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, ‘সাহস করে ঝুঁকি নিলেন অর্থমন্ত্রী’।
আমরা দেখছি, সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার মোট বাজেটে ঘাটতি দেখানো হয়েছে দুই লাখ
৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। অঙ্কের হিসাবে এই ঘাটতি বিপুল বললে অত্যুক্তি হয় না। ঘাটতি
নিরসনের লক্ষ্যে যেসব উৎস থেকে অর্থপ্রাপ্তির আশা ব্যক্ত করা হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে
বড় চ্যালেঞ্জ। বাজেট প্রণয়ন আর যথাযথভাবে বাস্তবায়ন নিশ্চয়ই এক কথা নয়।
আমরা জানি, গত
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক কিছু জটিল কারণে বিশ্ব অর্থনীতি তো বটেই,
আমাদের জাতীয় অর্থনীতিও ব্যাপক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আসছে। কিন্তু এর প্রতিফলন বাজেটে
কতটা প্রতিফলিত হয়েছে, এ নিয়ে প্রশ্ন আছে। প্রস্তাবিত বাজেটের আকার সংশোধিত বাজেটের
তুলনায় জিডিপির অনুসারে যেটুকু বৃদ্ধি পেয়েছে, প্রশ্ন আছে এ নিয়েও। রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা
অর্জনের অভিজ্ঞতা আমাদের প্রীতিকর না হলেও উপস্থাপিত বাজেটে এ ব্যাপারে ফের যে লক্ষ্য
ধার্য করা হয়েছে, এ নিয়েও নানা মহল থেকে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে।
স্মরণ করি খ্যাতিমান
মার্কিন লেখক, অধ্যাপক ও একাধারে আত্ম-উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণে অনুপ্রেরণা দানকারী ডেল
ব্যাকেনরিজ কার্নেগি যিনি বিশ্বব্যাপী ডেল কার্নেগি নামে পরিচিত, তার একটি মন্তব্য।
তিনি সেই কবে বলেছিলেন, ‘যার কথার চেয়ে কাজের পরিমাণ বেশি, সাফল্য তার কাছেই এসে ধরা
দেয়। কারণ যে নদী যত গভীর তার বয়ে যাওয়ার শব্দ তত কম।’ বিশ্বখ্যাত এই মনীষীর বক্তব্য
চিরকালীন প্রাসঙ্গিক সত্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আমরা দেখেছি, প্রাক-বাজেট বিভিন্ন
আলোচনা, সেমিনার কিংবা সংবাদমাধ্যমে অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিশ্লেষকরা বাস্তবতার নিরিখে
বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে তাদের তাদের পরামর্শ উপস্থাপন করেছিলেন। প্রস্তাবিত বাজেটে
এর প্রতিফলন কতটা ঘটেছে, তাও আলোচনার বাইরে নয়। কল্পনা, ইচ্ছাশক্তি কিংবা স্বপ্ন নিঃসন্দেহে
জয় কিংবা সাফল্যের স্তম্ভ রচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রেক্ষাপটে আমরা বলতে চাই,
উচ্চাভিলাষ কোনো কোনো ক্ষেত্রে দোষের কিছু নয়, কিন্তু এই উচ্চাভিলাষ বাস্তবতা এড়িয়ে
পোষণ করলে এর বাস্তবায়ন অনেক ক্ষেত্রেই দুরূহ হয়ে পড়ে এবং এমন নজির আমাদের সামনে অনেক
আছেও।
‘স্মার্ট বাংলাদেশ’
গড়ার প্রত্যয় সরকারের রয়েছে এবং এর নিরিখে প্রস্তাবিত বাজেটে আলোকপাত করা হয়েছে। বিদ্যমান
বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশেষভাবে দৃষ্টিগ্রাহ্য। বিভিন্ন কারণে
আন্তর্জাতিক মহলের কাছে সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ছে। এমন বাস্তবতায় স্মার্ট
বাংলাদেশ কিংবা ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জন পরিকল্পনা সাধুবাদযোগ্য।
কিন্তু উন্নত বাংলাদেশ কিংবা স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের পরিকল্পনা স্বপ্নের বৃত্তবন্দি
থাকলে চলবে না। বাস্তবানুগ পদক্ষেপই লক্ষ্য অর্জনের মুখ্য উপায়। আমরা জানি, চলমান মূল্যস্ফীতি
প্রকৃত অর্থেই দেশের মানুষের সামনে কঠিন পরিস্থিতি জিইয়ে রেখেছে। প্রস্তাবিত বাজেটে
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের বিষয়ে কিছু না বলা হলেও তা ৬ শতাংশের
মধ্যে রাখার অঙ্গীকার করা হয়েছে। জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন খাতে বরাদ্দের সুষম ব্যবহারের
ক্ষেত্রেও পরিকল্পিত ছক উপস্থাপিত হয়নি বটে, তবে বাজেটে আমরা এসব বিষয়েও আশার ক্ষেত্র
বিস্তৃত হতে দেখেছি।
আমরা জানি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সামাজিক
সুরক্ষায় বরাদ্দের যথাযথ বণ্টন কিংবা স্বচ্ছতার নিরিখে ব্যবহার নিয়ে অতীতে অনেক প্রশ্ন
উঠেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বৈষম্যের চিত্র ক্রমেই স্ফীত হচ্ছে
এবং আর্থিক খাতে নানারকম বিশৃঙ্খলার বিষয়গুলোও দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এমন প্রেক্ষাপটে
বাজেট বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ জয়ের জন্য লক্ষ্য নির্দিষ্ট করে অগ্রভাগে রেখে এগোতে হবে।
টিআইএনধারীদের ন্যূনতম দুই হাজার টাকা কর দেওয়ার যে বিধান প্রস্তাবিত বাজেটে রাখা হয়েছে,
তা সীমিত আয়ের নাগরিকদের ওপর ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’র শামিল বলে আমরা মনে করি। দেশীয়
শিল্প সুরক্ষার পাশাপাশি বিনিয়োগের পথ মসৃণ করাসহ সাধারণ মানুষের জীবনযাপন নির্বিঘ্ন
করা এবং সুশাসন নিশ্চিতকল্পে মনোযোগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। আমরা আশা করি, প্রস্তাবিত
বাজেটের ওপর জাতীয় সংসদে যে আলোচনা হবে এবং বিশেষজ্ঞরা যে পরামর্শ উপস্থাপন করবেন,
সেসব আমলে নিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেটকে সংশোধন করে প্রকৃতই জনবান্ধব করার প্রচেষ্টা
অব্যাহত থাকবে।