× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

উপসম্পাদকীয়

উদ্যোগী বাজেটের প্রত্যাশা অপূর্ণই রয়ে গেল

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

প্রকাশ : ০৩ জুন ২০২৩ ১৪:০১ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

বৈশ্বিক মন্দা ও অর্থনীতির নানা চ্যালেঞ্জের কথা মাথায় রেখে একটি বিশেষ উদ্যোগী বাজেট পরিকল্পনা ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু ১ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী যে বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন তাকে বিশেষ বলা যাবে না। ইতোমধ্যে আমাদের অর্থনীতির জন্য নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। সামনে অর্থনীতি মন্থর হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমন সময়ে ‘বড় আশা’র বাজেট নয়, বরং এই সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা দূর করার বাজেট পরিকল্পনা করা উচিত ছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন অর্থমন্ত্রী। শুধু তা-ই নয়, কণ্টকাকীর্ণ পথ মাড়িয়ে বর্তমানের সাড়ে ৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে সাড়ে ৭ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার বড় আশাও দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ মূল্যস্ফীতিকে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার দুরূহ সংকল্পও প্রকাশ করেছেন। বাজেটে রাজস্ব আদায়ের কিছু কিছু প্রস্তাব হয়তো সীমিত আকারে কার্যকর ফল দেবে। কিন্তু সার্বিক বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের সম্ভাবনা ক্ষীণ। প্রত্যাশা ছিল, এই বাজেটে অর্থনৈতিক খাতকে সুসংহত, সমন্বিত এবং বরাদ্দের বণ্টনের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখার বিষয়ে জোর দেওয়া হবে। এ রকম বিশেষ উদ্যোগী বাজেট পরিকল্পনা প্রত্যাশিত হলেও তা হয়নি।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে কৃষি খাতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। বিষয়টি বিস্ময়কর এবং অসমর্থনযোগ্য। বাজেট প্রস্তাবের আগে থেকেই বলা হচ্ছিল অবকাঠামো ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বেশি জোর দেওয়া হবে। কিন্তু সামগ্রিক অর্থনীতিকে এড়িয়ে এ দুটোর উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিশেষত কৃষিনির্ভর দেশ হওয়ায় আমাদের এখন কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি বরাদ্দকৃত অর্থের সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করার বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষি খাতে অবশ্য ভর্তুকি থাকবে, যদিও আইএমএফ বলেছে কৃষি খাতে ভর্তুকি কমাতে। তাদের সব কথাই আমাদের শুনতে হবে এর কোনো মানে নেই। কৃষি খাতে বরাদ্দ কমলে গবেষণা কার্যক্রম কমবে। বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের আশঙ্কার ছায়া যখন ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে তখন এ খাতে গবেষণা, উপকরণ, কৃষকের কাছে চাষের প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ এবং জলবায়ু সংকটের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় প্রযুক্তিগত সহায়তা বাড়ানো জরুরি। অথচ এ খাতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে এর ব্যাখ্যা পাওয়া গেল না স্পষ্টভাবে। বিষয়টি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এমনকি জ্বালানি খাতেও ভর্তুকি কমানো যাবে না। মনে রাখতে হবে, জ্বালানি কোনো বিলাসদ্রব্য নয়। আমাদের যাপিত জীবন সঙ্গে জ্বালানি জড়িত। পুরো বিশ্বে জ্বালানির মূল্য সমন্বয় করা হয়। আমাদের এখানেও সমন্বয়ের মাধ্যমে জ্বালানির মূল্য সহনশীল পর্যায়ে রাখার বিষয়ে পরিকল্পনা নির্ধারণ করতে হবে। বরাদ্দের অঙ্ক তো মূলত এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের একটি আর্থিক রূপরেখা দেয় মাত্র। সে জন্য সমাধানের কথাও বাজেট মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ভাবতে হয়।

প্রস্তাবিত বাজেটে বাড়ছে করের চাপ। জিডিপির অনুপাতে করের পরিমাণ বাড়ানো স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে প্রত্যক্ষ করের ওপর বেশি মনোযোগ দিতে হবে। অথচ বাজেটে পরোক্ষ করের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এমনটি ঠিক নয়। পরোক্ষ কর আদায়ের প্রভাব সব শ্রেণির ক্ষেত্রে সমানভাবে পড়ে। পরোক্ষ কর বাড়লে বিত্তবান কেউ যে কর দেন, একজন দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা ব্যক্তিকেও একই কর দিতে হয়। ফলে করের পরিমাণ শ্রেণিভেদে এক থাকলেও এর প্রভাব হয় ভিন্ন। তা ছাড়া পরোক্ষ কর আদায়ের ফলে ক্ষুদ্র শিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কারণ তাকে ব্যবসার জন্য ঋণ নিতে হয়, তা ছাড়া ব্যবসা পরিচালনার জন্য নানাক্ষেত্রে কর দিতে হয় এবং এত করের চাপে উদ্যোক্তার উদ্যোগ নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়। আয়করের দিকে একবার তাকানো যাক। আগে তিন কোটি টাকার সম্পদ থাকলে কাউকে আয়কর দিতে হতো আর এখন চার কোটি টাকার সম্পদ যাদের আছে, তাদের কাছ থেকে কর নেওয়া হবে। অর্থাৎ এখানে ছাড় দেওয়া হয়েছে। এমন সামঞ্জস্যহীনভাবে কর আদায়ের পরিকল্পনা ভালো ফলাফল এনে দিতে পারে না। প্রত্যাশা ছিল, পরোক্ষ করের বদলে প্রত্যক্ষ কর আদায়ে প্রস্তাবিত বাজেটে জোর দেওয়া হবে বেশি। এতদিন পরোক্ষ কর আদায় হচ্ছিল বেশি। তেমনটি হয়নি।

প্রস্তাবিত বাজেটে ট্যাক্স রিটার্নের জন্য ২ হাজার টাকা কর আদায়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। অনেক সেবা ও রাষ্ট্রীয় সুযোগসুবিধার জন্য টিন সার্টিফিকেট প্রয়োজন হয়। কারও টিন সার্টিফিকেট থাকলে সে আর্থিকভাবে সচ্ছল কিংবা তার নির্দিষ্ট আয় আছে এমনটি ভাবার কারণ নেই। প্রস্তাবিত বাজেটে এ ব্যাপারে যে প্রস্তাব করা হয়েছে এর ফলে অনেকেই রিটার্ন জমা দেওয়া থেকে বিরত থাকবে। কারও যদি আয় নাও থাকে, তাকেও এখন কর দিতে হবে। এমনটি পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। বলা যায়, বাজেটে এমন প্রস্তাব নাগরিক স্বার্থের ক্ষেত্রেও স্ববিরোধী। বৈশ্বিক মন্দার এই সময়ে কর আদায়ের পরিসর বাড়ানোর জন্য উদ্যোগী পরিকল্পনা প্রয়োজন ছিল। মানুষ যাতে কর দিতে উৎসাহী হয় এবং কর দেওয়ার প্রক্রিয়া তার জন্য সহনশীল থাকেÑ এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়াটাই ছিল যুক্তিসঙ্গত। অথচ মানুষের ওপর সাংঘর্ষিক করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেশে ৮০-৮৭ লাখ মানুষের টিন সার্টিফিকেট রয়েছে। এদের মধ্যে ৩৫ লাখ মানুষ ট্যাক্স রিটার্ন দেয়। বাকি ৫০ লাখ মানুষকে কীভাবে ট্যাক্স রিটার্নের আওতায় আনা হবে তা স্পষ্ট নয়। যদিও বলা হচ্ছে, সার্ভে করার মাধ্যমে শনাক্ত করা হবে। কিন্তু এমন জটিল পথে না গিয়ে কীভাবে আরও ৩০ লাখ করদাতা বাড়ানো যায়, সে জন্য পরিকল্পনা করা জরুরি ছিল। করদাতা বাড়লে রাজস্ব আদায়ও বাড়ত। তখন এভাবে নানা কায়দায় পরোক্ষ কর বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ত না।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আদায়ের উচ্চাবিলাসী পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। রাজস্ব আদায়ের জন্য বিভিন্ন খাতে নানাভাবে কর আদায়ের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। যেখানে মনে হয়েছে বাড়ানো যায়, সেখানেই কর বাড়িয়ে আদায়ের চেষ্টা করা হয়েছে। এমনটি সচরাচর কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যয় সমন্বয়ের জন্য করে থাকে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বাজেটে এমন কিছু করার অবকাশ নেই। অর্থমন্ত্রী যে বাজেট উপস্থাপন করেছেন এ নিয়ে নেতিবাচক কথাই বেশি শোনা যাচ্ছে। কারণ বাজেটে প্রত্যেকটি পরিকল্পনার মধ্যে সংযোগ রয়েছে। বাজেটে ব্যক্তি বিনিয়োগ উৎসাহিত করা হচ্ছে। আবার বাজেটের ঘাটতি মেটানোর জন্য অভ্যন্তরীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এমন পরিকল্পনা সাংঘর্ষিক। কারণ অভ্যন্তরীণ ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিলে ব্যক্তি ঋণপ্রবাহ কমবে। ব্যক্তি বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ২৭ দশমিক ৪। অথচ বাজেটের ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হবে। এক পরিকল্পনার সঙ্গে অন্য পরিকল্পনার কোনো সামঞ্জস্য নেই।

প্রস্তাবিত বাজেটের সবচেয়ে বড় দুই লক্ষ্যমাত্রা হলোÑপ্রবৃদ্ধির হার বাড়ানো এবং মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা। এই লক্ষ্যমাত্রা কীভাবে অর্জিত হবে তা বোধগম্য নয়। বাজারে মূল্যস্ফীতি এখন ৮-৯ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। মূল্যস্ফীতি তখনই হয় যখন বাজারে পণ্যের সরবরাহ থাকে না। সে জন্য দেশের অভ্যন্তরে খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা, পণ্য উৎপাদন ও বিপণনের বিষয়ে জোর দিতে হয়। বিশেষত মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পে প্রণোদনা বাড়িয়ে উৎপাদনের চাকা সচল রাখলে অর্থনীতি গতিশীল থাকে। অথচ এক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপই নেই। এখনও আমরা অনেক পণ্য আমদানি করি। এক্ষেত্রে যেসব পণ্য আমাদের প্রয়োজন নেই, সে সব পণ্য আমদানি বন্ধ করতে হবে। একেবারে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করাই এই মুহূর্তে বিবেচনাপ্রসূত হবে। পাশাপাশি রপ্তানি ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পরিসর বাড়াতে হবে। সম্প্রতি আমাদের প্রবাসী আয়, রপ্তানি আয় কমেছে। এমনকি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমতে শুরু করেছে। এখন সরকার যদি বাজেট ঘাটতি মেটাতে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে যায়, তা হলে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ার শঙ্কা আরও বাড়বে। কারণ ঋণ দেওয়ার জন্য নতুন করে ব্যাংক নোট ছাপতে হবে। এমনিতেই বাংলাদেশ ব্যাংক তেরো হাজার নতুন ব্যাংক নোট ছাপিয়েছে। এভাবে মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে গেলে মুদ্রার মান কমে যাবে।

সর্বোপরি, মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। অন্তত বাস্তব পরিস্থিতি আমাদের এ কথাই বলে। এমনকি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন করা সম্ভব নয়। আচমকা প্রবৃদ্ধি দ্বিগুণ করার কোনো সুযোগ নেই। এ জন্য একটি নিখুঁত পরিকল্পনা রাখা জরুরি। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্থনীতিকে গতিশীল ও সুসংহত করতে হবে। শিল্প খাত শক্তিশালী করতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। তা হলে প্রবৃদ্ধি অর্জন কীভাবে সম্ভব? এমতাবস্থায় কি ধরে নিতে হবে সেবা খাত থেকে আয় বাড়ানো হবে? স্বাস্থ্য খাত থেকে রাজস্ব বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হবে? সম্ভাবনার ওপর ভিত্তি করে তো প্রবৃদ্ধি বাড়বে না। ভ্রমণ, বিলাসদ্রব্য বা বিভিন্ন পণ্যে কর আরোপ করলে এসব খাতের পরিসর বাড়বে না। কারণ অনেকেই বাড়তি করের ভয়ে পিছিয়ে যাবে। তা হলে প্রবৃদ্ধি আসবে কীভাবে? দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রস্তাবিত বাজেটে এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই। আমি মনে করি, এখনও সময় আছে। বাজেটে অসামঞ্জস্যের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে একটি উদ্যোগী বাজেট পরিকল্পনা হবে। বাজেট প্রকৃতই কতটা জনবান্ধব করা গেলো এর উপর নির্ভর করবে সুফল। সুশাসনের বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। সুশাসন নিশ্চিত না হলে অনেক আশাই দুরাশা হয়ে থাকবে। সময়টা খুব কঠিন এটি দায়িত্বশীলরা যেন ভুলে না যান।


  • অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা