× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

উপসম্পাদকীয়

গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত সুদানে বাংলাদেশী শ্রমিকরা বিপন্ন

ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ

প্রকাশ : ৩০ মে ২০২৩ ১৩:৩৯ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

২৬ মার্চ ১৯৯৩ সাল। আমেরিকার ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় দক্ষিণ আমেরিকার ফ্রিল্যান্স ফটো সাংবাদিক ক্যাভিন কার্টারের (১৯৬০-১৯৯৪) তোলা একটি ছবি ছাপা হয়। ছবিটি তোলা হয়েছিল গৃহযুদ্ধ জর্জরিত সুদানের আয়দ অঞ্চলে। কার্টার কয়েকজন জাতিসংঘ কর্মীর সঙ্গে সেখানে গিয়েছিলেন জাতিসংঘ পরিচালিত ফুড সেন্টার বা লঙ্গরখানা থেকে ক্ষুধার্ত মানুষের মাঝে খাদ্য বিতরণের ছবি তুলতে। এমন সময় তার নজরে পড়ল একটি শিশু কোনো মতে তার কঙ্কালসার দেহটা টেনে টেনে এগিয়ে চলেছে লঙ্গরখানার দিকে। কিন্তু লংগরখানায় পৌঁছার আগেই সে মাটিতে পড়ে যায়। দুর্বল ও হাড্ডিসার দেহটি নিয়ে সামনে যাওয়ার শক্তিও তার শরীরে ছিল না। এ সময় আকাশ থেকে একটি শকুন শিশুটির কাছে এসে নামল এবং এক পা দুই পা করে ধীরে ধীরে শিশুটির কাছে এগোতে থাকল। বোঝাই যাচ্ছিল শকুনটি শিশুটির মৃত্যুর ক্ষণ গুনছে আর মৃত শিশুর দেহ খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

কঙ্কালসার শিশু ও শকুনের ছবি একই ফ্রেমে বন্দি করেন চিত্র সাংবাদিক কার্টার, যা ১৯৯৩ সালের ২৬ মার্চ ছাপা হয় ও পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৪ সালে পুলিৎজার পুরস্কার পায় । তবে শিশুটির পরবর্তী পরিণতি বলতে পারেননি কার্টার। কারণ গৃহযুদ্ধের উত্তাপ ও নিরাপত্তা স্বল্পতার কারণে জাতিসংঘের অন্য সব কর্মীর সঙ্গে কার্টারকেও জাতিসংঘের ছোট্ট একটি বিমানে সেই এলাকা দ্রুত ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। কার্টার আসার আগে শকুনটিকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন বলে দাবি করেন। তবে কিছুদিনের মধ্যে একটি হৃদয়বিদারক চিঠি (সুইসাইডাল নোট) লিখে আত্মহত্যা করে তিনি এক নতুন রহস্যের জন্ম দেন। ২০১১ সালে জানা যায় সেই হতভাগ্য শিশুটি ছিল কং নাই অঙ্গ নামের একটি ছেলে এবং ২০০৭ সালে জ্বরে তার মৃত্যু ঘটে।

১৯৯৩ থেকে ২০২৩। এই দীর্ঘ তিন দশকে দক্ষিণ সুদানের হোয়াইট নাইল কিংবা বাহার এল গজল নদীতে বহু জল গড়িয়েছে। সেই সঙ্গে কালো মানুষের লাল রক্তে বারবার সিক্ত হয়েছে নদীতট। তবে আজও সেখানে মরা শিশুর সন্ধানে শকুন উড়ে বেড়ায়। থামেনি কঙ্কালসার লাখো কং নাই অঙের কান্না ও খাদ্যাভাবে করুণ মৃত্যু। কিছু অবিবেচক ও উচ্চাভিলাষী জেনারেলের অযৌক্তিক চাহিদা এবং রাজনৈতিক শক্তির অনৈক্যের কারণে আজও সেখানে চলছে গৃহযুদ্ধ নামের মরণ খেলা। তবে পরিতাপের বিষয় ১৫ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে সুদানে নতুন করে গৃহযুদ্ধ এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ শুরুর পর জানা যায় গুটি কয়েক দেশের মানুষের সঙ্গে সেখানে আটকা পড়েছে শত শত হতভাগ্য বাংলাদেশিও। এদেশ যখন উন্নয়নের মহাসড়কে বলে জোড় গলায় আমরা দাবি করছি, তখন এ দেশের মানুষের যুদ্ধপিড়িত দেশ সুদানে পাড়ি জমানো ও জীবন বাজি রেখে অবস্থান কোনো অবস্থায় মেনে নেওয়া যায় না।

সুদানের প্যারা মিলিটারি এলিট বাহিনী ‘র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স’ প্রধান জেনারেল মো. হামাদ তার সৈন্যদের নিয়ে ১৫ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে সে দেশের সেনাপ্রধান ও সামরিক শাসক জেনারেল আব্দুল ফাতাদা আল বুরহানের বিপক্ষে তথা দেশের সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে সংঘাতে লিপ্ত হন। আলজাজিরার মতে, ৯ মে ২০২৩ পর্যন্ত ২৩ দিনের গৃহযুদ্ধে জাতিসংঘের উদ্বাস্তু সংস্থা ইউএনএইচসিআর ৩০ হাজার সুদানিকে উদ্বাস্তু হিসেবে নথিভুক্ত করে। ৬৪ হাজার সুদানি নানাভাবে পাশের দেশ মিসরে পাড়ি জমায়। সব মিলিয়ে দেশান্তরী সুদানির সংখ্যা লক্ষাধিক। আর মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিয়েছে অন্তত ৭০০ তাজা প্রাণ। ইউএনএইচসিআরের ডাটা শিট বা জরিপে দেখা যায়, সার্বিকভাবে সুদান থেকে অন্য দেশে দেশান্তরী হতে আগ্রহী মানুষের সংখ্যা ২৩ লক্ষাধিক। এর মধ্যে চার লক্ষাধিক সুদানি ইতোমধ্যে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাতে স্থানীয় একটি ইংরেজি দৈনিকের তথ্য মোতাবেক সুদানে চলমান সংঘাত শুরুর আগে প্রায় এক হাজার ৫০০ বাংলাদেশি অবস্থান করছিল। সংঘাত শুরুর পর ১৩টি বাসে প্রথম ধাপে এক হাজার ২০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পোর্ট সুদানে পৌঁছে ৬৭৩ জন বাংলাদেশি। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অফ মাইগ্রেশনের (আই ও এম) সহায়তায় সৌদি আরবের জেদ্দা হয়ে পরবর্তী সময়ে তারা দেশে ফেরে এক প্রকার শূন্য হাতে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রাথমিকভাবে জানিয়েছিল যে সুদানে আটকা পড়া ৭০০ বাংলাদেশি দেশে ফেরার আগ্রহ প্রকাশ করে। তবে অবস্থাদৃষ্টি ধারণা করা যায়, সুদানে মাটি কামড়ে পড়ে থাকা বাংলাদেশির সংখ্যা ক্রমে কমছে।

প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। ইতঃপূর্বে লিবিয়ায় অতর্কিত গুলিসহ নানা কায়দায় শতাধিক বাংলাদেশি প্রবাসীকে জীবন দিতে হয়েছে। একসময় মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের জঙ্গলে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করা বাংলাদেশিদের লাশ ও কঙ্কাল প্রাপ্তি ও গণকবরে বাংলাদেশিদের দেহাবশেষ উদ্ধার সংবাদ শিরোনাম হতো। দক্ষিণ আফ্রিকা, সিরিয়া ও পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশেও অত্যাচারিত হচ্ছেন বাংলাদেশি শ্রমিকরা। ছোট ছোট নৌযানে জীবন বাজি রেখে ভুমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার প্রচেষ্টা এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের করুণ পরিণতির খবর পাওয়া যায়। কিছুদিন আগে মধ্যপ্রাচ্যের এক হোটেলে আটক কিশোরী কন্যাকে উদ্ধার করতে প্রশাসনের সহায়তা চেয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে এক অসহায় পরিবার। সার্বিকভাবে বলা যায় বাংলাদেশ থেকে ব্যাপকহারে অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসন ঘটেছে ও ঘটছে।

বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশ ও আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশের সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এমন অবৈধ ও ত্রুটিপূর্ণ অভিবাসনের নেপথ্য কারণ ও প্রতিরোধ নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক। দেশে প্রতিবছর যে হারে সনদধারী শিক্ষার্থী চাকরিপ্রত্যাশী হচ্ছে, সে হারে কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। সুতরাং অভিবাসন আমাদের জন্য অবশ্যই আশীর্বাদ। কৃষিপ্রধান দেশ বলা হলেও এদেশের কৃষক ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয় মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে। আবার শহরে ও শিল্পাঞ্চলে সেই ফসলের ও অন্যান্য দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিম্ন আয়ের মানুষকে দিশেহারা করে তোলে। এ সময় দিশেহারা এই কৃষক, শ্রমিক ও বেকারদের পেছনে ছুটে একশ্রেণির অতি লোভী মানবসম্পদ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান, ট্রাভেল এজেন্ট এবং তাদের দালালচক্র। এই চক্রের পাতা ফাঁদে পা দেয় কিশোর, তরুণ, শিক্ষিত যুবক, সন্তানের বাবা-মা, উঠতি বয়সের যুবতি এমনকি তাদের অভিভাবকরাও। ব্যবসা করা বা খামার গড়ার জন্য কোনো টাকা না দিলেও জমি-জিরাত এমনকি গয়না বিক্রি করেও এই অভিভাবকরা দালালের হাতে টাকা তুলে দেন। অনেকে দেশেই প্রতারণার শিকার হয়। আবার জব ভিসা বা ওয়ার্ক ভিসার বদলে ভিজিট বা ট্যুরিস্ট ভিসায় বিদেশে গিয়ে অনেকেই বিপদে পড়েন। সুদান থেকে প্রত্যাগত অনেকেই অবৈধভাবে সেখানে অবস্থান করছিলেন এবং লাখ লাখ টাকা খরচ করে সে দেশে গেলেও ফিরেছেন শূন্য হাতে। হতভাগ্য এই প্রবাসী ও তাদের নিকট-আত্মীয়দের কান্নায় আজ আকাশ ভারী হয়ে উঠেছে। অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি এখনও সুদানে আটক বা বিরূপ পরিবেশে অবস্থান করতে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ দেশে স্থানীয় মহাজন বা তথাকথিত এনজিও থেকে উচ্চ সুদে প্রচুর ধারদেনা করে তারা বিদেশে পাড়ি জমালেও উপযুক্ত কাজ না পাওয়ায় ঋণ শোধে ব্যর্থ হয়। এখন মন চাইলেও দেশে ফিরতে ভয় পাচ্ছেন তারা।

অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসন হ্রাস কিংবা বন্ধের প্রথম শর্ত এদেশের উঠতি বয়সের প্রতিটি নাগরিককে মানবসম্পদে পরিণত করা। কেরানি বা চাকরিজীবী নয়, দক্ষ কর্মী ও উদ্যোক্তা হওয়ার মতো শিক্ষাব্যবস্থা সময়ের দাবি। আমাদের ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সি নাগরিকের সংখ্যা পৃথিবীর বহু দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। এই মানবগোষ্ঠীকে যদি দেশ-বিদেশে সঠিক নিয়মে উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায় তবে বদলে যাবে সার্বিক প্রেক্ষাপট। আফ্রিকাসহ পৃথিবীর বহু দেশে অন্য দেশের বিনিয়োগকারীরা হাজার হাজার হেক্টর জমি লিজ নিয়ে নিজ দেশের নাগরিকদের বৈধ কর্মসংস্থানের সুযোগ ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশ থেকে অবৈধ পথে হাজার হাজার কোটি টাকা সুইস ব্যাংক, কানাডা, দুবাই, মালয়েশিয়া কিংবা সিঙ্গাপুরে পাচার হলেও আফ্রিকায় জমি লিজ নিতে এক কোটি টাকা নেওয়ার ক্ষেত্রেও যত জটিলতা। অথচ সেই আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে দিব্যি ভিজিট বা ট্যুরিস্ট ভিসায় যেতে পারছেন এদেশের তরুণ বা যুবকরা, যার প্রমাণ সুদান সংকট। অবৈধ বা ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসন বিষয়টিও শিক্ষা পাঠ্যক্রম ও গণমাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

বড় খেলাপি ঋণের অঙ্ক দেশের লাখো বেকারকে অবৈধ প্রবাসী হওয়ার অভিশাপ থেকে রক্ষা করে সফল উদ্যোক্তায় পরিণত করতে পারে। কাগজে-কলমে বহু প্রকল্পে উদ্যোক্তা তৈরির কথা বলা হয়। তবে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব কিংবা সুদানে বাংলাদেশিদের অবস্থান এবং দরিদ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি আর দেশের শিল্প খাতে বিশেষত তৈরি পোশাক খাতে হাজার হাজার বিদেশিদের জেকে বসাই প্রমাণ করে এসব উদ্যোগের অসারত্ব। তাই সময় এসেছে সম্মিলিত উদ্যোগ ও মহা পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে এই সমস্যার মোকাবিলা করা। সুদানে আমরা যেতে চাই, তবে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী রূপে। আফ্রিকায় অবশ্যই আমাদের যেতে হবে, তবে বৈধভাবে উদ্যোক্তা, পেশাজীবী ও দক্ষ শ্রমিকরূপে। শুধু আফ্রিকায় নয়, আমরা ছড়িয়ে পড়তে চাই বিশ্বের দেশে-দেশে দক্ষ মানবসম্পদ রূপে। তবেই আমরা স্মার্ট বাংলাদেশের যোগ্য নাগরিক হয়ে উঠব।


  • অবসরপ্রাপ্ত মেজর, অভিবাসন বিষয়ক গবেষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা