× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

উপসম্পাদকীয়

বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের সুফল নিয়ে প্রশ্ন

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ

প্রকাশ : ২৯ মে ২০২৩ ১৪:১৬ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

স্বাস্থ্য খাতে প্রতিবছর বরাদ্দের অর্থ ফিরে যাওয়ার বিষয়টি যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল ৫ দশমিক ৪ শতাংশ; টাকার অঙ্কে তা ৯ হাজার ৭৯৪ কোটি। এর মধ্যে অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ৩ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা খরচ হয়েছে, যা মোট বরাদ্দের ৩৩ শতাংশ। সে হিসাবে এখনও ৬ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে। শুধু তা-ই নয়, বিদেশি সাহায্যের ৬৯ শতাংশই এখনও ব্যয় করা হয়নি। এসব দেখে ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ কমানো হবে। স্বাস্থ্য খাতে সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। আমাদের এখন সব প্রতিষ্ঠানই রয়েছে। চিকিৎসাসেবার মানোন্নয়নের জন্য বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান থাকার পরও স্বাস্থ্য খাতে নানা সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা জিইয়ে আছে। এর মূল কারণ আমরা এখনও সঠিক কাঠামো ও ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি। প্রতিষ্ঠান সবই আছে, কিন্তু সঠিক প্রতিষ্ঠানের অভাব থাকায় ভালো একটি কাঠামো গড়ে ওঠেনি। কাঠামোর অভাব থাকায় বাজেটের বরাদ্দ পুরোপুরি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। অথচ বিশেষজ্ঞদের দাবি, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ অন্তত তিন গুণ বাড়ানো উচিত। আমি মনে করি, ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হারের ওপর ভিত্তি করে আগের অর্থবছরের চেয়ে স্বাস্থ্য খাতে বাজেটে বরাদ্দ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৭ শতাংশ বাড়ানো। তবে স্বাস্থ্য খাতের চাহিদা মেটাতে এ বৃদ্ধিও যথেষ্ট হবে না।

প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের অর্থ কেন এখনও সুষমভাবে বণ্টন এবং খরচ করা সম্ভব হচ্ছে না। স্বাস্থ্য খাতে দুই ধরনের ব্যয় থাকে : পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয়। উন্নয়ন ব্যয়ের ক্ষেত্রে সচরাচর সেক্টর প্রোগ্রাম করা হয়। পাঁচ বছর মেয়াদি সেক্টর প্রোগ্রামের মাধ্যমে উন্নয়ন ব্যয় পরিচালনা করা হয়। ২০১৭ সালে সেক্টর প্রোগ্রাম চালু করা হয়, যা ২০২২ সাল নাগাদ চলার কথা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আবার নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম চালু হবে। তখন উন্নয়ন ব্যয় নতুন করে ধরা হবে। ২০১৭ সালে যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তার শেষ বছর ২০২৩। মনে রাখতে হবে, পাঁচ বছরের একটি প্রকল্প ছয় বছর ধরে বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রতার কারণে টাকা কমে গেছে। শেষ বছর হওয়ার কারণে বরাদ্দকৃত অর্থ কম থাকাই স্বাভাবিক। ২০১৭ সালে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যে পরিমাণ অর্থ হিসাব করা হয়েছিল, তা আগেই খরচ করা হয়েছে। বর্ধিত বছর পরিকল্পনায় ছিল না, কিন্তু দীর্ঘসূত্রতায় তা বেড়ে গেছে। এই বেড়ে যাওয়া অর্থের জোগান আগের বছর বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে খরচ করা যাবে। ফলে উন্নয়ন ব্যয়ের চিত্র প্রতিবছরের বরাদ্দের সুষ্ঠু বণ্টনের সঙ্গে সমন্বয়মূলক পর্যায়ে আর নেই। উন্নয়ন ব্যয় কমে যাওয়া মানে সামগ্রিক ব্যয় কমে যাবে। আমরা পরিচালন ব্যয় কমাতে পারব না। প্রতিবছর যে ব্যয় হয় তার তুলনায় পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। বরং উন্নয়ন ব্যয় তুলনামূলক হারে কমে যায় প্রতিবছর। এ জন্যই স্বাস্থ্য খাতে পরিচালন ব্যয় বেশি এবং উন্নয়ন ব্যয় কম হয়ে থাকে।

কোভিডের সময় সরকার সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিয়েছে স্বাস্থ্য খাতে। তখন স্বাস্থ্য খাতে আলাদা বরাদ্দ সরকার দিয়েছিল। আমি মনে করি, এই বরাদ্দ স্বাস্থ্য খাতের জন্য আলাদাভাবে দেওয়া উচিত। শুধু কোভিড নয়, অন্য রোগের ক্ষেত্রেও দেওয়া উচিত। কারণ স্বাস্থ্য খাতে নানা ধরনের জরুরি অবস্থা তৈরি হয়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দাবদাহ বাড়ছে। দাবদাহের কারণে প্রচুর মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন। আবার পানিবাহিত নানা রোগে মানুষ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যায়। ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, বসন্ত ইত্যাদির প্রকোপ বাড়ে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে। আবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লে হাসপাতালের দায়িত্বরতদের ব্যস্ত সময় পার করতে হয়। আবার অনেক সময় যন্ত্রপাতিবিষয়ক সংকটও দেখা দিতে পারে। নিকট-অতীতে সংবাদমাধ্যমে জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজে এমআরআই ও সিটি স্ক্যান মেশিন নেই। সরকারের আলাদা বরাদ্দ থাকলে কিন্তু এমন সমস্যা হতো না। কারণ এই আলাদা বরাদ্দ না থাকলে ঢাকা মেডিকেলকে আগামী বছরের বরাদ্দের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতের মতো জরুরি অবস্থার খাতে কিছু থোক বরাদ্দ অবশ্যই থাকা উচিত। কোভিডের মতো অবশ্য এত বরাদ্দ এখানে প্রয়োজন নেই। কিন্তু সরকার তিন থেকে চার হাজার কোটি টাকার একটি থোক বরাদ্দ রাখতে পারে। কারণ হাসপাতালের ভেতরে প্রাকৃতিক কারণে এবং উপকরণের অভাবের কারণে জরুরি অবস্থা তৈরি হতে পারে। এই যেমন কদিন আগে ঘূর্ণিঝড় মোখা উপকূল ঘেঁষে চলে গেল। এই ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানলে অনেক হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হতো। সমস্যা হলো, এই ক্ষতি পোষানোর জন্য আলাদা বরাদ্দ আমাদের নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করে ক্ষতিপূরণ আসার প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ হওয়ায় স্বাস্থ্য খাতের শেষ পর্যন্ত লাভ হয় না। অর্থাৎ স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দে আলাদা বরাদ্দ রাখার বিষয়ে মনোযোগ বাড়াতে হবে।

স্বাস্থ্য খাতে কোভিডের জন্য আলাদা বরাদ্দ করা হয়েছিল। এই বরাদ্দ বন্ধ না করে আলাদা একটি বরাদ্দ করা কঠিন কিছু ছিল না। বরং সেটিই স্বাস্থ্য খাতে সুষ্ঠুভাবে বণ্টনের পথ তৈরি করে দিত। এই বরাদ্দ ক্যানসার, কিডনিসহ কিছু দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসার জন্য ব্যয় করা যেত। ১২ এপ্রিল প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের তথ্যচিত্র বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বরাদ্দ নিয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালে ঘোরতর অনিয়মের প্রমাণ মিলেছিল ওই প্রতিবেদনে। প্রথমে প্রধানমন্ত্রীর অনুদানের ১০ কোটি টাকা এফডিআর করে রাখা হয় এবং তা থেকে প্রাপ্ত মুনাফা দিয়ে শিশু হৃদরোগীদের চিকিৎসা করা হতো। শিশুদের ওই হৃদরোগের জন্য যন্ত্রপাতি কেনার চেয়ে তা এফডিআর করে রাখাই ছিল শ্রেয়। অথচ কিছু হীন স্বার্থান্বেষী এফডিআর ভেঙে যন্ত্র কিনে নেয়, যা এক বছরেই অকেজো হয়ে পড়ে। স্বাস্থ্যসেবার বদলে স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার এই প্রবণতাই মূলত স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি জিইয়ে রেখেছে। অন্যান্য যেকোনো খাতের তুলনায় স্বাস্থ্য খাতেই মানুষের মনোযোগ থাকে বেশি। কারণ স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে মানুষের সম্পৃক্ততা অন্য যেকোনো খাতের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে স্বাস্থ্য খাতে যেকোনো পরিবর্তন বা ঘাটতি আমাদের চোখে পড়ে। আবার এও সত্য, স্বাস্থ্য খাতের প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে পরিচয় না থাকলেও এই খাতের প্রতি সদয় দৃষ্টি তৈরি হয় না। একজন ব্যক্তি যখন কোনো হাসপাতালে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত সেবা না পান তখনই তিনি ঘাটতিগুলো বুঝতে পারেন। স্বাস্থ্য খাতে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হয়েছে। কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানকে পরিচালনা করার জন্য সঠিক কাঠামো আমাদের নেই। ফলে মানুষ প্রতিনিয়ত সেবার অভাবে ধুঁকছে। বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাড়ানোই শেষ কথা নয়। এই বরাদ্দের সুষম বণ্টন ও পরিকল্পিত ব্যবহার জরুরি।

এ কথা সত্য, স্বাস্থ্য খাতে কিছু অসাধু ব্যক্তি দুর্নীতির ছক কষে বসেন। তারা কোনোভাবেই অনুকম্পা পেতে পারেন না। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের অর্থের সুষম বণ্টন নিশ্চিত না হওয়ার পেছনে সঠিক কাঠামো না থাকার দায় কম নয়। দুর্নীতিগ্রস্তদের সহজেই পরাস্ত করা যায় সুষ্ঠু কাঠামো তৈরি করার মাধ্যমে। কিন্তু নীতিনির্ধারকদের মানুষ ও স্বাস্থ্যের বিষয়ে জোর দিতে হবে। দুর্বল ব্যবস্থাপনা, অদক্ষ জনশক্তি, ব্যয়ভীতির কারণে প্রতিবছর বরাদ্দের টাকার বড় অংশ ফেরত যাচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো খরচ। বিশেষ করে ফ্যাসিলিটি পর্যায়ে খরচ ব্যবস্থাপনার অক্ষমতা। অডিটের আশঙ্কায় ব্যয় কমিয়ে রাখা হয়। পেনশন বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলার মতো শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কারণে চাকরিও চলে যেতে পারে। স্বাস্থ্য খাতে মানোন্নয়নে বাজেটের টাকা খরচ করতে ভয়ের পরিবেশ দূর করতে হবে। দুর্নীতি একটি উদ্বেগের বিষয়। দুর্নীতি নির্মূলে নজর দিতে হবে উৎসে এবং এর প্রতিকারে নিতে হবে নির্মোহ অবস্থান। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অডিট ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা জরুরি। অন্য খাতে বিলম্ব হয়তো গ্রহণযোগ্য, কিন্তু স্বাস্থ্যসেবায় ঘাটতি থাকলে তাতে মানুষের জীবনের ঝুঁকি তৈরি হবে। এই ঝুঁকি মেনে নেওয়া যাবে না। সমস্যা হলো, এই জরুরি খাতেও এক ধরনের প্রতিযোগিতা রয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য অর্থনীতির জন্য এই প্রতিযোগিতা দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতি ডেকে আনবে। তাই এখনই এ বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে। বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ না কমিয়ে তা কীভাবে সুষমভাবে বণ্টন করা যায়, এ বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।


  • অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা