উপসম্পাদকীয়
এম হাফিজ উদ্দিন খান
প্রকাশ : ২৭ মে ২০২৩ ১১:০৭ এএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ও ভোটকেন্দ্রের পরিবেশ নিয়ে আলোচনা যখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে,
তখন গাজীপুর সিটি নির্বাচন আশার আলো দেখিয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থায় মুখ্য শক্তি নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনকে ঘিরে যখন জনআস্থার পারদ ক্রমেই নামছিল,
তখন গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিম্নমুখী পারদ কিছুটা হলেও ঊর্ধ্বমুখী করেছে। এ জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ কমিশনের দায়িত্বশীল ও মাঠপর্যায়ে দায়িত্বরত সবাই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। আমরা দেখেছি,
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি ঘোষণায় বাংলাদেশের নির্বাচনসংক্রান্ত বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। দুদিন আগে ‘বাংলাদেশে ভোটের
পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে’
যুক্তরাষ্ট্র নতুন যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে সেটিকে দেশের সচেতন মানুষ তো বটেই,
এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোও ‘সতর্কবার্তা’ হিসেবে
দেখছে। যুক্তরাষ্ট্রের তরফে ঘোষিত ওই নীতির পর্যালোচনা করলে সহজেই প্রতীয়মান হয় বাংলাদেশের রাজনীতি এবং নির্বাচন ব্যবস্থা কিংবা প্রক্রিয়া নানা কারণে আন্তর্জাতিক মহলেও আলোচনার বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক মহলে তো বটেই,
সাধারণ মানুষের মধ্যেও ব্যাপক কৌতূহল ছিল। যদিও দেশের অন্যতম বিরোধী দল বিএনপি এই নির্বাচন বর্জন করেছে,
কিন্তু তার পরও বলতে হবে এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কিছুটা হলেও অর্জন সম্ভব হয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে জয়যুক্ত হয়েছেন জায়েদা খাতুন। উল্লেখ্য,
তিনি গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এবং এই নির্বাচনেই অংশগ্রহণকারী প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম,
যার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়,
তার মা। আমাদের অভিজ্ঞতায় দেশের নির্বাচন মানেই যেন হয়ে দাঁড়িয়েছিল কেন্দ্র দখলের অরুচিকর প্রতিযোগিতা,
ভোটারের খরা,
নানারকম অনিয়ম এবং সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল অনেকেরই স্বেচ্ছাচারিতা। শেষ পর্যন্ত সব কৌতূহল ও অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ব্যক্তি জায়েদা খাতুন জয়ী হলেও চূড়ান্ত অর্থে বলা যায়,
এই জয় সরকার ও ইসির ভাবমূর্তির কিছুটা হলেও উজ্জ্বল করেছে। শঙ্কা কাটিয়ে সুষ্ঠু এই নির্বাচনে স্বচ্ছতার সাক্ষী হলেন গাজীপুরের ভোটাররা। একই সঙ্গে দেশের মানুষও অনেকটা স্বস্তি পেয়েছে।
ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত নির্বাচনে অংশীজনদের সন্তুষ্টির খবর উঠে এসেছে। পরাজিতরা নির্বাচন কমিশন কিংবা মাঠপর্যায়ে দায়িত্বরতদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উত্থাপন করেছেন এমনটি শোনা যায়নি। এই নির্বাচনে সিসি ক্যামেরায় পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা করেছিল ইসি। অনেকেরই ধারণা এর কিছুটা হলেও সুফল মিলেছে। সংবাদমাধ্যমেই দেখা গেছে,
ভোট শুরুর আগ থেকেই কেন্দ্রগুলোতে ভোটাররা উপস্থিত হতে থাকেন। দিনশেষে দেখা গেছে,
ভোটদানের হার সন্তোষজনক। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সব কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে
(ইভিএম)
ভোটগ্রহণ হয়েছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় অনেক ভোটারের অসন্তুষ্টি প্রকাশের খবরও সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। ইভিএমের ধীরগতিতে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের পাশাপাশি ভোটদানে বিলম্বের চিত্রও দেখা গেছে। অনেকেরই ধারণা,
প্রক্রিয়ার বিলম্বিত কারণ দৃশ্যমান না হলে ভোটদাতার সংখ্যা আরও বাড়ত। সাম্প্রতিক সময়ে সংসদীয় বিভিন্ন আসনের উপনির্বাচনে এবং স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনে যে অস্বচ্ছতার অভিযোগ জনমনে ক্ষোভের দানা পুষ্ট করেছিল,
এর বিপরীতে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সিন্ধুর মাঝে বিন্দুর মতো হলেও আশা জাগিয়েছে।
গণতন্ত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ নির্বাচন। আর নির্বাচনের অন্যতম অনুষঙ্গ ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি এবং স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ। আগেও বলেছি,
ভোটাধিকার প্রয়োগও মানবাধিকার। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য,
এই অধিকারের ব্যত্যয় ঘটেছে অনেক ক্ষেত্রেই। তিক্ত অভিজ্ঞতার পরও প্রশ্নমুক্তভাবে সম্পন্ন হওয়া গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন-উত্তর
আশা করছি,
নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচনকালীন সময়ে তার সহযোগী শক্তি সরকার শিক্ষালাভ করবে। সংবাদমাধ্যমে এও দেখেছি,
অনেক কেন্দ্রেই স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের কোনো এজেন্ট ছিলেন না। আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহানূর ইসলামের এজেন্টও খুব একটা দেখা যায়নি। এর পরও ভোট দিয়ে প্রায় সব মেয়রপ্রার্থীর শান্তিপূর্ণ ভোট হচ্ছে জানিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। নির্বাচনে অংশীজনদের এই সন্তোষ প্রকাশ নিঃসন্দেহে গণতন্ত্র ও নির্বাচনের জন্য ইতিবাচক বার্তা। তবে একই সঙ্গে এ কথাও বলতে চাই,
ইসি গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন প্রশ্নমুক্ত করে যেন আত্মতৃপ্তিতে না ভোগে। আগামীতে তাদের সামনে রয়েছে আরও অনেক চ্যালেঞ্জ। নিকটেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আরও কয়েকটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন এবং তারপর জাতীয় নির্বাচন।
সংবাদমাধ্যমেই দেখেছি,
ওই সিটিগুলোতে নির্বাচনে অংশীজন অনেকেই নানা অভিযোগ এনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। অতীত অভিজ্ঞতা এবং বিদ্যমান পরিস্থিতি তাদের এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়তো বাধ্য করেছে। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্যে এ কথাও বলতে চাই,
বর্জন কোনো অর্জন এনে দিতে পারে না। বরঞ্চ মাঠে থেকে অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে অধিকার আদায়ের বিষয়টি কীভাবে নিশ্চিত করা যায় সেটিই বড় বিষয়। আমরা আশা করব,
পরবর্তী ধাপে যে সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচন হতে যাচ্ছে সেই নির্বাচনও যাতে দৃষ্টান্তযোগ্য হয় এ লক্ষ্যে সব রকম পদক্ষেপ নেবে ইসি। ইসির সহযোগী শক্তি সরকারকেও এ ব্যাপারে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। আমরা জানি,
সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে সরকারের দায়িত্বশীল অনেকেই দেশে-বিদেশে
এই প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন,
আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ,
নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হবে। আমরা তাদের এই আশ্বাসে বিশ্বাস রাখতে চাই।
যেসব কারণে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা কিংবা প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে তা নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের অজানা নয়। কারণগুলো যেহেতু চিহ্নিত,
সেহেতু এর প্রতিকার কিংবা প্রতিবিধান নিশ্চিত করাও কঠিন কিছু নয়। দেশে-বিদেশে
যখন আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থার চিত্র ‘বিপন্ন দশা’ হিসেবে
অভিহিত হয়,
তখন শুধু দেশের ভাবমূর্তিই মলিন হয় না,
গণতন্ত্রও অনুজ্জ্বল হয়ে পড়ে। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কোনো পক্ষেরই ভুলে যাওয়া উচিত নয়,
গণতন্ত্রের জন্য দেশের সাধারণ মানুষের যে ব্যাপক অবদান রয়েছে। গণতন্ত্রে জনগণই ক্ষমতার মূল উৎস। যেকোনো নির্বাচনের ক্ষেত্রে মুখ্য শক্তি হলেন ভোটার। আর নির্বাচন কমিশন ও তাদের সহযোগীদের মুখ্য দায়িত্ব হচ্ছে ভোটারের অধিকার সুরক্ষা করা। অতীতে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। একই সঙ্গে সরকারের ভূমিকাও ছিল অনুজ্জ্বল। ভোটারের ভোটাধিকার প্রয়োগে উৎসাহ হারিয়ে ফেলা মোটেও স্বস্তির বিষয় নয়। কিন্তু গাজীপুর সিটি নির্বাচনে নেতিবাচক এই বিষয়গুলোর পুনরাবৃত্তি না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকেই অভিনন্দন জানাই। প্রচারাভিযান থেকে শুরু করে ভোটপর্ব ও ফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের দায় নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন সুষ্ঠু,
অবাধ,
নিরপেক্ষ কিংবা প্রশ্নমুক্ত করার জন্য আমাদের নির্বাচন কমিশনারের কাছে সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতা কম নেই। ইসির দায়িত্বশীলদের কাছে সরকারি কর্মকর্তাদের মতো আচরণ কাম্য নয়। সরকারি কর্মকর্তারা সরকারের আদেশ পালন করেন। কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত বিধায় তাদের কার্যক্ষমতা স্বাধীন। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের যেটুকু ক্ষমতা রয়েছে এর যথাযথ প্রয়োগে প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন করা মোটেও কঠিন কিছু নয়Ñ
এর দৃষ্টান্ত তো আমাদের দেশেই রয়েছে। সর্বশেষ গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও তা আমরা দেখেছি। আশা করব,
এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে এবং প্রতিটি নির্বাচন যাতে অংশগ্রহণমূলক হয় এ ব্যাপারে ইসি ও সরকার যথাযথ ভূমিকা নেবে।
সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জরুরি হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছা। সরকারের মনোযোগ বাড়ানো উচিত গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, সুশাসন নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অধিকারের বিষয়গুলো সুনিশ্চিত করায়। সুশাসন নিশ্চিত হলে নেতিবাচক অনেক কিছুরই ছায়া সরানোর পথটা প্রশস্ত হবে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতার ছায়া গাঢ় হয়েছে বলেই নেতিবাচক অনেক কিছু দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা তো বটেই, দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থেও নির্বাচন প্রশ্নমুক্ত করার লক্ষ্যে সবরকম ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কে হেরেছেন কিংবা কে জিতেছেন এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো গণতন্ত্র ও মানুষের প্রত্যাশা জয়যুক্ত হয়েছে, গণতন্ত্রের শোভাবর্ধন হয়েছে। এই আলোকে ভবিষ্যতে পথরেখা নির্ণয় করা হবে এটিই প্রত্যাশা। আমরা জানি, স্থানীয় সরকার কাঠামোর বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনও এখন দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এমতাবস্থায় সরকার তো বটেই, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলেরও এক্ষেত্রে দায়দায়িত্ব কম নয়। যেহেতু একটি ভালো দৃষ্টান্ত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এত প্রতিকূলতার মধ্যেও পাওয়া গেল, সেহেতু স্বচ্ছ নির্বাচন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জনপ্রত্যাশা পূরণের কাজটি শুরু করা দরকার এখান থেকেই। ভালো কিংবা খারাপ এই দুই অভিজ্ঞতা আমলে রেখেই পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে। রাজনীতি, নির্বাচন ব্যবস্থাসহ একটি বিকশিত গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ার লক্ষ্যে যেসব ক্ষেত্রে সংস্কার জরুরি তা করতে হবে জাতীয় স্বার্থ ও প্রয়োজনে; দলীয় বিবেচনায় নয়। সদ্যসমাপ্ত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন যে আশার আলো দেখিয়েছে তা যেন নিভে না যায়।