উপসম্পাদকীয়
মহিউদ্দিন খান মোহন
প্রকাশ : ২৫ মে ২০২৩ ০২:০২ এএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
গত ১৪ মের দৈনিক পত্রিকাগুলোতে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তারা পরস্পরকে ‘নিরাপদ নিষ্ক্রান্তি’ বা ‘সেফ এক্সিট’ নিয়ে উপদেশ খয়রাত করেছেন। বিএনপি মহাসচিব ওই দিন নয়াপল্টনের সমাবেশে আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘সেফ এক্সিট চাইলে ক্ষমতা ছেড়ে দিন’। অন্যদিকে দলীয় প্রতিবাদ সভায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বিএনপিকে বলেছেন, ‘সেফ এক্সিট চাইলে নির্বাচনে আসুন।’ দুই দলের শীর্ষস্থানীয় এই দুই নেতার পরস্পরকে সেফ এক্সিট বিষয়ে পরামর্শ দান জনমনে ঔৎসুক্যের সৃষ্টি করেছে। কেননা তাদের কথায় এটা মনে হচ্ছে যে, উভয় দল অত্যন্ত বিপদসংকুল অবস্থায় রয়েছে এবং সে বিপদ থেকে তারা পরস্পরের নিরাপদে বেরিয়ে আসার বিষয়ে অতীব উদ্বিগ্ন। কিন্তু বাস্তবতা যে তা নয়, সেটা সবাই বিলক্ষণ জানেন। বরং কুস্তিগিরদের মতো প্যাঁচে ফেলে কে কাকে ধরাশায়ী করবে, সে চিন্তায় কাটে তাদের অহর্নিশি।
একদিকে সরকারপক্ষ চেষ্টা করছে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পদক্ষেপের মাধ্যমে আগামী নির্বাচনী মাঠ নিজেদের অনুকূলে রাখতে। আর বিরোধীপক্ষ চেষ্টা করছে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দাবি আদায়ের মাধ্যমে নির্বাচনী মাঠে তাদের স্বাচ্ছন্দ্য বিচরণ নিশ্চিত করতে। দুই পক্ষের এই সমর প্রস্তুতির খবর প্রতিনিয়ত উঠে আসছে গণমাধ্যমের খবরে। গত ৪ মে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রধান শিরোনাম ছিল ‘ভোটের রোডম্যাপে আওয়ামী লীগ’। আর দ্বিতীয় শিরোনাম ছিল ‘আন্দোলনের নতুন ছক সাজাচ্ছে বিএনপি’। বিএনপির আন্দোলনের নতুন ছক নিয়ে বলার তেমন কিছু নেই। কেননা বিগত বছরগুলোতে তারা বহুবার ‘আন্দোলনের নতুন ছক’ কিংবা ‘চূড়ান্ত আন্দোলনের রোডম্যাপ’ ঘোষণার কথা বলেছে। যদিও তা অমাবস্যার চাঁদের মতেই রয়ে গেছে দৃশ্যের অন্তরালে। উল্লিখিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচনের বছরে সরকারকে ধাক্কা দেওয়ার মতো আন্দোলনের কৌশল বা চূড়ান্ত কর্মসূচি প্রণয়নের লক্ষ্যে দলটি এখন কাজ করছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বলেছেন, ‘আমরা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্ব নিয়ে আলোচনা করছি। সেগুলো চূড়ান্ত করার পরই কর্মসূচি ঘোষণা করব।’ এক যুগেরও অধিক সময় ধরে চলমান বিএনপির ধারাবাহিক আন্দোলনের একটি যৌক্তিক পরিণতি দেখার অধীর আগ্রহ রয়েছে দেশবাসী, তথা বিএনপির সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের। কিন্তু হতাশার বিষয় হলো, প্রতিবারই ঢাকঢোল পিটিয়ে দলটি যে কর্মসূচি ঘোষণা করে, একটু বিরতি দিয়ে পুনরায় তা নতুন করে শুরু করতে হয়। অনেকটা সেই টিভি নাটকের নামের মতোÑ ‘শেষ থেকে শুরু’।
ওদিকে ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনী প্রস্তুতি চলছে বেশ জোরোশোরেই। ক্ষমতার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য আগামী নির্বাচনে জয়ের ফসল ঘরে তুলতে তারা নানা পরিকল্পনা করছে। প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর ৪ মের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের সাংগঠনিক কাঠামো শক্তিশালী করা এবং কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে শুরু করেছে দলটি। এ লক্ষ্যে সারা দেশে আওয়ামী লীগের সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর কাজ চলছে পুরোদমে।
অন্যদিকে সরকারও নির্বাচনী রোডম্যাপ নিয়ে কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে। প্রতিদিনের বাংলাদেশ একই দিনের পৃথক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, সরকারের শেষ বছরে বড় ধরনের নিয়োগ হতে যাচ্ছে পুলিশে। চলতি বছরে পাঁচ হাজার কনস্টেবল নিয়োগ হওয়ার পর এখন প্রায় ৮০০ সার্জেন্ট নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। এ ছাড়া দেড় থেকে দুই হাজার এসআই নিয়োগ দেওয়ার কাজ সম্পন্ন হওয়ার পথে। অন্যদিকে ৭ মের প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে পুলিশ প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য তৈরি হচ্ছে এসপি-ওসিসহ দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের ‘ফিটলিস্ট’। যাদের ওপর ‘আস্থা’ রাখা যায়, এমন কর্মকর্তাদের ইউনিটগুলোতে পদায়নের লক্ষ্যে পুলিশ প্রশাসনে বড় ধরনের পদোন্নতি ও রদবদলের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এই ‘আস্থা’ নিয়েই রয়েছে বড় প্রশ্ন, আর সে প্রশ্নের উত্তর রয়েছে ওই প্রতিবেদনেই। কয়েকজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচনকে সামনে রেখে বড় ধরনের পদোন্নতিরও পরিকল্পনা রয়েছে পুলিশে। বিষয়টিকে বলা যায় নির্বাচনী পদোন্নতি।’ পুলিশ প্রশাসনে ‘নির্বাচনী পদোন্নতি’ দিয়ে সরকার নির্বাচনী মাঠকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাচ্ছে এবং তা অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে সচেতন মহলের ধারণা। কেননা সরকার যেভাবে সিভিল এবং পুলিশ প্রশাসন সাজাচ্ছে, তাতে নির্বাচন নিয়ে সরকারের অভিসন্দি সম্পর্কে বিএনপির অভিযোগ অনেকের কাছেই আমলযোগ্য মনে হতে পারে। গত ৮ মে সংবাদমাধ্যমে দেওয়া এক বিবৃতিতে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘গদি রক্ষা করতে সরকার বেসামাল হয়ে উঠেছে। তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘বর্তমানে কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত না হলেও নির্দোষ মানুষকে অপরাধী বানিয়ে গায়েবি মামলা, গ্রেপ্তার, কারান্তরীণ, রিমান্ডে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন ও হয়রানি করা হচ্ছে (সূত্র : প্রতিদিনের বাংলাদেশ, ৯ মে ২০২৩)।
বিএনপি মহাসচিবের এ অভিযোগের মধ্যে হয়তো অনেকে নতুনত্ব খুঁজে পাবেন না। কেননা এ ধরনের অভিযোগ তারা প্রতিনিয়ত করে আসছেন। তবে এটা ঠিক, সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ ও আচরণ তাদের অভিযোগকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। নির্বাচনী বছরে এসে পুলিশ প্রশাসনে ঢালাও নিয়োগ এবং পাইকারি প্রমোশনের উদ্দেশ্যকে কেউ যদি ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়’ বলে অভিহিত করেন, তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যাবে কোন যুক্তিতে? এসব ঘটনা বিবেচনায় নিলে বিএনপির নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি যে কারও কাছে যৌক্তিক মনে হওয়াটা স্বাভাবিক।
একটি সরকার যখন পুনরায় নির্বাচিত হয়ে আসার জন্য রাজনৈতিক কর্মসূচির পরিবর্তে প্রশাসনকে সাজানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন তা নিয়ে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। বস্তুত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও ততই বাড়ছে। সবার একই প্রশ্নÑ একটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সম্ভব হবে কি না। আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি এখনও পর্যন্ত নির্বাচন প্রশ্নে যে অবস্থানে রয়েছে (অন্তত প্রকাশ্যে), তাতে তাদের অংশগ্রহণ অনিশ্চিত। যদি বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে, তাহলে তাদের রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির চেয়ে বড় নিকাশের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা; যা দেশের গণতন্ত্রের পরিমাপে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অনেকে অবশ্য মনে করেন, বিএনপি আন্দোলনের পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সন্তর্পণে। অন্যদিকে সরকারপক্ষ যেভাবে বিএনপিকে উপেক্ষার মনোভাব প্রদর্শন করে চলেছে, তাতে শান্তিপূর্ণ সমাধানের আশা এখনও সুদূর পরাহত বলেই মনে হচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে দুই পক্ষের সেফ এক্সিট বিষয়ক পাল্টাপাল্টি বক্তব্য জনমনে শঙ্কার জন্ম দিয়েছে, শেষ পর্যন্ত দেশের গণতন্ত্র সেফ এক্সিট পাবে তো?